ঢাকা: ১৯৭১ সালে গাইবান্ধা সদর এলাকার শান্তি কমিটি এবং রাজাকার বাহিনীর প্রধান সংগঠক ছিলেন আব্দুল জব্বার। তার সঙ্গে হাত মিলিয়ে মো. মোন্তাজ আলী ব্যাপারী ওরফে মমতাজ (৭৬) শান্তি কমিটতে যোগ দেন।
যদিও তৎকালীন সময় (১৯৭১ সাল) জামায়াতে ইসলামীর কেন্দ্রীয় কমিটি কর্তৃক ঘোষিত তালিকা মোতাবেক মো. মোন্তাজ আলী ব্যাপারী ওরফে মমতাজ সংগঠনটির (জামায়াতে ইসলামী) গাইবান্ধা সদরের সক্রিয় সদস্য ছিলেন।
২০০৯ সালে আব্দুর রউফ বাদী হয়ে গাইবান্ধা অধস্তন আদালতে মমতাজসহ ৫ জনের বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলা করেন। পরে ২০১৪ সালে মামলাটি আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুনালে স্থানান্তর করা হয়। বিচারিক প্রক্রিয়া শুরু হলে মমতাজসহ অন্যান্য আসামিরা ২০১৬ সাল পর্যন্ত জামিনে থাকেন। ২০১৬ সালে জামিনের মেয়াদ শেষ হয়ে গেলে এবং পরে জামিনের আবেদন নামঞ্জুর হলে তখন থেকে মমতাজসহ বাকি আসামিরা এলাকা ছেড়ে পালিয়ে যান। এরপর গভীর তদন্তে আসামিদের বিরুদ্ধে আনীত প্রতিটি অভিযোগ প্রসিকিউশনের মাধ্যমে প্রমাণ হলে ২০১৯ সালে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুনাল মমতাজসহ ৫ জন আসামিকে মৃত্যুদণ্ডের রায় দেন।
মো. মোন্তাজ আলী ব্যাপারী ওরফে মমতাজকে শনিবার (২৯ এপ্রিল) রাতে গাজীপুরের কালিয়াকৈর থানাধীন চন্দ্রা এলাকা থেকে আটক করেছে র্যাব-৩। তিনি গাইবান্ধা জেলার সদর থানার নান্দিনা গ্রামের মৃত শমেশ উদ্দিন ব্যাপারীর ছেলে।
রোববার (৩০ এপ্রিল) দুপুরে রাজধানীর টিকাটুলিতে র্যাব-৩ এর কার্যালয়ে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানিয়েছেন ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক (সিও) লে. কর্নেল আরিফ মহিউদ্দিন আহমেদ।
তিনি বলেন, মামলার রায় হওয়ার পর পলাতক অবস্থায় দুই আসামি (আব্দুল জব্বার এবং রঞ্জু মিয়া) মারা গেছেন। ইতোপূর্বে এই মামলার পলাতক আসামি জাছিজার রহমান এবং আব্দুল ওয়াহেদ মন্ডলকে র্যাব আটক করেছে। এরই ধারাবাহিকতায় মামলাটির সর্বশেষ পলাতক আসামি মোন্তাজ আলী ব্যাপারী ওরফে মমতাজকে শনিবার (২৯ এপ্রিল) রাতে আটক করা হয়।
তিনি বলেন, মামলাটির বিচারিক প্রক্রিয়া চলমান থাকাকালীন ২০১৬ সালে মমতাজ তার নিজ এলাকা গাইবান্ধা ছেড়ে পালিয়ে আত্মগোপনে থাকতে শুরু করেন। এরপর তিনি মাঝে মাঝে গোপনে পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে দেখা করতেন। ২০১৬ সাল থেকে মামলার বিচারিক প্রক্রিয়া চলাকালীন তিনি কখনই আদালতে হাজিরা দেননি। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে চলমান মামলার শুনানিতে হাজিরা না দেওয়ায় তার বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি হয়। এর পরপর থেকে তিনি প্রায়ই স্থান পরিবর্তন করে গাজীপুর জেলার কালিয়াকৈরে বড় ছেলে শফিকুল ইসলামের ভাড়া বাসায় আসা যাওয়া করতেন। তার ছেলের ভাড়া বাসা বেশি নিরাপদ ভেবে ২০২২ সালের নভেম্বর মাসের দিকে স্থায়ীভাবে সেখানে বসবাস করতে থাকেন। সেই বাসা থেকেই আটক করা হয় এই যুদ্ধাপরাধীকে।
র্যাব-৩ এর অধিনায়ক বলেন, মমতাজসহ মানবতাবিরোধী যুদ্ধাপরাধের একই মামলার পাঁচ আসামির বিরুদ্ধে প্রসিকিউশনের আনা ১৯৭১ সালে হত্যা, গণহত্যা, অপহরণ, নির্যাতন, লুণ্ঠন, অগ্নিসংযোগ ও ধর্ষণসহ মানবতাবিরোধী অপরাধের ৪টি অভিযোগই সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণ হয়। ১৯৭১ সালে গঠিত জামায়াতে ইসলামীর কেন্দ্রীয় কমিটি কর্তৃক ঘোষিত তালিকা মোতাবেক মমতাজ দলটির গাইবান্ধা সদরের সক্রিয় সদস্য ছিলেন। এই মামলার মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আরেক আসামি আব্দুল জব্বার গাইবান্ধা সদর এলাকার শান্তি কমিটি এবং সশস্ত্র রাজাকার বাহিনীর প্রধান সংগঠক ছিলেন। জব্বারের সঙ্গে যোগসাজশে মমতাজ শান্তি কমিটিতে যোগ দিয়ে এলাকায় লুটপাট ও বিভিন্ন ধরনের নাশকতামূলক কার্যক্রম চালাতেন।
তিনি আরও বলেন, ১৯৭১ সালের ১ জুন সকাল ১০টার দিকে মমতাজ, আব্দুল ওয়াহেদ, জাছিজার রহমান, আব্দুল জব্বার এবং রঞ্জু মিয়াসহ হেলাল পাকআর্মি ক্যাম্প থেকে একদল সেনা ও রাজাকারের সমন্বয়ে ২০/২৫ জনের একটি দল নিয়ে গাইবান্ধা সদর থানার বিষ্ণুপুর গ্রামে হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর পূর্ব পরিকল্পিত এবং উদ্দেশ্য প্রণোদিতভাবে হামলা চালায়। অম্বিকাচরণ সরকার এবং আব্দুর রউফের বাড়িতে পূর্ব শত্রুতার জের ধরে মমতাজ এবং তার সহযোগী ওয়াহেদ, জাছিজারসহ অন্যান্য কয়েকজন হামলা ও ব্যাপক লুটপাট চালায়। একপর্যায়ে তারা অম্বিকাচরণকে মুখ, মাথাসহ সারা শরীরে বাঁশ দিয়ে বেধড়ক মারপিট করে। আঘাতের ফলে অম্বিকাচরনকে তারা মৃত মনে করে ফেলে রেখে লুটপাটকৃত মালামাল নিয়ে স্থান ত্যাগ করে। এরপর রাজাকার ও পাকহানাদার বাহিনীর সঙ্গে মিলে মমতাজ এবং এই মামলার বাকি আসামিরা একই গ্রামের দিজেশচন্দ্র সরকারের বাড়িতে হামলা ও ব্যাপক লুটপাট করে। এছাড়াও ফুলকুমারী রাণী এবং সন্ধ্যা রাণীকে পাশবিক নির্যাতনপূর্বক জোর করে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করায়। এই ঘটনায় ওই বাড়ির মালিক দ্বিজেশচন্দ্র বাধা দিলে তারা তাকে গাইবান্ধা আর্মি ক্যাম্পে নিয়ে অমানবিক নির্যাতন ও হত্যা করে মরদেহ গুম করে দেয়। এছাড়াও তারা ওই এলাকার অসংখ্য বাড়িতে লুটপাট, অগ্নিসংযোগ, ধর্ষণ, অপহরণসহ বিভিন্নভাবে নির্যাতন চালিয়ে পরিবারগুলোকে দেশ ত্যাগ করে ভারতে চলে যেতে বাধ্য করে।
১৯৭১ সালের ১৮ অক্টোবর সকাল ৮টার দিকে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর একটি দলকে সঙ্গে নিয়ে মমতাজ, রঞ্জু, জব্বার, জাছিজার ও ওয়াহেদ মিলে গাইবান্ধা সদরের নান্দিনা গ্রামে সশস্ত্র হামলা চালায়। সেই হামলায় তারা ওই গ্রামের আবু বক্কর, তারা আকন্দ, আনছার আলী এবং নছিম উদ্দিন আকন্দকে সারি বেঁধে দাঁড় করিয়ে গুলি করে হত্যা করে। ওই সময় আসামিদের নেতৃত্বে একই গ্রামের সামাদ মোল্লা, শাদা মিয়া, ফরস উদ্দিন ও সেকান্দার আলী মোল্লাকে বাড়ির সামনেই গুলি করে হত্যা করা হয়। পাশাপাশি সেই দিনে মমতাজের নেতৃত্বে তারা ৪০ টিরও বেশি বাড়িঘরে ব্যাপক লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ করে।
একই দিনে তারা ২৫ জন সশস্ত্র রাজাকার ও ৩০ জন পাকিস্তানি সেনা নিয়ে পাশের দৌলতপুর গ্রামে হামলা চালিয়ে লাল মিয়া বেপারী, আব্দুল বাকী, খলিলুল রহমান, দুলাল মিয়া, মহেশ চন্দ্র মন্ডলকে নৃশংসভাবে পিটিয়ে ও গুলি করে হত্যা করে। এছাড়াও গাইবান্ধা সদর এলাকায় অবস্থিত বেশ কয়েকটি গ্রামে (নান্দিনা, মিরপুর, সাহারবাজার, কাশদহ, বিসিক শিল্প নগরী, ভবানীপুর ও চকগায়েশপুর) সশস্ত্র হামলা চালিয়ে নিরস্ত্র মুক্তিযোদ্ধা ওমর ফারুক, ইসলাম উদ্দিন এবং নবীর হোসেনসহ মোট ৭ জনকে গুলি করে হত্যা করে।
গ্রেফতার আসামির বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা প্রক্রিয়াধীন রয়েছে বলেও জানান এই র্যাব কর্মকর্তা।
বাংলাদেশ সময়: ১৫৩১ ঘণ্টা, এপ্রিল ৩০, ২০২৩
এসজেএ/এমএমজেড