সিলেট: ‘আমায় গেঁথে দাওনা মাগো একটা পলাশ ফুলের মালা, আমি জনম জনম রাখবো ধরে ভাই হারানোর জ্বালা’- দেশমাতৃকার তরে শহীদদের স্মরণে সংগীতের এই কথামালা অশ্রু ঝরায় স্বজনহারাদের।
স্বাধীনের ৫২ বছর বধ্যভূমিতে বিস্মৃতির অতল গহীনে হারিয়ে যেতে বসা শহীদদের সমাধি মিললো অবশেষে।
সিলেট ক্যাডেট কলেজের পেছনের গহীন জঙ্গলে থাকা গণকবরকে সংরক্ষণ করে বাংলাদেশের স্বাধীনতার শহীদ স্মৃতি উদ্যান নামকরণ করা হয়। উদ্যোক্তা ও নির্মাতাদের মধ্যে রয়েছে কর্নেল মোহাম্মদ আব্দুস সালাম বিপি (অব.), ডা. জিয়াউদ্দিন আহমদ। আর সহযোগিতায় রয়েছেন, চৌধুরী, মো. আব্দুল হাফিজ চৌধুরী, ইঞ্জিনিয়ার সালাউদ্দিন আহমেদসহ আরো অনেকে। তাদের সঙ্গে স্মৃতিস্তম্ভ বাস্তবায়ন কমিটিতে রয়েছেন মুক্তিযোদ্ধ গবেষক সাংবাদিক অপূর্ব শর্ম্মা।
শনিবার (৪ মার্চ) বাংলাদেশের স্বাধীনতার শহীদ স্মৃতি উদ্যানের উদ্বোধন করেন শহীদ সিরাজুল আবদালের স্ত্রী সৈয়দা সকিনা আবদাল। লাল ফিতা কেটে স্বামীসহ ৬৬ শহীদের স্মৃতিচিহ্ন উদ্বোধন করেই কান্নায় ভেঙে পড়েন তিনি। স্মৃতি উদ্যান সংরক্ষণ ও নির্মাণের উদ্যোক্তা কর্ণেল আব্দুস সালাম বীর প্রতীক তাকে শান্তনা দেন।
এরপর শহীদ পরিবারের সদস্যরা স্মৃতিচিহ্নে ফুলেল শ্রদ্ধা নিবেদন করে কান্নায় ভেঙে পড়েন। সেখানে এক হৃদয়বিদারক দৃশ্যের অবতারণা ঘটে। কারো বাবা, কারো দাদা-দাদি, চাচাসহ স্বজনদের খুঁজতে এসেছেন সমাধিতে। স্বজনহারাদের আর্তনাদে ভারি হয়ে ওঠে সিলেট ক্যাডেট কালেজের পেছনের অবস্থতিত নতুন করে পরিচয় পাওয়া ‘পরিচয়হীন’ বধ্যভূমি।
সে সময় আবেগঘন বক্তব্য রাখেন শহীদদের স্বজনরা। এই স্থানে এনে হত্যা করা হয় সিলেট মেডিক্যাল কলেজের প্রাক্তণ অধ্যক্ষ লে. কর্নেল এ এফ জীয়াউর রহমান। তার মেয়ে শাহরীন রহমান বলেন, ২৬ মার্চ গৃহবন্দী হলেন। এরপর একাত্তরের ১৪ এপ্রিল তার বাবাকে তুলে নিয়ে যায়। তখন ৫ বছর বয়স। বাবাকে বাসা থেকে ধরে নিয়ে যায় পাক হানাদারেরা। মায়ের কাছ থেকে জানলাম তিনি দেশকে খুব ভালবাসতেন। ৯ এপ্রিল যখন শহীদ ডা. শামসুদ্দিন আহমেদকে হত্যা করা হলো, তখন তিনিই প্রতিবাদ করেছিলেন। বলেছিলেন, সেনা সদস্যদের চিকিৎসা দিতে বারণ করে দিয়েছিলেন। অবস্থা বুঝতে পেরে তার ছাত্ররা তাকে বর্ডার পাস করে দিতে চাইলেও তিনি যাননি। বলেছিলেন, আমি নিমকহারাম না। তখন আমরা ডক্টরর কোয়ার্টারে ছিলাম। তাকে টার্গেট করার মূল কারণ, তখন তিনি বাংলাদেশের পতাকা বাড়িতে ও গাড়িতে ওড়াতেন। মায়ের কাছ থেকে জানা এসব কথা বলতে গিয়ে চোখের জল ছলছল করছিল তার।
তিনি বলেন, যখন তাকে অফিসের কাজের কথা বলে ধরে নিয়ে যাওয়া হয়, তখন বাসার নীচে খেলছিলাম। আমাকে জিজ্ঞেস করেছিল বাবার কথা, দেখিয়ে দিয়েছিলাম দু’তলায় আছেন। তখন যদি জানতাম আমার বাবাকে ধরে নিয়ে মেরে ফেলা হবে, তাহলে কি দেখিয়ে দিতাম। সেই স্মৃতি আমাকে কুঁড়ে কুঁড়ে খায়। ৫২ বছর পর আমি জানলাম কোথায় আমার বাবা ঘুমিয়ে আছেন। মা একটি কথা বলতেন তোমার বাবা ফিরে আসবে। ৫২ বছর পর আমার বাবা ফিরে এসেছে। কিন্তু বাবা নয়, সমাধির মাধ্যমে বাবাকে খুঁজে পেলাম।
এই স্থানে শহীদ হন চা শ্রমিক ঘাটমা উড়াং। আজ তার নাতি গৌরাঙ্গ উড়াং ফুল হাতে এসে দাদার কবরে শ্রদ্ধা নিবেদন করেছেন। তার মতো শহীদ গকুলন্দ চক্রবর্তীর মেয়ে রীনি চক্রবর্তী বাবার স্মৃতি চিহ্নে ফুল দিয়ে মাথা ঠুকরাতে শুরু করেন।
সিলেট চা বাগানের শ্রমিক নরেশ উরাং বলেন, যুদ্ধের সময় তার বয়স ছিল ৮ বছর। তখন তার বাবা ও দুই চাচাকে ধরে নিয়ে হত্যা করে পাকিস্তানীরা। এই গণকবরে তার বাবা দুর্গা উরাং ও এক চাচা ভাদক উরাংয়ের স্মৃতিচিহ্ন পেয়েছেন। তবে আরেক চাচা খাগু উরাংয়ের স্মৃতিচিহ্ন পাননি। তাদের তিনজনকে একসঙ্গে ধরে নিয়ে হত্যা করে পাকিস্তানীরা। আজ সন্ধান পেয়ে ছেলে ও ভাতিজিকে নিয়ে তার হত্যা করার জায়গাটি দেখতে এসেছেন।
শহীদ সিরাজুল আবদালের স্ত্রী সৈয়দা সকিনা আবদাল বলেন, তার স্বামীর কোনো স্মৃতি চিহ্ন ছিল না। বধ্যভূমিতে স্বামীর স্মৃতিচিহ্ন টুকু পরম পাওয়া। তাই স্মৃতি চিহ্ন দেখলেন, কাঁদলেন বলে অনুভূমি ব্যক্ত করেন তিনি।
কাউন্সিলর তাকবীরুল ইসলাম পিন্টু বলেন, স্বাধীনতার জন্য আমাদের শহীদ পরিবারের অনেককে জীবন দিতে হয়েছে। পারিবারিকভাবে আমার দাদা নামকরা ঠিকাদার ছিলেন। যে কারণে আমাদের ৯টি জিপগাড়ি ছিল। আমার চাচা তজমুল আলী গাড়ি দিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের বহন করতেন। সাধারণ মানুষকেও নিরাপদে পৌঁছে দিতেন। যেদিন তাকে ধরে নিয়ে যাওয়া হয়, রেললাইনের পাশে তার গাড়ি লক্ষ্য করে ৩টি গুলি করে পাক হানাদাররা। দুটি গুলি তার পায়ে বিদ্ধ হয়। তাকে রেললাইন দিয়ে রক্তক্ত অবস্থায় টেনে নেওয়া হয়েছিল। ছেলে হারানোর আক্ষেপ নিয়ে ৯০ বছরে তার দাদি মারা গেছেন। কিন্তু ছেলের স্মৃতি চিহ্ন দেখে যেতে পারেননি।
সিলেটের ছড়ারপার এলাকার বাছির মিয়া ও সুবিদবাজারের খাদেন্দ্র সিংহের সন্তানরা বাবার কবর খুঁজে পেয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন। এরকম পরিচয় পাওয়া ৬৬ শহীদের পরিবারের সদস্যরা একাত্তরে সিলেটে গণহত্যার বধ্যভূমিতে খুঁজে পেলেন তার প্রিয়মানুষটির স্মৃতিচিহ্ন।
এদিকে উদ্বোধনের পর কর্নেল মোহাম্মদ আব্দুস সালাম বীর প্রতীকের পরিচালনায় স্মৃতিচারণমূলক অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্য রাখেন, শহীদ সিরাজুল আবদালের স্ত্রী সৈয়দা সাকিনা আবদাল, বিশেষ অতিথির বক্তব্য রাখেন, শহীদ লে. কর্নেল এ এফ জীয়াউর রহমানের মেয়ে শাহরীন রহমান, মেজর জেনারেল (অব.) গোলাম মোর্শেদ, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা রাশেদা কে চৌধুরী, শহীদ ডা. শামসুদ্দিন আহমদের ছেলে ডা. জিয়াউদ্দিন আহমদ প্রমুখ।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা রাশেদা কে চৌধুরী বলেন, শহীদদের মূল্যায়ন করার চেয়ে মনে হচ্ছে নিজেদের ঋণ কিছুটা হলেও পরিশোধ করতে পারলাম আমাদের সূর্য সন্তান শহীদদের কাছে। এটা সবার জন্য অবারিত রাখাসহ তাদের রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতির দাবি জানান তিনি।
উল্লেখ্য, সালুটিকরের এই গণকবরটি বধ্যভূমি হিসেবে জানলেও এতোদিন এটি পড়েছিলো পরিত্যক্ত অবস্থায়। ঘন জঙ্গলে পূর্ণ ছিলো এই টিলা ভূমিতে গণকবরে ছিলো না কোন স্মৃতিচিহ্নও। সেনানিবাসের সংরক্ষিত এলাকায় এই বধ্যভূমির অবস্থান হওয়ায় সাধারণের প্রবেশাধিকারও ছিলো না।
অবশেষে স্বাধীনতার ৫২ বছর পর দুই মুক্তিযোদ্ধার উদ্যোগে এই বধ্যভূমি সংরক্ষণের উদ্যোগ নেওয়া হয়। তাদের উদ্যোগেই এখানে নির্মাণ করা হয়েছে নান্দনিক শহিদ স্মৃতি উদ্যান। শনিবার এই উদ্যানের উদ্বোধন করেন বীর মুক্তিযোদ্ধা ও শহীদ স্বজনরা।
বাংলাদেশ সময়: ১৮৪৫ ঘণ্টা, মার্চ ৪, ২০২৩
এনইউ/এসএ