ঢাকা, সোমবার, ৮ পৌষ ১৪৩১, ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ২০ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

জাতীয়

‘গাঙে না গেলে খাবার জোটে না, তাই ঈদ নিয়ে ভাবনা নেই’

মো. নিজাম উদ্দিন, ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৮১৪ ঘণ্টা, এপ্রিল ১০, ২০২৪
‘গাঙে না গেলে খাবার জোটে না, তাই ঈদ নিয়ে ভাবনা নেই’

লক্ষ্মীপুর: লক্ষ্মীপুরের মেঘনা নদীতে সাধারণ জেলেদের পাশাপাশি কিছু ভাসমান জেলে মাছ শিকার করে।  সদর উপজেলার মজুচৌধুরীর হাটের রহমতখালীর ওপর বসবাস ভাসমান এসব জেলে সম্প্রদায়ের।

স্থানীয়ভাবে এরা ‘মানতা’ সম্প্রদায় হিসেবে পরিচিত। ১২০টি পরিবারের সদস্য সংখ্যা প্রায় পাঁচ শতাধিক।  

বেশিরভাগ পরিবারের বসবাস ছোট্ট ছোট্ট ডিঙি নৌকায়। সেই নৌকা দিয়েই আবার নদীতে জাল ফেলেন তারা। কয়েক সংখ্যক পরিবারের বসতি রহমতখালীর তীরবর্তী টিনশেড ঘরে।  

এদের আয়ের একমাত্র উৎস্য মেঘনা নদীতে মাছ ধরা। মাছ বিক্রি করেই জীবিকা নির্বাহ করা। পরিবারের ছোট্ট সদস্য থেকে শুরু করে নারী-পুরুষ সবার পেশা মাছ শিকার। অন্য কোনো পেশা যেন তারা জানেই না।  

জাটকা ইলিশ সংরক্ষণের লক্ষ্যে লক্ষ্মীপুরের মেঘনায় মার্চ এবং এপ্রিল দুই মাস সকল প্রকার মাছ শিকার নিষিদ্ধ। তাই নদীতে জাল ফেলতে পারে না ভাসমান এ জেলেরা। ফলে তাদের আয়ের উৎস্য এখন একেবারে বন্ধ হয়ে গেছে। এতে কষ্টে দিনাতিপাত করতে হয় তাদের।  

ঠিক এ সময়টাতে চলছে রমজান মাস। আর আসছে পবিত্র ঈদুল ফিতর। তবে অর্থকষ্টে থাকা এসব জেলে পরিবারে নেই ঈদের আনন্দ। তাদের ভাষ্যে, যেখানে ভাত জোটাতেই কষ্ট, সেখানে ভালো খাবারের পাশাপাশি ঈদে নতুন জামাকাপড় কেনা তো অনেকটা বিলাসিতা। সংসার চলে তাদের ধারদেনা আর এনজিও থেকে নেওয়া ঋণের মাধ্যমে। পরিবারের ছোট ছোট শিশুরাও ঈদের আনন্দ উপভোগ করতে পারে না।  

মানতা সম্প্রদায়ের একজন নারী মারজাহান বেগম (৬০)। তিনিও মাছ শিকার করেন। চার ছেলেসহ পরিবারের ৯ সদস্য। সবার পেশা মাছ শিকার। পাঁচটি এনজিও থেকে ঋণ নিয়েছেন তিনি। মাছ শিকার বন্ধ, তাই আয় রোজগারও বন্ধ। কিন্তু ঋণের কিস্তি বন্ধ নেই। কিস্তির টাকা দিতে দেরি হলেও কথা শুনতে হয়। এজন্য মহাজনের কাছ থেকে ‘দাদন’ (আগাম অর্থ) নিয়েই কিস্তি এবং সংসার চালিয়ে নিচ্ছেন তিনি।  

কথা হয় বৃদ্ধ মারজাহান বেগমের সঙ্গে। তিনি বলেন, আমাদের পাতে ঠিকমতো ভাতই জোটে না, আবার কীসের ঈদ। ঈদের দিন বলতে আলাদা কোনো দিন নেই। এ সময়টাতে মাছ শিকার বন্ধ, তাই সব দিনই আমাদের জন্য সমান। এখানকার অনেকেরই একটা মুরগি কেনার সামথ্য নেই। ঠিকমতো কিস্তির টাকা জোগাড় করতে পারি না। সবসময় এনজিও অফিসারের কথা শুনতে হয়। তাই ঈদ নিয়ে আমাদের কোনো চিন্তা নেই। মাছ শিকার করতে পারলেই আমাদের ঈদ।  

ভাসমান জেলে ইউসুফ, রাকিব হোসেন ও সফিক বাংলানিউজকে বলেন, দীর্ঘ দুই মাস মাছ শিকার বন্ধ। এ সময়টা আমাদের খুবই কষ্টে কাটে। আয়-রোজগার একেবারে বন্ধ। আমাদের জন্ম নৌকাতেই। জন্মের পর থেকে একটু বড় হওয়ার পর পরিবারের সঙ্গে মাছ শিকারে নেমে পড়ি। এটা ছাড়া আমাদের অন্য কোনো কাজ জানা নেই। নদীতে অভিযানের সময় ধারদেনা করে সংসার চালাই। গাঙে না গেলে খাবার জোটে না। তাই ঈদ নিয়ে বাড়তি কোনো চিন্তা করতে পারি না।  

তারা আরও বলেন, নদীতে মাছ শিকারে নিষেধাজ্ঞা না থাকলে আয় রোজগার হতো। তখন ছেলে-মেয়েদের নতুন জামা কিনে দিতে পারতাম। এখন সে সামর্থ নেই। ঈদ বলতে আমাদের কিছু নেই।  

মানতা সম্প্রদায়ের দলনেতা সোহরাব মাঝি বাংলানিউজকে বলেন, মানতা সম্প্রদায়ের ১২০টি পরিবারে পাঁচ শতাধিক সদস্য রয়েছে। এদের মধ্যে দেড়শতাধিক শিশু। প্রত্যেক পরিবারের আয়ের উৎস্য নদীতে মাছ শিকার। জাটকা ইলিশ রক্ষায় মেঘনা নদীতে দুই মাস মাছ ধরা বন্ধ রেখেছে সরকার। ফলে আমাদের এখানকার লোকজনের আয়-উপার্জনও বন্ধ। ধারদেনা করে সংসার চালাতেই কষ্ট হচ্ছে। তাই বেশিরভাগ পরিবারের ঈদের কোনো আনন্দ নেই। ছোট্ট শিশুদের ভাগ্যেও নতুন জামা-কাপড় জোটে না।  

তিনি আরও বলেন, ভিজিএফের আওতায় এ সম্প্রদায়ের মাত্র ৪০ জন জেলে ৮০ কেজি করে চাল পেয়েছে। ১০ জন জেলে ইউনিয়ন পরিষদ থেকে ১০ কেজি করে চালের কার্ড পেয়েছে। বাকিরা কোনো সহায়তা পায়নি। এছাড়া চালের সঙ্গে তো নিত্য প্রয়োজনীয় অনেক কিছু লাগে। তাই অর্থ সংকটে থাকা ভাসমান জেলেরা সংসার চালাতে ঋণগ্রস্ত হচ্ছে। ভাসমান জেলেদের প্রতি কারও কোনো নজরদারি নেই।  

বাংলাদেশ সময়: ১৮১৪ ঘণ্টা, এপ্রিল ১০, ২০২৪
এসএম

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।