রাজশাহী: যুগ্মসচিব পদমর্যাদার মো. এনামুল হক রাজশাহী স্থানীয় সরকার বিভাগের পরিচালক হিসেবে কর্মরত আছেন। র্যাব হেফাজতে মৃত সুলতানা জেসমিনকে আটক করা হয়েছিল তার অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে।
এই চক্রের হাতে তিনি দীর্ঘ সময় ধরে হয়রানির শিকার হচ্ছিলেন যুগ্মসচিব এনামুল হক। এমনকি টাকা নিয়ে চাকরি না দেওয়ার একটি মিথ্যা মামালায় তাকে আদালতে গিয়ে জামিন পর্যন্ত নিতে হয়েছে বলে জানিয়েছেন। আর এই চক্রের মূল হোতা আল-আমিন। তাকে গ্রেফতার করা গেলেই সব সত্য সবার সামনে বেরিয়ে আসবে বলে দাবি করেছেন সরকারের উচ্চপদস্থ এই কর্মকর্তা।
যুগ্মসচিব এনামুল হক জানান, তার ফেসবুক আইডি হ্যাকের পরই চাকরি দেওয়ার নামে প্রতারণা শুরু করেন আল-আমিন। এ ব্যাপারে ছন্দা জোয়ার্দার নামে এক নারী প্রতারণার শিকার হয়ে গত বছরের অক্টোবরে ঢাকার মোহাম্মদপুর থানায় মামলা করেন। তবে ওই নারী জানতেন না যে ফেসবুক আইডি ব্যবহারকারী এনামুল হক নন মূলত তিনি হ্যাকার আল-আমিন। তাই যুগ্মসচিব এনামুল হক ভেবেই আল-আমিনের সাথে কথা হয় তার। তাই প্রতারণার স্বীকার ছন্দা জোয়ার্দার এনামুল হককেই আসামি করে ওই মামলা করেন।
এই মামলায় রোমানা ফেরদৌস নামে আরেক নারীকেও আসামি করা হয়। কারণ ওই সময় প্রতারক আল-আমিন রোমানার মাধ্যমে টাকা নিয়েছিলেন এই ছন্দা জোয়ার্দারের কাছ থেকে। রোমানা আল-আমিনের হয়ে ছন্দার কাছ থেকে ৫ লাখ টাকা নিয়েছিলেন। আর সেই একই কৌশলে নওগাঁর জেসমিনকে ব্যবহার করে টাকা সংগ্রহ করছিলেন আল-আমিন। এরপরও ঢাকার ওই মামলায় আদালতে গিয়ে হাজির হয়ে যুগ্মসচিব এনামুল হককে জামিন নিতে হয়েছে। তিনি আদালতকে জানিয়েছেন, তার ফেসবুক আইডি হ্যাক হয়েছে। আর টাকা গ্রহণকারী রোমানাকেও চেনেন না।
এদিকে, সুলতানা জেসমিনকে আটকের পরদিন ২৩ মার্চ তিনি রাজশাহীর রাজপাড়া থানায় মামলা দায়ের করেন। মামলা করতে বিলম্বের কারণ সম্পর্কে তিনি বলেন, র্যাব হেফাজতে নেওয়ার পর সুলতানা জেসমিন অসুস্থ হয়ে পড়েন। তার চিকিৎসার ব্যবস্থা এবং শারীরিক অবস্থা পর্যবেক্ষণ করতে গিয়েই মামলা করতে তার বিলম্ব হয়েছে। আর মামলার এজাহারেও তিনি তাই এই একই কথা উল্লেখ করেছেন।
এনামুল হক মামলার এজাহারে বলেছেন, চাঁদপুরের হাইমচর থানার গাজীবাড়ি এলাকার আল-আমিন (৩২) ও নওগাঁর সুলতানা জেসমিন (৪০) তার নামে ফেসবুক আইডি খুলে এতদিন থেকে প্রতারণা করে আসছিলেন। অফিসের উচ্চমান সহকারীর মাধ্যমে গত ২০ মার্চ তিনি বিষয়টি জানতে পারেন।
এরপর তথ্যপ্রযুক্তির সহায়তায় আসামিদের পরিচয় শনাক্ত করতে সক্ষম হন। এরপর ২২ মার্চ অফিসের কাজে নওগাঁর উদ্দেশে রওনা হন। নওগাঁ বাসস্ট্যান্ড এলাকায় র্যাবের টহল দলকে দেখতে পেয়ে তিনি ঘটনা খুলে বলেন। এরপর র্যাব জেসমিনকে আটক করতে যায়। সেদিন ১১টা ৫০ মিনিটে নওগাঁর মুক্তির মোড় থেকে সুলতানা জেসমিন আটক হয়।
কয়েকজন সাক্ষীর উপস্থিতিতে সেখানে জেসমিনকে জিজ্ঞাসাবাদ করে র্যাব। ওই সময় সুলতানা জেসমিন স্বীকার করেন, আল-আমিন নামের এক যুবকের সঙ্গে তিনি যোগসাজশ করে এনামুল হকের নামে ভুয়া ফেসবুক আইডি বানিয়ে চাকরি দেওয়ার নামে প্রতারণা করছেন। আর জিজ্ঞাসাবাদ চলাকালেই সুলতানা জেসমিন অসুস্থবোধ করেন। তখনই তাকে নওগাঁ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করিয়ে স্বজনদের খবর দেওয়া হয়।
তার নামে ফেসবুকে ভুয়া আইডি খুলে প্রতারণা করা হচ্ছিল বলে দাবি করে যুগ্মসচিব এনামুল হক বলেন, এর আগেও এক নারী প্রতারিত হয়ে ঢাকায় তার নামে মামলা করেছিলেন। তবে তখন তার ফেসবুক আইডি হ্যাক করা হয়েছিল। আর গত বছরের শুরুতে তার ফেসবুক আইডিটি হ্যাক হয়েছিল। এ ব্যাপারে সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেছিলেন বলেও দাবি করেন এনামুল হক।
এদিকে সাম্প্রতিক ঘটনার পর রাজশাহীর রাজপাড়া থানায় জেসমিনের বিরুদ্ধে এনামুল হক প্রতারণা ও ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা করেছেন। মামলার এজাহারে তিনি দাবি করেছেন, তার নাম ও ছবি ব্যবহার করে নতুন আইডি খুলে প্রতারণা করা হচ্ছিল। আর যে ব্যক্তি তার ফেসবুক আইডি হ্যাক করে প্রতারণা করেছিলেন, পরে তাকে আল-আমিন হিসেবে শনাক্ত করা হয়। এই আল-আমিন জেসমিনের সঙ্গে তার নামের ওই ভুয়া আইডি থেকেই বন্ধুত্ব গড়ে তোলেন। স্থানীয় সরকারের বিভাগীয় পরিচালক পরিচয় দিয়ে ‘ব্যক্তিগত’ সম্পর্ক গড়ে তোলেন তিনি। মেসেঞ্জারের দুজনের কথোপকথনে বিষয়টিও র্যাবের মাধ্যমে তিনি নিশ্চিত হয়েছেন।
এনামুল হকের দাবি, এই আল-আমিনই তার পরিচয় ব্যবহার করে সবার সঙ্গে প্রতারণার ফাঁদ পাতেন। চাকরির প্রলোভন দেখিয়ে টাকা হাতিয়ে নিতে শুরু করেন। এই কাজের কৌশল হিসেবে আল-আমিন নিজে টাকা না নিয়ে জেসমিনের ব্যাংক অ্যাকাউন্টে নিতেন। জেসমিন এই টাকা তুলে মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে আল-আমিনের কাছে পাঠিয়ে দিতেন। এই সবকিছুরই প্রমাণ পাওয়া গেছে।
তবে জেসমিনও প্রথম দিকে জানতেন না যে ‘যুগ্মসচিব এনামুল হক’ নামে তার সাথে যার কথা হয় মূলত তিনি হ্যাকার আল-আমিন। তাই এক অর্থে তিনিও প্রতারিত হন। পরে আল-আমিন নিজেই একপর্যায়ে জেসমিনকে জানিয়ে দেন যে, তিনি আসলে এনামুল হক নন, একজন হ্যাকার। আর তার নাম আল-আমিন। কিন্তু তার সাথে এতদূর জড়িয়ে যাওয়ার পর জেসমিন আর এই প্রতারকের কাছ থেকে সরে আসার পথ পাননি। জেসমিনের ব্যাংক হিসাব পর্যবেক্ষণ করে দেখা গেছে, এতে ১৯ লাখ টাকার অস্বাভাবিক লেনদেন হয়েছে। আর এই টাকা সেই হ্যাকার আল-আমিনের কাছেই গেছে। বর্তমানে হ্যাকার ও প্রতারক আল-আমিনকে খুঁজছে র্যাব। আল-আমিন গ্রেফতার হলেই পুরো বিষয়টি খোলসা হয়ে যাবে বলে মনে করেন যুগ্মসচিব এনামুল হক।
আরও পড়ুন:
সুলতানার সুরতহাল রিপোর্টে আঘাতের চিহ্ন নেই: অ্যাটর্নি জেনারেল
র্যাব হেফাজতে সুলতানার মৃত্যু: নথি অ্যাটর্নি জেনারেলের কার্যালয়ে
সুলতানার মৃত্যুর বিষয়ে যা বললো র্যাব সদরদপ্তর
বাংলাদেশ সময়: ১৫৩০ ঘণ্টা, মার্চ ২৯, ২০২৩
এসএস/এমজেএফ