ঢাকা, সোমবার, ৮ পৌষ ১৪৩১, ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ২০ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

জাতীয়

‘রোমান্স স্ক্যাম’ করে অর্থ হাতিয়ে নেওয়া বেনজির গ্রেপ্তার

স্টাফ করোসপন্ডেট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৭০৫ ঘণ্টা, নভেম্বর ২৭, ২০২৩
‘রোমান্স স্ক্যাম’ করে অর্থ হাতিয়ে নেওয়া বেনজির গ্রেপ্তার

ঢাকা: সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার করে প্রায় অর্ধশত নারীর সঙ্গে রোমান্স করতেন মো. বেনজির হোসেন (৪০)। টার্গেট নারীদের স্বপরিবারে যুক্তরাষ্ট্রে নিয়ে যাওয়ারও স্বপ্নও দেখাতেন।

মূলত এসব ছিল তার স্ক্যাম। ফাঁদ পেতে অর্থ হাতিয়ে নেওয়াই ছিল তার মূল লক্ষ্য।

এমন প্রতারণার অভিযোগে বেনজিরকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশের কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি) ইউনিটের সাইবার ক্রাইম ইনভেস্টিগেশন বিভাগ।

যেভাবে ফাঁদ পাততেন বেনজির
সিটিটিসি বলছে, গ্রেপ্তার বেনজির সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে জৌলুসপূর্ণ প্রোফাইল তৈরি করতেন। তিনি টার্গেট করতেন ‘নিঃসঙ্গ নারীদের’। প্রথমে আলাপ, পরে প্রেমের সম্পর্কে টানতেন। টার্গেট নারী ফাঁদে পড়লে প্রতারণা পর্ব শুরু করতেন তিনি।

বেনজিরের এই ফাঁদ বা প্রতারণার বড় অধ্যায় ছিল বিয়ের প্রলোভন দেখানো। তিনি ভুক্তভোগীদের যুক্তরাষ্ট্র নিয়ে যাওয়ার স্বপ্ন দেখাতেন। এর মাধ্যমে বিপুল অর্থ চাইতেন। ভুক্তভোগীরা টাকা দিলে বেনজির সেটি আত্মসাৎ করতেন। বিশ্বাস তৈরি ও সেটির সুযোগ নিয়ে বছরের পর বছর ধরে বেনজির এ কাজ করে আসছেন। লাখ লাখ টাকা পকেটে পুরেছেন রোমান্স স্ক্যামের এই হোতা।

অবলম্বন করতেন যেসব কৌশল
শাহিদ হাসান নামে আমেরিকা প্রবাসী এক বাংলাদেশি বিমান চালকের প্রোফাইল হুবহু কপি করেন বেনজির। Shahid Hasan (Pilot Officer) নামে ফেসবুক প্রোফাইলটিকে বিশ্বাসযোগ্য করতে তিনি নিয়মিত শাহিদ হাসানের আইডি থেকে বিমান পরিচালনার ছবি ও ভিডিও পোস্ট করতেন। বিভিন্ন গ্রুপ ও পেজ পোস্টকারী নিঃসঙ্গ নারীদের খুঁজে নিতেন তিনি। মেসেঞ্জারে যোগাযোগ করে আলাপ করতেন। কয়েকদিন পর শুরু করতেন রোমান্স।

মেসেঞ্জারের অডিও কলে তিনি টার্গেট নারীদের সঙ্গে কথা বলতেন। কখনও ভিডিও কলে কথা বলতেন না বেনজির। প্রণয়ের মধ্যগগণে ‘বিপদে পড়েছেন’ জানিয়ে ভুক্তভোগীর কাছে অর্থ দাবি করতেন। এ জন্য ব্যবহার করতেন মোবাইল ব্যাংকিং সেবা নগদের নম্বর। বেনজির ব্যবহার করেন এমন ১৯টি নম্বরের খোঁজ পেয়েছে সিটিটিসি।

পুলিশের বিশেষায়িত সংস্থাটি জানিয়েছে, ধাপে ধাপে লাখ লাখ টাকা বিভিন্ন নারীর কাছ থেকে আত্মসাৎ করেছেন বেনজির হোসেন। তার ১৩টি নগদ নম্বরে গত চার মাসে ১ কোটি টাকার বেশি লেনদেনের তথ্য পাওয়া গেছে।

নিজেকে গোপন করে অর্থ উত্তোলন
প্রতারণা করে আদায়কৃত অর্থ বেনজির তুলতেন যশোর ও খুলনা জেলায় বিভিন্ন নগদ ক্যাশ আউট পয়েন্ট থেকে। তার গ্রামের বাড়ি নড়াইল জেলায়। প্রতারণার কাজে ব্যবহৃত সিম ও নগদ নম্বরের রেজিস্ট্রেশনে ব্যবহৃত এনআইডি অন্য ব্যক্তির নামে। তা ছাড়া টাকা উত্তোলনের সময় (ক্যাশ আউট) বেনজির হোসেন পরিচয় ও চেহারা গোপন করার জন্য ক্যাপ, সানগ্লাস ও মাস্ক পরতেন।

যেভাবে আইনের চোখে এলেন বেনজির
স্বপ্না (ছদ্মনাম) নামে এক নারী বেনজিরের প্রেমে পড়েছিলেন। একাকী এ মা (সিঙ্গেল মাদার) প্রয়ে ১ কোটি টাকা দিয়েছেন বেনজিরকে। সিটিটিসি জানিয়েছে, বেনজিরের প্রতারণার স্বীকার হয়ে গত সাত মাসে বিভিন্ন নগদ নম্বরে ১৪/১৫ লাখ করে টাকা দিয়েছেন স্বপ্না।

জান্নাত (ছদ্মনাম) নামে এক নারীও বেনজিরের কাছে প্রায় ১৫ লাখ টাকা খুইয়েছেন। তার (বেনজিরের) স্মার্ট ফোন থেকে ৫০ জনের বেশি ভুক্তভোগীর নম্বর পেয়েছে সিটিটিসি।

স্বপ্না ও জান্নাত গত এক সপ্তাহের মধ্যে ভিন্ন ভিন্ন সময়ে অভিযোগ নিয়ে সিটি সাইবার ক্রাইম ইনভেস্টিগেশন ডিভিশনে প্রতিকারের জন্য এসেছিলেন। সাইবার টেরোরিজম ইনভেস্টিগেশন টিম তাদের মামলা করার পরামর্শ দেয় এবং ছায়া তদন্ত শুরু করে।

স্বপ্না রাজধানীর ওয়ারী থানায় প্রতারণার বিষয়ে গত ২১ নভেম্বর মামলা দায়ের করেন। ২২ নভেম্বর ছায়া তদন্তে নেমে বিশদ প্রযুক্তিগত অ্যানালাইসিসের মাধ্যমে বেনজির হোসেনকে সনাক্ত করে সিটিটিসি। পরে খুলনার ফুলতলায় প্রতারণার কাজে ব্যবহৃত নগদ নম্বর থেকে ক্যাশ আউটের সময় তাকে হাতেনাতে গ্রেপ্তার করে সংস্থাটি।

রোমান্স স্ক্যামার বেনজির হোসেনের সম্পদের পাহাড়
দৃশ্যমান কোনো আয়ের উৎস না থাকলেও বেনজির হোসেন গত কয়েক বছরে প্রতারণার মাধ্যমে আত্মসাৎ করা অর্থ দিয়ে বিপুল অর্থ সম্পদের পাহাড় গড়ে তুলেছেন। করেছেন ৫ বিঘা জমির ওপর বাগান বাড়িতে (দোতলা ডুপ্লেক্স ভবন), অনুমানিক ৩ বিঘা জমির ওপর সম্প্রতি কেনা বিলাসবহুল ভবন, নড়াইলে বিভিন্ন জায়গায় অনুমানিক ২০ বিঘা মাছের খামার, নড়াইলে বিভিন্ন স্থানে নির্মিত ভবন, যশোর ও সাভারসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে বহুতল ভবন ও বিপুল ব্যাংক ব্যালেন্স।

সোমবার (২৭ নভেম্বর) দুপুরে রাজধানীর মিন্টো রোডে ডিএমপির মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানান সিটিটিসির প্রধান অতিরিক্ত কমিশনার মো. আসাদুজ্জামান। তিনি বলেন, বেনজির মেধাবী, এইচএসসি পাস করে একটা চাকরিতে যোগ দিয়েছিলেন। সেখানে চুরির দায়ে চাকরি হারান। তিনি খুবই নিম্নবিত্ত পরিবার থেকে উঠে এসেছেন। তার বাবা ওই অঞ্চলের বিভিন্ন হাট বাজারে তালের শাস বিক্রি করতেন।

বেনজিরের বৈধ কোনো পেশা নেই। তিনি সাধারণত প্রতারণা করেই চলেন। নানা অপরাধের জড়িত বলে তাকে এলাকার লোকজন সন্দেহ করতো, কিন্তু কিছু বলতো না।

আসাদুজ্জামান বলেন, এক ভুক্তভোগীর অভিযোগের ভিত্তিতে আমরা তাকে গ্রেপ্তার করেছি। তার প্রতারণার শিকার অসংখ্য নারী। আমরা ইতোমধ্যে ৫০ জনকে পেয়েছি। বেনজিরের প্রতারণার শিকার হয়ে এক নারী আত্মহত্যাও করেছেন। ভুক্তভোগীদের কাছ থেকে আপত্তিকর ছবিও সংগ্রহ করতেন তিনি। ফলে ভুক্তভোগীরা মানসম্মানের ভয়ে তার ব্যাপারে কিছু প্রকাশ করতেন না।

প্রেমের সম্পর্ক গড়ে বেনজির নিজের অসহায়ত্বের কথা তুলে ধরতেন। যুক্তরাষ্ট্র তার ক্রেডিট কার্ড বন্ধ করে দিয়েছে- গল্প শোনাতেন তিনি। ভুক্তভোগীদের এ কথা বিশ্বাস করিয়ে অর্থ নিতেন। তাদের আমেরিকা নেওয়ার স্বপন দেখাতেন; ভুক্তভোগীদের ভিসার ছবিও দেখাতেন। অভিযোগ দেওয়া দুই নারী জানিয়েছেন, বেনজির তাদের ভিসার কপি দিয়েছিলেন।

গ্রেপ্তার বেনজিরের বিরুদ্ধে বাকি আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে বলেও জানান সিটিটিসির প্রধান অতিরিক্ত কমিশনার মো. আসাদুজ্জামান।

বাংলাদেশ সময়: ১৭০৫ ঘণ্টা, নভেম্বর ২৭, ২০২৩
এসজেএ/এমজে

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।