ঢাকা, রবিবার, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১, ২৮ এপ্রিল ২০২৪, ১৮ শাওয়াল ১৪৪৫

জাতীয়

হরতাল-অবরোধে সঞ্চয় ভেঙে চলছে সংসার

এস এম এ কালাম, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৭৫৪ ঘণ্টা, নভেম্বর ২০, ২০২৩
হরতাল-অবরোধে সঞ্চয় ভেঙে চলছে সংসার ছবি: রাজীন চৌধুরী

ঢাকা: করোনা মহামারির ধকল সামলে বিশ্ব অর্থনীতি স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসার পথেই ছিল। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ বিশ্বের অর্থনৈতিক পরিস্থিতিকে আবারো গভীর সংকট ও চাপের মধ্যে ফেলে দেয়।

এ যুদ্ধের কারণে জ্বালানি তেল ও ডলার সংকটে বিশ্ব অর্থনীতি ফের চাপে পড়ে।

বিশ্ব অর্থনীতির এ চাপ বাংলাদেশের অর্থনীতিতেও পড়েছিল। এতকিছুর পরও দেশের অর্থনীতি যখন স্থিতিশীলতার পথে হাঁটতে শুরু করে। তবে রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে সেই অর্থনীতি আবারো চাপে পড়ার শঙ্কা তৈরি হয়েছে।  

বিএনপিসহ বেশ কয়েকটি দলের ডাকা হরতাল-অবরোধে সবচেয়ে বিপাকে পড়েছে খেটে খাওয়া মানুষ। উচ্চ মূল্যস্ফীতিতে চরম সংকটে পড়েছে সীমিত আয়ের মানুষও। হরতালসহ টানা অবরোধের কারণে কাজ বন্ধ থাকায় সঞ্চয় ভেঙে চলছে নিম্নবিত্তের সংসার।  

শেওড়াপাড়া বাসস্ট্যান্ডের পাশে অবস্থিত ফ্রেন্ডস গিফট কর্নারের স্বত্বাধিকারী কবির হোসেন বাংলানিউজকে বলেন, দ্রব্যমূল্য অস্বাভাবিক বাড়ার পরও কোনোভাবে দুবেলা খেয়ে জীবন চলছিল। কিন্তু হরতাল-অবরোধের কারণে বিক্রি একেবারেই নেই বললেই চলে। দিনের শুরুটাও করতে পারিনি।

তিনি বাংলানিউজকে বলেন,  প্রতিদিন সমবায় সমিতিতে কিছু কিছু করে টাকা জমা রাখতাম। কিন্তু শেষ পর্যন্ত এটা ভেঙে ফেলতে হলো। বেচাকেনা না থাকায় সঞ্চয় ভেঙে দোকান ও বাড়িভাড়া পরিশোধ করতে হয়েছে। আয়ের অবস্থা একেবারেই খারাপ। এভাবে চলতে থাকলে আগামীতে ঋণের তলে পড়তে হবে। পরিবার নিয়ে বেঁচে থাকাটা আমাদের জন্য কষ্টের হয়ে যাবে।

রাজনীতির আগুনের তাপ দেশের অর্থনীতিতেও লাগছে। অবরোধ ও হরতালে পরিবহনে আগুন দেওয়ায় ক্ষতির শিকার হচ্ছেন ব্যবসায়ী ও পরিবহন শ্রমিকরা। কৃষি, পোশাক ও উৎপাদন শিল্পসহ অন্য খাতগুলোর ক্ষতি দিন দিন বাড়ছে। বিশেষ করে পরিবহন খাতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতির মুখে পড়েছেন দিন এনে দিন খাওয়া শ্রমিকেরা। দূরপাল্লার যান চলাচল না থাকায় হাজার হাজার পরিবহন শ্রমিক বেকার হয়ে পড়েছেন। পুঁজি শেষ হয়ে যাওয়ায় ধার-দেনা করেও সংসার চলছে না তাদের।  

মিরপুর গাবতলী বাসস্ট্যান্ডের গোল্ডেন লাইনের কাউন্টার মাস্টার হাফিজুর রহমান বলেন, অবরোধের কারণে সপ্তাহের সাত দিনের মধ্যে তিন দিন ডিউটি করছি। তিনদিনের ডিউটিও অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়ে গেছে। দূরপাল্লার যাত্রী কমে যাওয়ায় আমাদের ডিউটি ভাগাভাগি হচ্ছে। অনেক সময় তিন দিনও ডিউটি থাকছে না ।

তিনি বাংলানিউজকে বলেন, এখানে আমাদের পরিবহনের ছয়টি কাউন্টার থাকলেও পাঁচটি বন্ধ রয়েছে। অবরোধে একটি কাউন্টার খোলা রয়েছে। আমরা বেশ কয়েকজন ভাগাভাগি করে কাজ করি। শুধু তাই নয়, আমাদের ৪০টি বাসের মধ্যে অর্ধেক বাস এখানে আটকা পড়েছে।

তিনি আরও বলেন, বাসের সঙ্গে যারা হেলপার ও ড্রাইভার আছেন, তারা অবরোধের সময় মালিকপক্ষ থেকে ২০০ টাকা করে খোরাক পাচ্ছেন। এতে তারা খাবেন, নাকি তাদের পরিবারকে খাওয়াবেন? আর মালিকপক্ষকে বা কতটুকু দেবেন? এখন সবারই তো আয় বন্ধ হয়ে গেছে। দারুণ কষ্টের মধ্যে দিন চলছে ।

গাবতলী টার্মিনালে বাস হেলপার আক্তার হোসেনের সঙ্গে কথা হয় এই প্রতিবেদকের। তিনি বাংলানিউজকে বলেন, আমি দূরপাল্লার গাড়িতে হেলপারি করি, এই বাজারে একদিন ইনকাম বন্ধ থাকা মানে চলাই কষ্ট, এর মধ্যে কতদিন হয়ে গেল! কিছু টাকা জমানো ছিল, সেটিও অবরোধের কারণে তাও শেষ হয়ে গেছে। আগামী দিনগুলোতে কীভাবে চলব, জানি না।

বাজারের ঊর্ধ্বগতিতে আয়ের সঙ্গে ব্যয়ের মিল না থাকায় বিপাকে পড়েছে নিম্ন আয়ের মানুষ। বছরজুড়ে আয় না বাড়লেও ব্যয় বেড়েছে কয়েকগুণ। এরপর হরতাল, অবরোধের কারণে সব নিত্যপণ্যের দামও বেড়ে যায়। অবরোধের কারণে কর্মহীন হয়ে পড়া লোকেদের সন্তানের স্কুলের বেতন, বই, খাতা-কলম, যাতায়াত ভাড়াসহ নানা ব্যয় মেটাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে। সঞ্চয় ভেঙেও জীবনের ব্যয় মেটাতে পারছেন না তারা। নিম্নবিত্ত পরিবারগুলোর মধ্যে ঋণ নির্ভরতা বাড়ছে।

সানজিদা বেগম পেশায় গৃহিণী, মেয়ের ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে বেসরকারি ব্যাংকে একটি এফডিআর করেছিলেন। দুই-তিন মাস সঞ্চয়ের টাকা জমা দিলেও দ্রব্যমূল্যের অস্বাভাবিক টানা উত্থানে এবং হরতাল-অবরোধের কারণে স্বামী কর্মহীন হয়ে পড়ায় সংসারের খরচ মেটাতে এফডিআর ভেঙেছেন। ক্যাশ কিছু টাকা জমানো ছিল, তাও শেষের পথে। আগামী দিনগুলোতে ধার-দেনা করে চলতে হবে।

জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে রাজনৈতিক অস্থিরতায় দেশের শিল্পোৎপাদন ও ব্যবসা-বাণিজ্য ব্যাহত হওয়ার আশঙ্কাও করছেন অর্থনীতিবিদরা। তাদের মতে, রাজনৈতিক অস্থিরতা বাড়লে দেশের ব্যবসা-বাণিজ্য তথা সামগ্রিক অর্থনীতিতে সংকট আরও গভীর হবে। ফলে হরতাল-অবরোধের নামে অর্থনৈতিক বিধ্বংসী কর্মকাণ্ড বন্ধ করা না হলে এ মন্দা আরও বাড়ার পাশাপাশি সামগ্রিক অর্থনীতির ক্ষতি পুষিয়ে নেওয়া কঠিন হবে বলে মনে করছেন তারা।

এ বিষয়ে বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ও সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা ড. এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বাংলানিউজকে বলেন, হরতাল বা অবরোধে অর্থনীতিতে প্রভাব পড়তে বাধ্য। এর কারণ হলো রাজনৈতিক সহিংসতা বা অস্থিরতায় পণ্য আমদানি-রপ্তানি ব্যাহত হয়। পণ্য পরিবহন, উৎপাদন ব্যাহত হয়। ফলে কর্মসংস্থান সৃষ্টি কম হয়। এতে নিম্ন আয়ের মানুষের জীবনযাত্রার মান কমে যায়।

তিনি বলেন, এ ধরনের পরিস্থিতিতে মূল্যস্ফীতি বেড়ে যায়। কেননা, অবরোধে সরবরাহ ব্যবস্থা ভেঙে পড়ে। এ ছাড়া দেশে খেলাপি ঋণ ও ব্যাংকে তারল্য সংকট আরও বাড়বে। পাশাপাশি রেমিট্যান্স এবং রপ্তানি আয় উদ্বেগজনক হারে কমবে। এতে ডলার সংকট আরও ভয়াবহ পর্যায়ে পৌঁছাবে। রিজার্ভের পতনে নতুন গতি পাবে, যা সামাল দেওয়া কঠিন হয়ে দাঁড়াবে।

অর্থনীতিবিদরা মনে করেন, হরতাল অবরোধ ও শ্রমিক আন্দোলন চলমান থাকলে বাংলাদেশ থেকে রপ্তানি অর্ডার চলে যেতে পারে। রাজনীতিতে যে অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে এতে করে উদ্যোক্তারা নতুন করে বিনিয়োগ করতে ভয় পাচ্ছেন। এতে করে বেকারত্ব বাড়তে পারে। আমাদের আমদানি-রপ্তানিতে যদি এর প্রভাব পড়ে তাহলে সংকট আরও ঘনীভূত হতে পারে বলে তারা মনে করেন।

বাংলাদেশ সময়: ০৭৪৬ ঘণ্টা, নভেম্বর ২০, ২০২৩
এসএমএকে/আরএইচ/এসএএইচ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।