‘আজ বসন্ত জাগ্রত দ্বারে
তব অকুণ্ঠিত কুণ্ঠিত জীবনে
কোরো না বিড়ম্বিত তারে’
আপনপর ভুলে মুখরিত সংগীতে হৃদয় খুলে বসন্ত বরণের যে আহ্বান জানিয়েছেন কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ; আজ তারই কলতান যেন চারিদিকে। সংগীতের মূর্ছনা, কবিতার আবহ আর নৃত্যের তালে রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে শুরু হয়েছে বসন্তের ঐকতান।
বসন্তের এই নির্মল বাতাসের ছোঁয়া লেগেছে রাজধানীর কেন্দ্রে অবস্থিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েও। প্রতি বছরের মতো এবারও ফাল্গুনের প্রথম দিনে বরণ করে নিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদে আয়োজিত হচ্ছে বসন্ত উৎসব। বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির সহকারী পরিচালক জ্যোতি বন্দ্যোপাধ্যায়ের সেতারে রাগ বসন্ত মুখারী বাদনের মধ্যদিয়ে উৎসবের সূচনা হয়।
এরপর তুরঙ্গমী নৃত্য প্রদর্শন করেন পূঁজা সেনগুপ্ত ও তার দল। এছাড়া শুচি দেবনাথের নজরুল সংগীত, ভাস্বর বন্দ্যোপাধ্যায়ের মোরা জলে স্থলে, বুলবুল ইসলামের একক সংগীত, প্রিয়াঙ্কা প্যারিসের নৃত্য, লাইসা আহমেদ লিসার একক সংগীত, কত্থক নৃত্য সম্প্রদায়ের পরিবেশনা, শামা রহমানের রবীন্দ্র সংগীত, বিমান চন্দ্র বিশ্বাসের একক লোকগান, অন্তর দেওয়ান চাকমার আদিবাসী নৃত্য ও পাহাড়ের রঙ, অনিমা মুক্তি গোমেজের একক গান লোকগানসহ দেশের অগ্রগণ্য শিল্পীদের নানা পরিবেশনা চলে।
বসন্ত কথন পর্ব, প্রীতি বন্ধনী বিনিময়, আবির বিনিময়সহ নানা আয়োজন শেষে হয় আনন্দ শোভাযাত্রা। সকাল ১০টায় শোভাযাত্রাটি চারুকলা থেকে বের হয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি ঘুরে আবার চারুকলায় শেষ হয়।
নৃত্য-গানের কলতানে বসন্তকে বরণ করতে চারুকলায় ভিড় করেছেন উৎসাহীরা। বসন্ত উপলক্ষে নারীরা গায়ে জড়িয়েছেন রঙিন শাড়ি; পুরুষরা পাঞ্জাবি। কেউ কেউ গালে মেখেছেন রঙ, কেউ মাথায় জড়িয়েছেন চন্দ্রমল্লিকা-জিপসি আর গাঁদা ফুলের মুকুট।
বসন্ত উৎসবে এসেছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষার্থী সীমা ইসলাম। তিনি বলেন, উৎসব কেন্দ্রিক বিশ্ববিদ্যালয়ে আসা হয়। ফুল, রঙ, গানে বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি ভিন্নরকম পরিবেশ থাকে। চারুকলার অনুষ্ঠানটি উপভোগ করি।
মায়ের হাত ধরে বসন্ত উৎসবে এসেছেন শিশু নবনীতা। সকাল থেকেই আনন্দে আছে সে। বলেছে, আজ তার মজা লাগছে। অনেক মজা করেছে সকাল থেকে।
গত ত্রিশ বছর থেকে চারুকলায় উৎসবটির আয়োজন করছে ‘জাতীয় বসন্ত উৎসব উদযাপন পরিষদ’। আয়োজনের বিষয়ে জানতে চাইলে পরিষদের সাধারণ সম্পাদক মানজার চৌধুরী সুইট বাংলানিউজকে বলেন, ষড়ঋতুর মধ্যে ঋতুরাজ বসন্ত। এদিন মানুষের মনকে রঙিন করার জন্য রবীন্দ্রনাথ যে উদ্যোগ নিয়েছিলেন, তার হাত ধরে আমরা আয়োজনটি করছি। প্রকৃতি আমাদের বন্ধু। সে আমাদেরকে দেয়। আমরা কিছু দিতে পারি না। বন্ধুত্ব না থাকলে আমাদের ক্ষতির মুখে পড়তে হবে। সেটাও আমরা বোঝাতে চাই।
মানুষের আগ্রহের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, এ বছর অনেক মানুষ এসেছে। একদিনে বইমেলা, সরস্বতী পূঁজা, অন্যদিকে বসন্ত। সবমিলিয়ে মানুষের মনে আনন্দ।
আজ বিকেলেও বিভিন্ন শিল্পীদের পরিবেশনায় মুখরিত থাকবে চারুকলা প্রাঙ্গণ।
বসন্তকে বরণ করে নিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলায় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছে সমগীত সাংস্কৃতিক প্রাঙ্গণ। সেখানে পরিবেশন করবে ‘শিশুদের জন্য আমরা’, নীলা, শায়ান, কৃষ্ণকলি, বাঁধন, সঞ্জীবনী সুধা, মুক্তা পাথর ও আমাদের পাঠশালা।
আয়োজনের বিষয়ে সমগীতের সভাপতি দিনা তাজরীন বলেন, বসন্তকে বরণ করে নিতে আমাদের আয়োজন। আশা করছি সবার মনে আনন্দ ছড়িয়ে যাবে।
এছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বোপার্জিত স্বাধীনতা চত্বরে আবৃত্তি অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছে বাংলাদেশ আবৃত্তি সমম্বয় পরিষদ। ‘ফাগুনে তারুণ্যের আবৃত্তি’ প্রতিপাদ্যকে সামনে নিয়ে এটিও দিনব্যাপী চলবে।
ফুল বিক্রেতাদের হিড়িক
বসন্তকে ঘিরে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন স্থানে দেখা মিলেছে ভ্রাম্যমাণ ফুল বিক্রেতাদের। চন্দ্রিকা চন্দ্রমল্লিকা, গোলাপ, গাঁধা, জিপসি, জারবেরাসহ নানারকম ফুল নিয়ে এই বিক্রেতারা বসেছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন পয়েন্টে। কয়েকরকম ফুলের সমন্বয়ে তৈরি মুকুট হাতে নিয়ে হেঁটে হেঁটে বিক্রি করছেন কেউ।
ফুলের বিক্রি নিয়ে তাদের মাঝে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা যায়।
স্বোপার্জিত স্বাধীনতা চত্বরে ফুলের দোকান নিয়ে বসেছেন নাজমা আক্তার। মিলনচত্বরে বসেছেন আব্দুস সোবহান। তিনি বলেন, আগে যেভাবে বিক্রি করেছি, তা এখন নেই। অন্যান্যবারের তুলনায় বিক্রি কম। মানুষ আছে, কিন্তু কিনছে না।
চারুকলার ফটকে ফুলের ভ্যান নিয়ে বসা জানে আলম বলেন, মোটামুটি বিক্রি হচ্ছে। গতবার থেকে বেশি।
বাংলাদেশ সময়: ১৪৪৫ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ১৪, ২০২৪
এমজে