ঢাকা, সোমবার, ৮ পৌষ ১৪৩১, ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ২০ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

জাতীয়

শিবপুর উপজেলা চেয়ারম্যানকে গুলির নেপথ্যে দুই কারণ

হুইল চেয়ারেই কাটাতে হবে বাকি জীবন! 

সুজন বর্মণ, ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২১১১ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ২৬, ২০২৩
হুইল চেয়ারেই কাটাতে হবে বাকি জীবন!  নরসিংদীর শিবপুর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান হারুনুর রশিদ খাঁন: ফাইল ফটো

নরসিংদী: নরসিংদীর শিবপুর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি হারুনুর রশিদ খাঁনকে হত্যাচেষ্টার ঘটনায় সন্দেহভাজন চারজনকে আটক করেছে পুলিশ।

পুলিশের দাবি, ঘটনার নেপথ্যে তিন কোটি টাকার হাট ইজারা।

তবে স্বজনদের দাবি, চেয়ারম্যানকে গুলির নেপথ্যে স্থানীয় রাজনীতির বিরোধ। দ্রুত রহস্য উদঘাটন করে অপরাধীদের গ্রেফতারের দাবি জানিয়েছেন সর্বস্তরের মানুষ।

আটককৃতরা হলেন- আরিফ সরকারের বড় ভাই শিবপুর থানার পুটিয়া কামারগাঁও এলাকার মৃত হাফিজ উদ্দিনের ছেলে ফরিদ সরকার (৬৩), সৈয়দনগর এলাকার রোকন উদ্দিনের ছেলে মো. সাব্বির (৩২), পূর্ব সৈয়দ নগর এলাকার আয়েছ আলীর ছেলে মনসুর আহমেদ রানা (৪৩) ও কামারগাঁও এলাকার মৃত সিরাজ মোল্লার ছেলে মোমেন মোল্লা (৫৯)।

আটকের বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন শিবপুর থানার ওসি ফিরোজ তালুকদার। তবে এ ঘটনায় এখনো থানায় কোনো লিখিত অভিযোগ দায়ের করেনি চেয়ারম্যানের পরিবার।

শনিবার (২৫ ফেব্রুয়ারি) সকালে শিবপুর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি হারুনুর রশিদ খাঁনের বাসায় প্রবেশ করে তিনজন। কথা বলা শেষে নিজের কক্ষে প্রবেশের সময় পেছন থেকে ২ রাউন্ড গুলি করে পালিয়ে যায় তারা। ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে হারুনুর রশিদ খাঁনের অস্ত্রোপাচার হয়েছে। ৭২ ঘণ্টার নিবিড় পর্যবেক্ষণে রাখা হয়েছে তাকে।

উপজেলা চেয়ারম্যান হারুনুর রশিদের ভাতিজা রাব্বি খান জানান, তিনি এখন শঙ্কামুক্ত হলেও আর আগের মতো হাঁটতে পারবেন না। চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, সন্ত্রাসীদের ছোড়া দুটি গুলির মধ্যে একটি তার মেরুদণ্ডে বিঁধে তা ছিড়ে গেছে। এ বয়সে এটি আর জোড়া লাগা সম্ভব নয়। যতদিন বেঁচে থাকবেন তিনি ততদিন তাকে হুইল চেয়ারে করে চলাফেরা করতে হবে।

স্বজন ও দলীয় নেতাকর্মীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে দলীয় প্রার্থী ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা হারুনুর রশিদ খাঁনের বিরোধিতা করে স্বতন্ত্র প্রার্থীর হয়ে কাজ করেন স্থানীয় সংসদ সদস্য। এমপির বিরোধিতার পরও হারুনুর রশিদ খাঁন চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। এরপর থেকেই তাদের সম্পর্কেও টানাপোড়েন চলছিল। এরই ধারাবাহিকতায় ২০২১ সালের ৬ ডিসেম্বর উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতির পদ থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয় টানা ২৫ বছর দায়িত্ব পালন করা হারুনুর রশিদ খাঁনকে। এ ঘটনার জন্যও দায়ী করা হয় স্থানীয় সংসদ সদস্য জহিরুল হক ভূইয়া মোহনকে।

গুলিবিদ্ধ উপজেলা চেয়ারম্যানের ভাতিজা নরসিংদী জেলা যুবলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক ইফতেখার উদ্দিন খান নিপুণ বলেন, যাদের মদদে দল থেকে উপজেলা চেয়ারম্যানকে পদ থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছিল তাদের মদদেই হারুনুর রশিদ খাঁনকে হত্যার চেষ্টা করা হয়েছে। যাদের নাম আলোচনায় আসছে তারা হলো ভাড়াটিয়া সন্ত্রাসী। তারা অর্থের বিনিময়ে কার নির্দেশ বাস্তবায়ন করেছে। চাচার তুমুল জনপ্রিয়তাই ঈর্ষান্বিত হয়ে তারা ওনার বড় ভাই কিরণ খাঁনের মতো ওনাকেও হত্যা করতে চেয়েছে।

তবে পুলিশের বিভিন্ন সূত্র জানায়, উপজেলা চেয়ারম্যানকে গুলি করার ঘটনায় সিসি টিভির ফুটেজ ও প্রত্যক্ষদর্শীর বর্ণনায় এরই মধ্যে তিনজনকে শনাক্ত করেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। পুলিশের দাবি, স্থানীয় হাটের ইজারা নিয়ে বিবাদে শনিবারের এ ঘটনা ঘটে। দেশের অন্যতম বড় গরুর হাট শিবপুরের পুটিয়া চলতি বছর তিন কোটি টাকার ইজারা নিয়ে এ বিরোধের সৃষ্টি হয়েছে।

শিবপুর থানা পুলিশ ঘটনার সন্দেহভাজন চারজনকে আটক করেছে। একইসঙ্গে উদ্ধার করা হয়েছে ঘটনায় ব্যবহৃত মোটরসাইকেল। অপরদিকে ঘটনার মূল অভিযুক্ত আরিফ সরকারসহ দুইজনকে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ আটক করেছে বলে একাধিক সূত্রে খবর পাওয়া গেছে।

শিবপুর মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) ফিরোজ তালুকদার জানান, উপজেলা চেয়ারম্যান হারুনুর রশিদ খানকে গুলির ঘটনায় থানা পুলিশ রোববার (২৬ ফেব্রুয়ারি) দুপুর পর্যন্ত চারজনকে আটক করা হয়েছে। আটককৃতদের দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে পালপাড়া বাজার রোডের পাশের একটি নির্জন বাড়ি থেকে হামলার ঘটনায় ব্যবহৃত মোটরসাইকেল উদ্ধার করা করেছে।  

ওসি আরও জানান, এছাড়া এ ঘটনায় এখন পর্যন্ত থানায় অভিযোগ দায়ের করা হয়নি। আমরা আহত উপজেলা চেয়ারম্যানের সঙ্গে কথা বলেছি, তিনি সুস্থ হয়ে অভিযোগ দায়ের করবেন।

এদিকে প্রবীণ এ রাজনীতিবীদের ওপর সন্ত্রাসী হামলার পর থেকে পুরো জেলা জুড়ে থম থমে অবস্থা বিরাজ করছে। সরকারদলীয় নেতাকর্মীসহ সুশীল সমাজের লোকজনের মধ্যে চাপা ক্ষোভ বিরাজ করছে।
 
নেতাকর্মীরা জানান, শিবপুরে অস্ত্রের মহড়া নতুন নয়। গত বছরের ২২ এপ্রিল ইটাখোলা স্থানীয় সংসদ সদস্যের অফিসে এক সালিশ দরবারে প্রকাশ্যে অস্ত্র প্রদর্শন করা হয়। গত বছরের ৬ নভেম্বর শিবপুর উপজেলা সাব-রেজিস্টার অফিসের উত্তর পাশে প্রকাশ্যে অস্ত্রের মহড়া দেয় সন্ত্রাসীরা। চলতি বছরের ২৬ জানুয়ারি শিবপুর বাসস্ট্যান্ডে দুই পক্ষের মধ্যে ধাওয়া পাল্টা ধাওয়ার ঘটনায় ফাঁকা গুলি ছুড়ে সন্ত্রাসীরা। এর ৪ দিন পর ৩১ জানুয়ারি সদর রোডে অস্ত্রের মহড়া দেয় সন্ত্রাসীরা। এরই ধারাবাহিকতায় সর্বশেষ শনিবার (২৫ ফেব্রুয়ারি) সকালে উপজেলা চেয়ারম্যানকে গুলি করে দুর্বৃত্তরা।

একের পর এক অস্ত্রের মহড়া হলেও কার্যকর ব্যবস্থা নেয়নি থানা পুলিশ এমন অভিযোগ করেন শ্রমিক লীগ নেতা আখিল মৃধা। তিনি বলেন, প্রশাসন যদি আগের ঘটনাগুলোর যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করতো তাহলে উপজেলা চেয়ারম্যানকে গুলির ঘটনা ঘটতো না। সন্ত্রাসীদের যারা পৃষ্টপোষকতা করে আসছে তাদের মদদেই উপজেলা চেয়ারম্যানকে হত্যার চেষ্টা করা হয়েছে।

শিবপুর উপজেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক ফরহাদ আলম ভূইয়া বলেন, হারুনুর রশিদ খাঁনকে হত্যাচেষ্টার ঘটনায় আমরা আতঙ্কিত। আমরা চাই এ ঘটনার নেপথ্যের কুশীলবদের চেহারা উন্মোচিত হোক।

জেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি ও সাবেক এমপি সিরাজুল ইসলাম দুঃখ প্রকাশ করে বলেন, দল ক্ষমতায় অথচ আমরা গুলিবিদ্ধ হই। শিবপুর থেকে চিরতরে এ অপরাজনীতি দূর করতে সবাইকে ঐক্যবদ্ধ থাকার আহ্বান জানিয়ে তিনি আরও বলেন, এ ঘটনা যারা ঘটিয়েছে তা চাঁদের আলোর মতো পরিষ্কার। আমরা চাই পুলিশ তাদের আটক করে আইনের আওতায় আনুক।

শিবপুরের সংসদ সদস্য জহিরুল হক ভূইয়া মোহন বলেন, সন্ত্রাসীর কোনো অন্য পরিচয় থাকতে পারে না। পুটিয়ার আরিফের কোনো দলীয় পদ নেই। গত ৫ বছরেও আমার সঙ্গে তার দেখা হয়নি। সে অপরাধী হলে আমি তার দৃষ্টান্তমূলক বিচার চাই। শিবপুরে হারুন খাঁনের যেখানে নিরাপত্তা নেই, সেখানে আমরা নিরাপদ থাকতে পারি না।

১৯৮৬ সালে উপজেলা চেয়ারম্যানের বড় ভাই আওয়ামী লীগের সাবেক এমপি রবিউল আওয়াল কিরন খানকেও সন্ত্রাসীরা গুলি করে হত্যা করে। দীর্ঘ ৩৭ বছর পরও সে হত্যা মামলার কোনো কিনারা হয়নি।

বাংলাদেশ সময়: ২১১১ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ২৬, ২০২৩
জেএইচ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।