চাঁপাইনবাবগঞ্জ: চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জ উপজেলার বিনোদপুর ইউনিয়নের ছোট্ট একটি গ্রাম চাঁদশিকারী। মাত্র অর্ধ কিলোমিটার দূরেই বিনোদপুর বাজার।
এ গ্রামে চাঁদশিকারী মহল্লার বৃদ্ধা সোনাভানের বাস। দেশের স্বাধীনতার পক্ষে কথা বলায় স্বামী সন্তানসহ তার পরিবারের আট সদস্যকে পাক বাহিনীর হাতে হত্যার শিকার হতে হয়েছিল।
তারা সকালে ঘুম থেকে ওঠে একটু খাবার পর্যন্ত খেতে দেওয়া হয়নি। পানি চাইতে গেলেও পানি পান করতে দেয়নি ঘাতকরা। সকাল ৭টার দিকে দরজা ভেঙে চোরের মতো দড়ি দিয়ে বেঁধে পেটাতে পেটাতে নিয়ে যায় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী। আর তাদের সহযোগী আলবদরদের মুখে ছিল উচ্ছ্বাস। এভাবেই বিছানায় শুয়ে শুয়ে কথাগুলো বলছিলেন শহীদ আরিফুল ইসলামের মা সোনাভান বেগম (৮৭)।
কান্নাজড়িত কণ্ঠে তিনি বলেন, বিচার পেলাম ঠিকই। কিন্তু আমরাতো শহিদ পরিবারের সম্মান টুকু পেলাম না। আমার ছেলেটা ৭দিন ভারতে ট্রেনিং করার পর বাড়ি এসে শহীদ হলেও বীর মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি টাও পেল না। মরার আগে যদি এ সম্মানটা পেতাম।
শুধু সোনাভানের পরিবারই নয়। ৬ অক্টোবর ভোরে রাজাকার ও আলবদরদের সহায়তায় পাকিস্তানি বাহিনী আশেপাশের ৫ গ্রামের ৩৫ জনকে ধরে নিয়ে যায় বিনোদপুর উচ্চ বিদ্যালয়ে। পরে সেখানে বিদ্যালয়ের মাঠে সারিবদ্ধভাবে দাঁড় করিয়ে প্রকাশ্যে হত্যা করা হয় তাদের। তাদের অপরাধ পরিবারের কেউ না কেউ মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছে।
শহীদ আরিফুলের ছোট ভাই ও শহীদ আরিফুল স্মৃতি ফাউন্ডেশনের পরিচালক এম এ রাকিব জানান, তিনি তখন তৃতীয় শ্রেণির ছাত্র। বাবা ফজলুল হকসহ আটজনকে ধরে নেওয়ার পরপরই মা সোনাভান তাকে বাড়ির নারীদের সঙ্গে একটি পরিত্যক্ত ঘরে জোর করে ঢুকিয়ে দিয়ে তালাবদ্ধ করে রাখায় প্রাণে বেঁচে যান। তখন থেকেই তার ইচ্ছা তিনি বড় হয়ে এ গণহত্যার বিচার চাইবেন।
আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় থাকায় ২০১৩ সালে আন্তর্জাতিক ক্রাইম ট্রাইব্যুন্যালে (আইসিটি) এ গণহত্যার বিচার চেয়ে আবেদন করলে ২০১৪ সালে আদালতের নির্দেশে একটি তদন্ত কমিটি সরেজমিনে এসে ঘটনার সত্যতা পায়। পরে ২০১৫ সালে সাক্ষ্য প্রমাণের ভিত্তিতে মনাকষা ইউনিয়নের দাদনচক গ্রামের মাহিদুর রহমান রাজাকার ও একই ইউনিয়নের সাতরশিয়া গ্রামের চুটু রাজাকারকে দোষী সাব্যস্ত করে আমৃত্যু কারাদণ্ডের আদেশ দেন আদালত। পরে তারা কারাগারে মারা যান।
তিনি আক্ষেপ করে বলেন, বিচারে কিছুটা স্বস্তি এলেও তার ও অন্যান্য পরিবারগুলো আজও শহীদ পরিবারের মর্যাদা না পাওয়ায় মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের এ সরকারের প্রতি আক্ষেপ থেকেই গেল। তার বড় ভাই শহীদ আরিফুল ইসলাম সাত দিনের প্রশিক্ষণ শেষে অসুস্থতার কারণে বাড়ি ফিরে এসে শহীদ হলেও তার ভাই বীর মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি টুকু পাননি। যারা তার ভাইয়ের সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধের প্রশিক্ষণ নিয়েছে তাদের সাক্ষ্য থাকার পরও মুক্তিবার্তায় নাম না থাকায় তারা বীর মুক্তিযোদ্ধার পরিবারের বা শহীদ পরিবারের স্বীকৃতি না পাওয়ার আক্ষেপ আজীবন থেকেই যাবে।
বিনোদপুর ইউনিয়ন মুক্তিযোদ্ধা সাবেক কমান্ডার মসিউর রহমান জানান, বীর মুক্তিযোদ্ধা ও সাবেক সংসদ সদস্য ডা. মঈন উদ্দিন আহম্মেদের নেতৃত্বে বিনোদপুর স্কুলে মুক্তিযোদ্ধাদের একটি ক্যাম্প গঠিত হয়েছিল। এখান থেকেই পার্শ্ববর্তী মনাকষা, শ্যামপুর, কানসাটসহ কয়েকটি ইউনিয়নে বী মুক্তিযোদ্ধারা যুদ্ধে যেতেন। আবার যারা যুদ্ধে যেতে আগ্রহী তাদের নিয়ে এসে এখান থেকেই ভারতে প্রশিক্ষণে পাঠানো হতো। তাই বিষয়টি এলাকার রাজাকার ও আলবদররা পাক বাহিনীকে জানিয়ে দিলে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ক্যাম্পটিতে অভিযানে আসে। তবে বিষয়টি টের পাওয়ার আগেই বীর মুক্তিযোদ্ধারা সরে পড়ায় ক্যাম্পের কোনো মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হননি।
তিনি আরও জানান, এ ক্যাম্পে কোনো সময় ১০ জন আবার কোনো কোনো সময় শতাধিক মুক্তিযোদ্ধাও অবস্থান করতেন।
অবসর প্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা আলতাফ হোসেন জানান, তার চাচাতো ভাইসহ চাঁনশিকারী, লছমনপুর, এরাদত বিশ্বাসের টোলা, কবিরাজটোলা গ্রামের ৩৫ জনকে নৃশংসভাবে হত্যা করে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী। আর এতে সহায়তা করে দণ্ডপ্রাপ্ত মাহিদুর ও চুটু রাজাকারসহ মৃত আলবদর মোয়াজ্জেম, মৃত গফু রাজাকার, মৃত কুতুব রাজাকার, দেনা রাজাকার এবং এলাকার কয়েকজন।
আওয়ামী লীগ নেতা ও সত্রাজিতপুর আলাবক্স কলেজের সহকারী অধ্যাপক সাদিকুল ইসলাম পুটু জানান, যুদ্ধ পরবর্তী সময়ে মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের ও আওয়ামী লীগের গ্রাম বিনোদপুর হওয়ার পর শান্তি কমিটির প্রধান মৃত হাবিবুর রহমানসহ স্বাধীনতার বিরোধীরা চেয়ারম্যান ও মেম্বার হয়ে দাপটের সঙ্গে এলাকায় বাস করেছেন। স্বাধীনতার পর দ্রুত বিচারকাজ সম্পন্ন হলে তাদের সবাইকে বিচারের আওতায় আনা যেত। সে সঙ্গে দেনা রাজাকার আওয়ামী লীগের একটি অংশের সঙ্গে মিশে মেম্বার হওয়ার সুযোগ পাওয়ায় তাকে প্রায় পীড়া দেয়।
তবে মনাকষা ইউনিয়নের বাসিন্দা ও শিবগঞ্জ উপজেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক তৌহিদুল ইসলাম টিয়া দাবি করেন, কিছু সময়ের জন্য দেনা রাজাকার আওয়ামী লীগের একটি অংশের সঙ্গে মেশার চেষ্টা করলেও সফল হয়নি। একসময় সে অর্থ সম্পদ বানালেও এখন অনেকটা নিঃস্ব এবং কিছুটা মানসিক ভারসাম্যহীন।
এ ব্যাপারে চাঁপাইনবাবগঞ্জ-১ (শিবগঞ্জ) আসনের সংসদ সদস্য ও মুক্তিযোদ্ধা সন্তান কমান্ড কাউন্সিলের জেলা আহ্বায়ক ডা. সামিল উদ্দিন আহম্মেদ শিমুল জানান, তার পিতা প্রয়াত বীরমুক্তিযোদ্ধা মঈন উদ্দিনের স্বপ্ন ছিল যাদের সহায়তায় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী তার এলাকায় যে হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছিল তাদের বিচারের মুখোমুখি করা। কিন্তু নানা প্রতিকূলতার কারণে তিনি তা দেখে যেতে না পারলেও দেরিতে হলেও দুই রাজাকারের বিচার হওয়ায় তিনি খুশি। তবে শহীদ পরিবারগুলো যেন দ্রুত স্বীকৃতি পায়, সে চেষ্টা তার অব্যাহত থাকবে। আর প্রতিবছরের ন্যায় এ বছরও যথাযোগ্য মর্যাদায় বিনোদপুরে গণহত্যা দিবস পালিত হবে।
দিবসটি উপলক্ষে বিনোদপুর ইউনিয়ন মুক্তিযোদ্ধা ইউনিটের উদ্যোগে শোক শোভাযাত্রা শহীদদের স্মরণে শহীদ মিনারে পুষ্পস্তবক অর্পণ শেষে বিনোদপুর উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে স্মরণ সভা অনুষ্ঠিত হবে।
বাংলাদেশ সময়: ১৭০০ ঘণ্টা, অক্টোবর ৬, ২০২৩
এসএম