ঢাকা: সাত বছর ধরে বিদেশে থাকেন স্বামী মোমিনুল ইসলাম। মাসে মাসে টাকা পাঠান স্ত্রীর কাছে।
ঘরের কাজ, জমিজিরাত দেখভাল সবই সারেন সুচারুভাবে। কখনো কোনো সমস্যা হলেই তিনি ভিডিও কল করে স্বামীর সঙ্গে কথা বলে সমস্যার সমাধান করেন।
এ গল্প কুষ্টিয়ার দৌলতপুর উপজেলার ফিলিপনগরের প্রবাসী মোমিনুল ইসলামের স্ত্রী বন্যা মোসাম্মৎ খাতুনের। মোমিনুলের বাবার নাম মহিউদ্দিন খোশবার।
মোমিন সাত বছর আগে এক আত্মীয়ের মাধ্যমে প্রায় সাড়ে চার লাখ টাকা খরচ করে বিদেশে যান। এ যাওয়া অনেকটাই হঠাৎ করে। বিদেশে থাকা আত্মীয় ভিসাটি হঠাৎ করে পান, মোমিনকে নিয়ে যাওয়ার প্রস্তুতি শুরু করেন। হঠাৎ করে যাওয়ার কারণে টাকাটা সংগ্রহ করতে বেগ পেতে হয় মোমিনকে। ব্যাংক বা আত্মীয় স্বজনের কাছে ঋণ সংগ্রহ করতে পারেননি। এ জন্য চড়া সুদে এলাকার মানুষের কাছে ঋণ নিয়ে বিদেশ পাড়ি জমান তিনি।
মোমিনের দুই ছেলে। বড়টি কয়েক বছর আগে থেকে স্কুলে যায়। আরেকটি স্কুলে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে। তাদের পড়াশোনা দেখাশোনা করছেন মোমিনের স্ত্রী বন্যা খাতুন।
বন্যা বলেন, ও (স্বামী) দেশে ব্যবসা করত। ঢাকায় চাকরিও করেছে বেশ কিছুদিন। তার বিদেশে যাওয়ার শখ অনেক দিনের। এ জন্য ব্যবসা বাণিজ্যের পাশাপাশি বিদেশে যাওয়ার জন্য যোগাযোগ রাখত। নানাভাবে খোঁজ-খবরও রাখতে থাকে, পেয়েও যায়। ফুপাত ভাই মালয়েশিয়ায় থাকে। সে একটি ভিসা পাঠায়, তাতেই মালেশিয়ায় পাড়ি জমায়। মোমিন মালয়েশিয়ায় ইলেকট্রিশিয়ানের কাজ করে।
স্বামী বিদেশে যাওয়ার সময় বন্যা গ্রামের একটি সহজ সরল মেয়ে ছিলেন। কিন্তু স্বামী বিদেশে যাওয়ার পর পুরো একটি সংসারের পাকা গৃহকর্ত্রী হয়ে গেছেন তিনি। বন্যা বলেন, স্বামীর পাঠানো টাকা সঠিকভাবে খরচ করা কঠিন কাজ। প্রথম থেকেই একটি অংশ দিয়ে ঋণের টাকার কিস্তি পরিশোধ করতে থাকি। তারপর বাকি টাকা থেকে হিসাব করে সংসার চালানো, ছেলের স্কুলের জন্য খরচের পাশাপাশি বাড়ি তৈরিতে খরচ করতে হয়।
বন্যা বলেন, স্বামী বিদেশে কষ্ট করে দেশে টাকা পাঠায়। এ টাকা যেনতেনভাবে খরচ করতে পারি না। ঋণের সুদ-আসল পরিশোধের পর যখন যেটা বেশি দরকার সেই খরচটা করি। কম দরকারি হলে খরচ করি না। এভাবে সংসারটা সামাল দিচ্ছি।
বিদেশ থেকে স্বামীর পাঠানো টাকা থেকে কোনো সঞ্চয় করা সম্ভব হয়নি। ঋণ পরিশোধের পাশাপাশি বাড়িটা করেছি। একটি ছেলে স্কুলে যায়, আরেকটিও প্রস্তুতি নিচ্ছে। তাদের খরচ, পরিবারের খরচ। সংসারটা ভালোভাবে চলছে, এতে মোমিন খুশি, আমরা সবাই খুশি, বলেন বন্যা খাতুন।
তিনি বলেন, স্বামী বিদেশ যাওয়ার পর সংসারে সচ্ছলতা এসেছে। এলাকাতেও মানুষ আগের চেয়ে বেশি সম্মান করে। মানুষের প্রয়োজনে-অপ্রয়োজনে পাশে দাঁড়াই। অনেকে আবার বলে, বিদেশে চাকরি না করে কী করে? লোকে যাই বলুক, আমরা ভালোই আছি!
বন্যা বলেন, ও বিদেশে থাকলেও প্রতিদিন ভিডিও কলের মাধ্যমে কথা হয়। ছেলের সাথেও কথা বলে। কেমন আছি, সংসারের কী কাজ করতে হবে না হবে, এ ব্যাপারে কথা হয়। সংসারের ভালোমন্দের ব্যাপারে সে নির্দেশনা দেয়। সংসারের প্রয়োজন হলে আমিও ফোন করে নির্দেশনা নিই।
তিনি বলেন, স্বামী বিদেশে থাকার ফলে বাবার অনুপস্থিতি ছেলের ওপর প্রভাব ফেলে। বাবা শাসন যেমন করে আবার আদরও করে। টাকা-পয়সা দিলেও বা প্রতিদিন ভিডিও কলের মাধ্যমে কথা হলেও সশরীরে অনুপস্থিতির ঘাটতিটা থাকেই। তাই ছেলের বাবার অনুপস্থিতির ঘাটতি পূরণ করার চেষ্টা করি। সব দায়িত্ব আমাকেই পালন করতে হয়।
কথাগুলো বলার সময় আত্মবিশ্বাসের পাশাপাশি একাকিত্ব ফুটে ওঠে বন্যার কণ্ঠে। তারপরও সংসার সচ্ছলতা, ছেলের প্রতি দায়িত্ব পালন বন্যা খাতুনের কাছে আরও বেশি গুরুত্বপূর্ণ।
ভিডিও কলে স্বামীর সঙ্গে কথা বলার পাশাপাশি টাকা আনার মাধ্যমও মোবাইল ফোন; মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে টাকা পাঠান স্বামী মোমিন। মাস শেষে মালয়েশিয়া থেকে টাকা পাঠিয়ে দেন মোমিন, ঘণ্টাখানেকের মধ্যে সেই টাকা তুলে ফেলতে পারেন বন্যা খাতুন।
স্বামীর পাঠানো টাকাতে তার সংসারের সুখের পাশাপাশি দেশেরও যে উপকার হচ্ছে, তা জানে না বন্যা। তার বক্তব্য আমার টাকা আমিই তো তুলে নিচ্ছি, এতে সরকারের আবার কী লাভ!
প্রবাসীরা বিদেশ থেকে ডলার পাঠালে বাংলাদেশের ব্যাংকগুলো সেই ডলার রেখে পরিবারের কাছে সমপরিমাণ টাকা দিয়ে দেয়। আর মোমিনের মতো প্রায় কোটি প্রবাসী দেশে ডলার পাঠান। এর সঙ্গে যুক্ত হয় পোশাক ও অন্যান্য পণ্য রপ্তানি করা ডলার। এসব ডলার দিয়ে বিদেশ থেকে জ্বালানি আসে, গাড়ি আসে, খাদ্যপণ্য আসে; আসে দেশের মানুষের আরাম-আয়েশের সব ধরনের উপকরণ।
বাংলাদেশে অর্থকড়ি, সম্পদ-সম্পত্তির হিসাবে প্রবাসী আয় গুরুত্বপূর্ণ। যা বন্যা খাতুনদের স্বামীরা বিদেশ থেকে পাঠাচ্ছেন। চলতি বছরের জুলাই-ফেব্রুয়ারি আট মাসে প্রবাসীরা দেশে পাঠিয়েছেন এক লাখ ৮১ হাজার ৪২৬ কোটি টাকার সমপরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা। আগের বছরে এসেছে প্রায় দুই লাখ ৩৭ হাজার ৭১৪ কোটি টাকা।
অর্থের এই হিসাব ও গুরুত্ব জানার পর চোখের মণি স্থির হয়ে যায় বন্যা খাতুনের; নড়ে চড়ে বসেন তিনি। যে প্রবাসীর স্ত্রী পায় না আপনজনের সান্নিধ্য, যার সন্তান পায় না বাবার আদর-যত্ন, পায় না শাসন; সেই প্রবাসীরা দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে চলেছেন।
বাংলাদেশ সময়: ০৮৩৮ ঘণ্টা, মার্চ ২৯, ২০২৪
জেডএ/এমজেএফ