চাঁদপুর: মাদক পাচারের নিরাপদ রুটে পরিণত হয়েছে ‘ইলিশে বাড়ি’ খ্যাত জেলা চাঁদপুর। পাশ্ববর্তী জেলাগুলোর সঙ্গে সড়ক, নৌ ও রেলপথ - তিন পথেই যোগাযোগ সহজ বিধায় চাঁদপুরকে রুট হিসেবে ব্যবহার করছেন মাদক পাচারকারীরা।
বিশেষ করে সড়ক পথে মাদকের চালান বেশি পাচার হচ্ছে। সড়ক পথে চাঁদপুরের সঙ্গে সীমান্তবর্তী জেলা কুমিল্লা, লক্ষ্মীপুরসহ আশপাশের জেলার মাদক কারবারির যোগাযোগ ব্যবস্থা সহজ।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তৎপর থাকলেও রুট পরিবর্তন করে এবং বিভিন্ন কৌশল অবলম্বন করে মাদক পাচার অব্যাহত রেখেছেন তারা।
সংশ্লিষ্ট পরিসংখ্যান সূত্রে জানা যায়, গত কয়েক বছরে জেলায় পুরুষের পাশাপাশি নারী মাদক বিক্রেতাও বেড়েছে। ২০২১ সালে বিভিন্ন ধরনের মাদকসহ গ্রেফতার হয়েছেন ১ হাজার ২৩৭ জন। ২০২২ সালে গ্রেফতার সংখ্যা বেড়েছে। এ বছর মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর ও জেলা পুলিশের পরিসংখ্যানে গ্রেফতার ২ হাজার ৩০৫ জন। জেলা কারাগারে থাকা আসামিদের মধ্যে ৮০ ভাগই মাদক সেবন ও বিক্রির সঙ্গে জড়িত মামলার।
চাঁদপুর জেলা মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, ২০২২ সালে মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের অভিযানে ইয়াবা জব্দ হয়েছে ১৯ হাজার ১৩৯ পিস, কোডিন বেজড সিরাপ (ফেন্সিডিল) ৬৩০ বোতল, গাঁজা ৬৫১ কেজি গাঁজা। এসব ঘটনায় ২২১ মামলায় গ্রেফতার ২৭৭ মাদক কারবারি। ২০২১ সালে মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের অভিযানে ইয়াবা জব্দ ২১ হাজার ৬৯৬ পিস, ফেন্সিডিল সিরাপ ১৮ বোতল, গাঁজা ২৭ কেজি ও চোলাই মদ ৪০ লিটার। এসব ঘটনায় ১৬২ মামলায় গ্রেফতার হয়েছে ১৭৮জন।
অপরদিকে জেলা পুলিশের ২০২২ সালে অভিযানে ইয়াবা জব্দ হয়েছে ৭০ হাজার ৭৪৫ পিস, ফেন্সিডিল সিরাপ ৪ হাজার ৩৯৯ বোতল, গাঁজা প্রায় ১ হাজার ২৮৪ কেজি। এসব ঘটনায় ১ হাজার ২৪২ মামলায় গ্রেফতার হয়েছে ২ হাজার ২৮জন।
২০২১ সালে জেলা পুলিশের অভিযানে ইয়াবা জব্দ হয়েছে ৫৮ হাজার ৯৪৪ পিস, ফেন্সিডিল সিরাপ ৩৭৩ বোতল, গাঁজা ২০৬ কেজি। এসব ঘটনায় ৮৩৬ মামলায় গ্রেফতার হয়েছে ১হাজার ৫৯জন।
চাঁদপুর জেলায় মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ করার লক্ষ্যে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী নিয়মিত অভিযান করছে। নৌপথে অভিযান চালাচ্ছে নৌ থানা ও নৌ পুলিশ ফাঁড়ি ও কোস্টগার্ড। সড়ক পথে জেলা গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি) ও ৮ থানার পুলিশ। রেলপথে চাঁদপুর জিআরপি থানা পুলিশ এবং বিচ্ছিন্নভাবে জেলাজুড়ে অভিযান করছে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর।
বিশেষ করে কুমিল্লার সীমান্ত উপজেলা ফরিদগঞ্জ, কচুয়া ও শাহরাস্তি উপজেলার প্রবেশমুখে গ্রেফতার হচ্ছে মাদক কারবারিরা। চাঁদপুর লঞ্চঘাট থেকেও বিপুল পরিমাণ মাদক উদ্ধার করেছে নৌ পুলিশ।
চাঁদপুর জেলা মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক এমদাদুল ইসলাম মিঠুন বাংলানিউজকে বলেন, পর্যবেক্ষণ করে দেখেছি মাদক পাচারের জন্য চাঁদপুর জেলা একটি নিরাপদ রুট। কারণ আটক মাদক বিক্রেতার মধ্যে অধিকাংশ দেশের দক্ষিণ ও পশ্চিম অঞ্চলের জেলার বাসিন্দা। গত এক বছরে ১৭৮জন মাদক কারবারিতে গ্রেফতার করেছি।
শুধু গ্রেফতারই নয়, পাশাপাশি জনসেচতনতামূলক সভা করেছেন বলে জানালেন তিনি। বললেন, গত ১ বছরে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসহ বিভিন্ন স্থানে ৭০টি সভা করা হয়েছে। যাতে করে যুব সমাজ মাদকের দিকে না গিয়ে নিজেদেকে গড়ে তুলতে পারে। পাশাপাশি মাদকবিরোধী শিক্ষা উপকরণ বিতরণ করা হচ্ছে। এছাড়াও প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে মাদকের বিরুদ্ধে গণআন্দোলন গড়ে তোলার জন্য কর্মশালা অব্যাহত আছে।
চাঁদপুর সদর মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মুহাম্মদ আব্দুর রশিদ বাংলানিউজকে বলেন, কুমিল্লার পাশবর্তী বর্ডার এলাকায় গাঁজার চাষ হয় এবং প্রচুর পরিমাণ গাঁজা উৎপাদন হয় ভারতে। ওই এলাকা থেকে অর্থাৎ চৌদ্দগ্রাম, কুমিল্লা সদর, সদর দক্ষিণ বর্ডার দিয়ে বাংলাদেশ গাঁজা প্রবেশ করে। এরপর চাঁদপুরসহ বিভিন্ন জেলায় পাচার হয়।
চাঁদপুরের পুলিশ সুপার মো. মিলন মাহমুদ বাংলানিউজেক বলেন, ২০২১ সাল থেকে ২০২২ সালে মাদকসহ গ্রেফতারের সংখ্যা প্রায় দ্বিগুন বেড়েছে। যেসব রাস্তা দিয়ে মাদক প্রবেশ করে সেখানে আমরা চেকপোস্ট বসিয়ে নিয়মিত অভিযান করছি। আমরা ইউনিয়নভিত্তিক মাদক কারবারিদের তালিকা করেছি। ওই তালিকা অনুযায়ী তাদেরকে নজরদারিতে রাখা হচ্ছে। মূলত: তথ্যের ভিত্তিতে এবং নিয়মিত অভিযানে মাদক কারবারিদের গ্রেফতার করা হচ্ছে।
চাঁদপুরের জেলা প্রশাসক কামরুল হাসান জানান, জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারি মাসে জেলা কারাগারে নিয়মিত পরিদর্শনে গিয়ে আসামিদের সঙ্গে কথা বলেছি। অধিকাংশই হচ্ছে মাদকের আসামি। পরিসংখ্যানে দেখা গেল কারাগারে থাকা ৯০০ জন আসামির মধ্যে প্রায় ৮০০ জনই হচ্ছে মাদক মামলার। স্মার্ট বাংলাদেশ গড়তে হলে সম্মিলিত প্রচেষ্টায় মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ করতে হবে।
বাংলাদেশ সময়: ১২৫০ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ১৩, ২০২২
এসএএইচ