ঢাকা: ভাষা দিবস বিতর্ক প্রতিযোগিতায় ঢাকা কলেজকে হারিয়ে বিজয়ী হয়েছে ইডেন মহিলা কলেজ।
শনিবার (২৫ ফেব্রুয়ারি) ডিবেট ফর ডেমোক্রেসির আয়োজনে রাজধানীর তেজগাঁওয়ের এফডিসিতে এ প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হয়।
‘বর্তমান প্রজন্ম ভাষা আন্দোলনের চেতনা লালন করছে’ শীর্ষক বিষয়ে ছায়া সংসদের আদলে বিতর্ক প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে বক্তব্য রাখেন একুশে পদকপ্রাপ্ত বিশিষ্ট কথাসাহিত্যিক ও কালের কণ্ঠের প্রধান সম্পাদক ইমদাদুল হক মিলন।
অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন ডিবেট ফর ডেমোক্রেসির চেয়ারম্যান হাসান আহমেদ চৌধুরী কিরণ।
ছায়া সংসদের আদলে আয়োজিত এ প্রতিযোগিতায় ঢাকা কলেজ ও ইডেন মহিলা কলেজের নৃ-গোষ্ঠীর বিতার্কিকরা অংশ নেন।
প্রধান অতিথির বক্তব্যে বিশিষ্ট কথাসাহিত্যিক ইমদাদুল হক মিলন বলেন, ভাষা আন্দোলনের শুরু হয়েছিল ১৯৪৮ সালের ১১ মার্চ। জিন্নাহ ঢাকায় এলেন। এসে ঘোষণা করলেন, উর্দু এবং উর্দুই হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা। তখন, বাঙালি কিন্তু সেই মুহূর্তেই প্রতিবাদ করেছিল। তো, যখন ভাষা আন্দোলনকে দমানোর নানা প্রচেষ্টা চলছিল, তখন ১৯৫২ সালে এটি একটি বিরাট আন্দোলনে রূপ নিল। পুলিশ গুলি চালালো, সালাম, রফিক, বরকত শহীদ হলেন। এই হলো মূল ইতিহাস, কিন্তু ভাষা আন্দোলনের চেতনাটা আসলে কোথায়। পৃথিবী থেকে প্রতিদিন একটি ও দুটি করে ভাষা হারিয়ে যাচ্ছে। এটা শুধু বাংলাদেশ নয়, সারা বিশ্বেই হচ্ছে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের একটা গান আছে, ‘এই তো ভালো লেগেছিল আলোর নাচন পাতায় পাতায়’। এগুলি কিন্তু ভাববার বিষয়। একুশের ভাষা আন্দোলনের পরে বাংলাদেশ বুঝে গিয়েছিল যে, পাকিস্তানিদের সঙ্গে থাকা সম্ভব নয়। এর ফলে মুক্তিযুদ্ধের বীজ বপণ হয়। বাংলাদেশের প্রতিটি মানুষের ভাষা, স্বাধীনতা আমরা সমুন্নত রাখব, আমরা এই চেতনায় বিশ্বাস করি।
সভাপতির বক্তব্যে ডিবেট ফর ডেমোক্রেসির চেয়ারম্যান হাসান আহমেদ চৌধুরী কিরণ বলেন, ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়ার দাবির মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল না। একুশের চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে পরবর্তীকালে ১৯৬২ সালের শিক্ষা আন্দোলন, ১৯৬৬ সালের ছয় দফা আন্দোলন, ৬৯’র গণঅভ্যুত্থান, ৭০’র সাধারণ নির্বাচন এবং ৭১’র স্বাধীনতাযুদ্ধে আমরা জয়লাভ করতে পেরেছি। এসব জয়লাভের পেছনে প্রধান অনুগঠক ছিল ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন। এখন প্রশ্ন হচ্ছে আমরা কি ভাষা আন্দোলনের চেতনা লালন করতে পারছি কিনা? এর উত্তর হ্যাঁ এবং না দুটোই। আমরা যখন দেখি দেশে গণমাধ্যমের সংখ্যা বাড়ছে, গণতন্ত্র, সুশাসন শক্তিশালী করার কথা সরকারি নিরোধীসহ সব রাজনৈতিক দল বলছে। বাংলাদেশ উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে, জিডিপির গ্রোথ বাড়ছে, স্বাস্থ্য, শিক্ষা, চিকিৎসা, যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন হচ্ছে। নানাক্ষেত্রে আমরা প্রতিবেশী দেশ ভারত, পাকিস্তান, নেপাল, ভুটানসহ বিভিন্ন দেশ থেকে এগিয়ে রয়েছি। মঙ্গা শব্দটি এখন অতীত। তখন মনে হয় আমরা ভাষা আন্দোলনের চেতনা যথাযথভাবে লালন করছি। কিন্তু আমরা যখন সুশাসন, সামাজিক ন্যায়বিচার, গণতন্ত্র, মত প্রকাশের স্বাধীনতা, সামাজিক সুরক্ষা, দুর্নীতি, মানবাধিকার প্রতিষ্ঠাসহ নানা সূচকে পিছিয়ে থাকি। ধনী-দরিদ্রের বৈষম্য যখন বাড়তেই থাকে, টিসিবির ট্রাকের পেছনে মানুষের দীর্ঘলাইন, জীবিকার তাগিদে অনিরাপদ অভিবাসন তখন মনে হয় আমরা ভাষা আন্দোলনের চেতনা লালন করতে পারছি না।
তিনি বলেন, আজকের বিতর্ক প্রতিযোগিতায় ঢাকা কলেজ ও ইডেন মহিলা কলেজের নৃ-গোষ্ঠীর ১০ জন বিতার্কিক অংশ নিয়েছেন। তারা কিন্তু তাদের বক্তব্য বাংলা ভাষায় উপস্থাপন করছেন। বাংলা ভাষার প্রতি তাদের শ্রদ্ধা এবং আবেগের কথা জানিয়েছেন। কিন্তু বাংলা ছাড়াও বাংলাদেশে ৭৫টি জাতির ৪০টি ভাষার প্রায় ৩০ লাখ আদিবাসী মানুষ রয়েছে। এই ৪০টি ভাষার মধ্যে বাংলাসহ ৮টি ভাষার বর্ণমালা আছে। দেশে ৪৯টি ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী থাকলেও কয়েকটি নৃ-গোষ্ঠী বিলীন হয়ে যাওয়ার আশংকা তৈরি হয়েছে। ছোট হয়ে যাওয়া কয়েকটি নৃ-গোষ্ঠী চাকমা মারমাসহ অন্যান্যদের সাথে মিশে যাচ্ছে। আদিবাসীদের ১৪টি ভাষা আজ বিপন্ন হতে যাচ্ছে। আরও ১১টি ভাষা বিপন্ন হওয়ার পথে। চা-বাগানে অবস্থানরত কত জন কন্দ ভাষায় কথা বলে আমরা জানি না। সৌর ভাষায় কথা বলে একজন। খাড়িয়া ভাষাটি পুরোপুরি জানে দুইজন। আটজন প্রবীণ ব্যক্তি জানেন রেং মিটচা ভাষা। এদের মৃত্যু হলে এসব ভাষাগুলোর মৃত্যু হবে। তাই বাংলা ভাষার পাশাপাশি আদিবাসী ভাষার প্রতি আরও বেশি যত্ন নিতে হবে।
প্রতিযোগিতার বিচারক ছিলেন অধ্যাপক আবু মুহাম্মদ রইস, উপসচিব মো. আবদুল হাই, সাংবাদিক জাহানারা পারভীন ও সাংবাদিক পার্থ সঞ্জয়।
প্রতিযোগিতা শেষে চ্যাম্পিয়ন ও রানার্সআপ দলের মাঝে ট্রফি ও সনদপত্র ও বই বিতরণ করা হয়।
বাংলাদেশ সময়: ১৫৫৫ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ২৫, ২০২৩
এমকে/এএটি