খুলনা: খুলনার দৌলতপুর মহেশ্বরপাশার বণিকপাড়ার রহিমা বেগমের নিখোঁজের হোতা তারই মেয়ে মরিয়ম মান্নান। জমি সংক্রান্ত বিরোধে মেয়ে মরিয়ম মান্নানের নেতৃত্বেই প্রতিবেশীদের ফাঁসাতে রহিমা বেগমের অপহরণ নাটক সাজানো হয়।
সোমবার (১৩ ফেব্রুয়ারি) বেলা সাড়ে ১১টায় পিবিআই খুলনার পুলিশ সুপার সৈয়দ মুশফিকুর রহমান পিবিআই কার্যালয়ে এক প্রেস ব্রিফিংয়ে এসব তথ্য জানান।
সেই সঙ্গে এদিন রহিমা বেগম নিখোঁজের বিষয়ে মহানগর হাকিম আদালতে তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করা হয়েছে বলেও জানান তিনি।
পুলিশ সুপার বলেন, মরিয়ম মান্নান শুধু প্রতিবেশীদের ফাঁসানোর জন্যই একাধিক মামলা চলমান থাকতেই এ নাটক সাজান। মূলত রহিমা বেগম অপহৃত হননি, তিনি স্বেচ্ছায় আত্মগোপন করেন।
তিনি আরও বলেন, আমরা রহিমা বেগমের নিখোঁজ হওয়ার ব্যপারে তদন্তের পর রহিমা বেগম ও তার দুই মেয়ে আদুরি এবং মরিয়ম মান্নানের সংশ্লিষ্টতা পেয়েছি। রহিমা বেগম ২৮ দিন আত্মগোপনে ছিলেন। এ কয়দিন তিনি বিভিন্ন স্থান বদল করেন। তিনি ঢাকা থেকে বান্দরবান হয়ে ফরিদপুরের আব্দুল কুদ্দুসের বাড়িতে যান। আমরা খবর পেয়ে ওখান থেকে তাকে অক্ষত উদ্ধার করি।
সৈয়দ মুশফিকুর রহমান বলেন, রহিমা বেগমকে উদ্ধারের পর তিনি কথা বলছিলেন না, নিরব ছিলেন। অনেক চেষ্টার পর তাকে দিয়ে কথা বলাতে সক্ষম হলেও তিনি প্রতিবেশী যাদের সঙ্গে বিরোধ ছিল, তাদের নাম উল্লেখ না করে তারা অপহরণ করেছে বলে বিবৃতি দেন। পরবর্তীতে তাকে আদালতে ২২ ধারায় জবানবন্দীর জন্য পাঠানো হলে তিনি একই রকমের মিথ্যা বক্তব্য দেন।
মামলার তদন্ত কার্যক্রম শেষ প্রসঙ্গে পিবিআই খুলনার পুলিশ সুপার বলেন, যেহেতু আমরা মামলার তদন্ত কার্যক্রম শেষ করেছি এবং যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল, ঘটনা ঘটার সঙ্গে সঙ্গে তাদের ঘটনাস্থল মহেশ্বরপাশায় পাওয়া যায়। সুতরাং তদন্ত শেষে এবং ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের মতামতে শুধু জমিজমা সংক্রান্ত বিরোধের জেরে প্রতিবেশীদের ফাঁসাতে মরিয়ম মান্নানের নেতৃত্বে এই অপহরণ নাটক সাজানো হয়।
সৈয়দ মুশফিকুর রহমান বলেন, বিষয়টাকে 'টক অব দ্য কান্ট্রি'তে পরিণত করেন মরিয়ম মান্নান। পাশাপাশি ময়মনসিংহের ফুলপুরে ৩০/৩২ বছর বয়সী এক নারীর অর্ধগলিত মরদেহকে তিনি নিজের মা বলে চালিয়ে দেওয়ার নাটকও করেন। নাটকটির পেছনের কারণ ছিল, যদি তাকে (ওই মরদেহকে) তার মা বলে চালিয়ে দেওয়া যেতো, তাহলে প্রতিবেশীদের চিরতরে ফাঁসানো যেতো এবং নিঃশেষ করা যেতো। কিন্তু তিনি চিন্তা করতে পারেননি যে, পুলিশ বাহিনী খুঁজে খুঁজে তার মাকে বের করে ফেলবে।
পুলিশ সুপার আরও বলেন, সুতরাং তাদের বিরুদ্ধে যাতে বিজ্ঞ আদালত ব্যবস্থা নেয়, সেই সুপারিশ করা হয়েছে। নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের ১৭ ধারা অনুযায়ী রহিমা বেগম, তার মেয়ে মরিয়ম মান্নান এবং আরেক মেয়ে ও মামলার বাদি আদুরি আক্তার- এই ৩ জনের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য আমরা আদালতে সুপারিশ করেছি।
তিনি আরও বলেন, গোটা নাটকের মাস্টার মাইন্ড মরিয়ম মান্নান। দেশব্যাপী যে ক্রাইসিস সৃষ্টি করেছিলেন তিনি, তার মাকে খুঁজে পাওয়ার জন্য, সেই কারণে আমরা একটু বেশি সময় নিয়ে পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে তদন্ত করেছি। যাতে আমরা দেশবাসীকে আশ্বস্ত করতে পারি এবং সবাইকে একটা বার্তা দিতে পারি যে, পরবর্তীতে এই ধরনের ঘটনা, এই ধরনের নাটক ও নিজের মাকে লুকিয়ে রেখে এই ধরনের অপকর্ম করতে কেউ সাহস না পায়।
অপহরণ মামলায় গ্রেফতারদের প্রসঙ্গে পিবিআই খুলনার পুলিশ সুপার বলেন, ইতোপূর্বে অপহরণ মামলায় যে ৫ জনকে পুলিশ গ্রেফতার করেছিল, তারা এ ঘটনায় নির্দোষ। তদন্ত প্রতিবেদনে তাদের অব্যাহতির সুপারিশ করা হয়েছে।
উল্লেখ্য, খুলনার দৌলতপুর মহেশ্বরপাশার বণিকপাড়া থেকে গত বছরের ২৭ আগস্ট রাত সাড়ে ১০টার দিকে রহিমা বেগম নিজ বাসার উঠানের নলকূপ থেকে পানি আনতে গিয়ে আর ঘরে ফেরেননি। সে সময় রহিমার দ্বিতীয় স্বামী বিল্লাল হাওলাদার ওই বাড়িতেই ছিলেন। ওই রাতেই (২৭ আগস্ট) রহিমা বেগমের ছেলে দৌলতপুর থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেন। পরের দিন ২৮ আগস্ট রহিমা বেগমের আরেক মেয়ে আদুরি আক্তার বাদী হয়ে অজ্ঞাতনামা ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে খুলনার দৌলতপুর থানায় মাকে অপহরণের অভিযোগে মামলা দায়ের করেন।
এরপর পুলিশ ও র্যাব ৬ জনকে গ্রেফতার করে জিজ্ঞাসাবাদ করে। ১৭ সেপ্টেম্বর দৌলতপুর থানা থেকে মামলাটি পিবিআইকে তদন্তভার দেওয়া হয়। আট দিন পর ২৪ সেপ্টেম্বর নিখোঁজ রহিমা বেগমকে অক্ষত অবস্থায় ফরিদপুরের বোয়ালমারী উপজেলার সৈয়দপুর গ্রাম থেকে উদ্ধার করে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী। উদ্ধারের আগে দিব্যি দৈয়দপুরে কুদ্দুসের বাড়িতে রীতিমত খোশগল্পে মশগুল ছিলেন রহিমা বেগম। তবে আচমকা পুলিশ দেখা মাত্রই চুপ হয়ে যান তিনি এবং উদ্ধারের পরপরই পাল্টাতে থাকে দৃশ্যপট।
বাংলাদেশ সময়: ১৩১২ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ১৩, ২০২৩
এমআরএম/এনএস