ঢাকা, শুক্রবার, ৩ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১, ১৭ মে ২০২৪, ০৮ জিলকদ ১৪৪৫

জাতীয়

তীব্র তাপপ্রবাহ: কমেছে দুধ ডিম মাংস উৎপাদন

স্বপন চন্দ্র দাস, ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১১৪৩ ঘণ্টা, এপ্রিল ৩০, ২০২৪
তীব্র তাপপ্রবাহ: কমেছে দুধ ডিম মাংস উৎপাদন

সিরাজগঞ্জ: সিরাজগঞ্জের ওপর দিয়ে বয়ে চলছে মাঝারি থেকে তীব্র তাপপ্রবাহ। প্রচণ্ড গরমে মানুষের পাশাপাশি গবাদিপশুরও ত্রাহি ত্রাহি অবস্থা।

স্বাভাবিকভাবে খেতে পারছে না খাবার। ঘরে বাইরে কোথাও কুলাতে না পেরে অসুস্থ হয়ে পড়ছে। আবার হিটস্ট্রোকে মারাও যাচ্ছে গবাদিপশুগুলো। ফলে কমে যাচ্ছে ডিম, দুধ ও মাংসের উৎপাদন। তবে কৃত্রিম উপায়ে এসব খামার শীতল রাখার চেষ্টা করছেন খামারিরা।   

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, দেশের দুগ্ধ ভাণ্ডার বলে খ্যাত সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুর উপজেলার বাঘাবাড়ি, রেশমবাড়ি, রাউতারা, পোতাজিয়াসহ মিল্কভিটার আওতাভুক্ত বিভিন্ন খামারের গাভি স্বাভাবিক খাবার খেতে পারছে না। ফলে দুধ উৎপাদন ৩০ থেকে ৩৫ শতাংশ কমে গেছে।  

পোতাজিয়া এলাকার খামারি মোহাম্মদ আলী বলেন, খরায় গাভির দুধ একেবারে শুকিয়ে গেছে। আমার খামারে শতাধিক গরুর মধ্যে চারটা গাভি আর তিনটা বাছুর মারা গেছে। এতে আমার প্রায় ১০ লাখ টাকা ক্ষতি হয়েছে। প্রতিদিন ৩০০ লিটার দুধের জায়গায় দুই থেকে শোয়া ২০০ লিটার দুধ উৎপাদন হচ্ছে।  

তিনি আরও বলেন, এই গরমে গবাদিপশুগুলোর কী অবস্থা হলো প্রাণিসম্পদ বিভাগ থেকে কোনো নজরদারি নেই। খামারিদের কেউ তাকিয়েও দেখে না।  

রেশমবাড়ী এলাকার খামারি মিজানুর রহমান ফকির বলেন, আমার খামারে ৯০টি গরুর রয়েছে। গরমে একটি গাভি মারা গেছে। প্রায় সবগুলোর পা জড়িয়ে গেছে (ঘা হয়েছে)। দুধের উৎপাদন কমেছে প্রায় ৪০ শতাংশ। আগে যেখানে ১০০ লিটার দুধ পেতাম সেখানে ৬০ লিটার হচ্ছে।  

একই গ্রামের বিখ্যা ফকির বলেন, তারও একটি গরু মারা গেছে। প্রান্তিক খামারি মারুফ হোসেনের আটটি গরুর খামার। তিনি আগে ৪৫ লিটার দুধ পেতেন এখন ৩৮ লিটার পাচ্ছেন।  

হোসেন আলী ফকির ও বাদশাসহ একাধিক খামারির সঙ্গে কথা বললে তারা জানান, প্রচণ্ড গরমে খামারে বা বাথানে কোথাও ঠিকমতো থাকতে পারছে না গরুগুলো। জ্বর, ঠান্ডাজনিত রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন। ঠিকমতো খাবারও খাচ্ছে না। ফলে দুধের উৎপাদন কমে যাচ্ছে। এদিকে উৎপাদন কমে যাওয়ায় বাঘাবাড়ি দুগ্ধ প্রক্রিয়াজাত কারখানা মিল্কভিটায় দুধ সরবরাহও কমে গেছে।

পোতাজিয়া প্রাইমারি দুগ্ধ উৎপাদন সমিতির সহকারী ব্যবস্থাপক মাসুদ রানা বলেন, আমাদের সমিতির খামারিরা প্রতিদিন গড়ে সাত হাজার লিটার দুধ উৎপাদন করেন। তবে গরমে উৎপাদন অনেক কমে গেছে। বেড়েছে গোখাদ্যের দাম। গো-খাদ্যের চেয়ে দুধের দাম কম। খামারিরা বাধ্য হয়ে গরু বিক্রি করে দিচ্ছেন।  

মিল্কভিটার উপ-মহাব্যবস্থাপক সাইদুল ইসলাম বলেন, প্রচণ্ড গরমের কারণে দুধের উৎপাদন কমেছে। নদীর পাশে যে-সব খামার আছে, তারা সহজেই পানি পাচ্ছেন। যারা বাড়িতে খামার করেছেন, তারা বেশি বেকায়দায় পড়েছেন। মিল্ক ভিটার টার্গেট প্রতিদিন গড়ে ৯০ হাজার লিটার দুধ। তবে এখন খামারিরা ৫০ হাজার লিটারের বেশি দুধ সরবরাহ দিতে পারছেন না।

এদিকে কোরবানির জন্য জেলায় ছয় লাখের মতো গরু তৈরি করছে খামারিরা। গরমে ষাঁড়গুলোর নাভিশ্বাস উঠে গেছে। ঠিকমতো খাবার খেতে পারছে না।  

শিয়ালকোলের মুকুল হোসেন নামে এক খামারি জানান, বিশাল আকৃতির দুটি ষাঁড় পালন করছেন তিনি। গরমের কারণে খামার থেকে ষাঁড় বাইরে বের করা যাচ্ছে না। সেডগুলো সবসময় ভিজিয়ে রাখা হচ্ছে।  

সিরাজগঞ্জের বেশ কয়েকটি উপজেলায় ব্রয়লার ও লেয়ার মুরগী উৎপাদন করা হয়। এসব খামারিরা বলেন, ২০ থেকে ২৫ শতাংশ ডিম উৎপাদন কমেছে। হিটস্ট্রোকে আক্রান্ত হয়ে প্রতিদিনই মারা যাচ্ছে মুরগি। হাঁসগুলো পুকুরের পানিতেও কুলাতে পারছে না।

সদর উপজেলার বিলধলী এলাকার খামারি লোকমান হোসেন বলেন, যেখানে প্রতিদিন ৯০ শতাংশ ডিম উৎপাদন হতো, গরমের কারণে ৬০ থেকে ৬৫ শতাংশের ওপর হচ্ছে না। মুরগি দুদিনের খাবার তিনদিনে খাচ্ছে। অসুস্থ হয়ে বা হিটস্ট্রোকে মারা যাচ্ছে। গরমের কারণে আমরা চরম ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছি। শেডে কৃত্রিম ঝর্ণা তৈরি করে ঠান্ডা রাখার চেষ্টা করছি।  

খোর্দ্দ শিয়ালকোল গ্রামের হাঁস ও মুরগির খামারি মোস্তফা কামাল বলেন, তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণে রাখতে পানি দিয়ে সেডে স্প্রে করা হচ্ছে। নিয়মিত স্যালাইন খাওয়ানো হচ্ছে। তারপরও লেয়ার ২০ শতাংশ আর ব্রয়লার ৩০ শতাংশের মতো মারা যাচ্ছে। ডিম উৎপাদন কমেছে ২৫ শতাংশ। তিনি বলেন, পুকুরের পানি গরম হওয়ায় হাঁস জিহ্বা বের করে হাফাচ্ছে। মেশিন চালিয়ে পানি ঠান্ডা পানি দেওয়ার পর হাঁসগুলো কিছুটা স্বস্তি পায়।    

জেলা প্রাণিসম্পদ অফিসার ডা. ওমর ফারুক বলেন, প্রায় ৬ লাখ গরু কোরবানির জন্য তৈরি করা হচ্ছে। চাহিদা দুই লাখ ২০ হাজারের মতো। বাকি গরুগুলো বাইরে সরবরাহ করা হবে। বর্তমানে তীব্র তাপপ্রবাহ চলছে। এটা একটা প্রাকৃতিক দুর্যোগ। অলরেডি জেলা ও উপজেলা প্রাণিসম্পদ অফিসগুলোতে কন্ট্রোল রুম খোলা হয়েছে। গরমে কোনো পশুর সমস্যার তথ্য এলে আমরা তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নিচ্ছি। খামারিদের বিভিন্নভাবে প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে। এই গরমে কেমন করে গরুগুলোকে রক্ষা করবে সে পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে। প্রাণিসম্পদের সব কর্মকর্তাকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে মাঠে থাকার জন্য। আমি নিজেও মাঠে রয়েছি।  

তিনি আরও বলেন, তাপমাত্রা বাড়ার কারণে গবাদিপশু খাওয়া কমিয়ে দেয়। এ কারণে দুধের উৎপাদন একটু কম হচ্ছে। তাপমাত্রা কমে গেলে আবার উৎপাদন স্বাভাবিক হবে।  

মুরগির খামার একটি সেনসেটিভ বিষয়। সিরাজগঞ্জ সদর, কাজিপুর, ও রায়গঞ্জ পোল্ট্রি জোন। এখানে একটু ঝুঁকি আছে। যেহেতু প্রচণ্ড তাপ চলছে ব্রয়লারের ক্ষেত্রে ঝুঁকিটা বেশি। মাংস ও ডিমের উৎপাদন কিছুটা কমে গেছে। খামারিদের পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে দিনের বেলায় বেশি তাপমাত্রায় খাবার কম দিয়ে রাতে বেশি খাবার দিতে হবে। টিনের শেডে চট ভিজিয়ে রাখতে বলা হয়েছে। ভিটামিন সি জাতীয় খাবার বেশি দিতে হবে।  

এদিকে তাড়াশ কৃষি আবহাওয়া অফিসের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো. জাহিদুল ইসলাম বলেন, গত দু-দিন ধরে এ অঞ্চলে মৌসুমের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ৩৯ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস রেকর্ড করা হয়েছে। এ সপ্তাহ জুড়েই এমন অবস্থা থাকার সম্ভাবনা রয়েছে।  

বাংলাদেশ সময়: ১১৪৩ ঘণ্টা, এপ্রিল ৩০, ২০২৪
এসএম

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।