ঢাকা: রাজধানীর বারিধারা ডিপ্লোমেটিক জোনে ফিলিস্তিন দূতাবাসের পুলিশে বক্সের সামনে কনস্টেবল কাউসার আলীর (৪১) সঙ্গে থাকা এসএমটি সাবমেশিনগানের প্রথম গুলিতেই মাটিতে লুটিয়ে পড়েন কনস্টেবল মনিরুল হক (২৭)। এরপরও ক্ষোভ মেটাতে পুলিশ বক্সের ভেতর থেকে বের হয়ে মনিরুলকে লক্ষ্য করে আরও কয়েক রাউন্ড গুলি চালান কাউসার।
গুলির শব্দ শুনে দূতাবাস থেকে সহকর্মীরা বেরিয়ে এসে মনিরুল মাটিতে পড়ে আছে দেখতে পান। মনিরুল কেন এভাবে পড়ে আছেন জিজ্ঞেস করলে ঘাতক কাউসার তাদের বলেন, ‘শালা (মনিরুল) নাটক করতাছে, এমনি মাটিতে পড়ে রয়েছে। ’ এই কথা বলে কাউসার দূতাবাসের বিপরীত পাশে রোডে চলে যান।
ঘটনার বিষয়ে নাম প্রকাশ না করার শর্তে ফিলিস্তিন দূতাবাসের এক নিরাপত্তারক্ষী বাংলানিউজকে এ তথ্য দেন।
তিনি বলেন, ঘটনার সময় আমরা দূতাবাসের ভেতরে ছিলাম। হঠাৎ করে ৮/১০ রাউন্ড গুলি শব্দ শুনে বাইরে আসি। আমরা দেখি, কনস্টেবল কাউসার দূতাবাসের প্রধান ফটকের সামনে দাঁড়িয়ে এবং দূরে পুলিশ বক্সের সামনে কনস্টেবল মনিরুল হক মাটিতে লুটিয়ে পড়ে আছেন। আমরা কাউসারকে জিজ্ঞেস করি কি হয়েছে? উত্তরে কাউসার বলে- ‘শালা (মনিরুল) নাটক করতাছে, এমনি মাটিতে পড়ে রয়েছে। ’
এদিকে ঘটনাস্থলের ঠিক বিপরীত পাশের একটি সিসিটিভি ক্যামেরার ফুটেজ বাংলানিউজের হাতে এসেছে।
সিসিটিভি ফুটেজ বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, শনিবার (৯ জুন) রাত ১১ টা ৪৫ মিনিট। রাজধানীর বারিধারা ডিপ্লোমেটিক জোনে ফিলিস্তিন দূতাবাসের সামনে পুলিশ বক্সের বাইরে ছিলেন কনস্টেবল মনিরুল হক। আর ভেতরে ছিলেন কনস্টেবল কাউসার আলী। মনিরুলের হাতে কাগজ সাদৃশ্য কিছু দেখা যায়। মনিরুলকে হেঁটে গিয়ে পুলিশ বক্সের দিকে মুখ করে কাউসারের সঙ্গে কথা বলতে দেখা যায়। তখন তিনি স্থিরভাবে দাঁড়িয়ে ছিলেন। কিছুক্ষণের মধ্যে (১১ টা ৪৫ মিনিটের পর) পুলিশ বক্সের ভেতর থেকে গুলি ছোড়া হয়। আর প্রথম গুলিতেই মনিরুল মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। এরপর পুলিশ বক্সের ভেতর থেকে কাউসার আলী হাতে অস্ত্রসহ বাইরে এসে মাটিতে পড়ে থাকা মনিরুলকে লক্ষ্য করে আরও বেশ কয়েক রাউন্ড গুলি ছোড়েন। এরপর কাউসার নিচে ঝুঁকে মনিরুলের কাছ থেকে কিছু একটি কুড়িয়ে হাতে নেন এবং রাস্তা থেকে ফুটপাতে উঠে পুলিশ বক্সের সামনে গিয়ে দাঁড়ান।
পুলিশ বলছে, কনস্টেবল মনিরুল হকের সঙ্গে যেকোনো বিষয় নিয়ে অপর কনস্টেবল কাউসার আহমেদের তর্কাতর্কি হয়েছে। এতেই ক্ষোভের বশে মনিরুলকে গুলি করেন কাউসার। সাময়িক উত্তেজনার কারণেই হয়ত অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনাটি ঘটতে পারে। তবে প্রাথমিকভাবে তদন্তে দুই কনস্টেবলের মধ্যে বিরোধ বা শত্রুতার কোনো বিষয় পাওয়া যায়নি। রিমান্ডে ঘাতক কনস্টেবল কাউসারকে জিজ্ঞাসাবাদ করলে ঘটনার ও গুলি করার কারণ সম্পর্কে জানা যাবে৷
এ বিষয়ে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) অতিরিক্ত কমিশনার (ক্রাইম অ্যান্ড অপারেশনস) ড. খ. মহিদ উদ্দিন বলেন, ডিপ্লোমেটিক জোনে পুলিশ সদস্যের গুলিতে আরেক পুলিশ সদস্যের মৃত্যুর ঘটনা অনাকাঙ্ক্ষিত। প্রাথমিকভাবে মনে হয়েছে কোনো বিষয় নিয়ে পুলিশ কনস্টেবল মনিরুল হকের সঙ্গে কনস্টেবল কাউসার আহমেদের তর্কাতর্কি হয়েছে। তার ফলশ্রুতিতেই একপর্যায়ে মনিরুলকে গুলির ঘটনা ঘটেছে। তবে এ বিষয়ে অভিযুক্ত কনস্টেবলকে পুরোপুরি জিজ্ঞাসাবাদের পরে বিস্তারিত বলা যাবে।
এই ঘটনায় নিহত মনিরুল হকের বড় ভাই পুলিশ কনস্টেবল মো. মাহাবুবুল হক (৪০) বাদী হয়ে রাজধানীর গুলশান থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করেছেন। মামলার তথ্য অনুযায়ী জানা যায়, মনিরুল হকের বাড়ি নেত্রকোনার আটপাড়া থানায়। ঘাতক কাউসার আলীর বাড়ি কুষ্টিয়ার দৌলতপুরে। ২০১৮ সালে মনিরুল কনস্টেবল পদে যোগদান করেন।
মামলার এজাহারের মো. মাহাবুবুল হক অভিযোগ করে বলেন, আমার ছোটভাই কনস্টেবল মো. মনিরুল হক ডিপ্লোমেটিক সিকিউরিটি বিভাগে কর্মরত ছিলেন। গত শনিবার (৮ জুন) রাত ৮টা থেকে পরদিন সকাল ৯টা পর্যন্ত বারিধারার ডিপ্লোমেটিক জোনে ফিলিস্তিন দূতাবাসের বক্সে সশস্ত্র অবস্থায় মনিরুল হক ও কনস্টেবল কাউসার আলী ডিইউটিতে নিয়োজিত ছিলেন। ডিউটিকালীন শনিবার রাত আনুমানিক ১১টা ৪৫ মিনিটে আমার ভাই মনিরুল হকের সঙ্গে কাউসার আলীর বাগ্বিতণ্ডা হয়। একপর্যায়ে মনিরুল কিছু বোঝার আগেই কাউসার তার অস্ত্র দিয়ে এলোপাতাড়ি গুলি করতে থাকে। এতে গুলিবিদ্ধ হয়ে মনিরুল হক ফিলিস্তিনি দূতাবাসের পুলিশ বক্সের সামনে উপর হয়ে মাটিতে পড়ে ঘটনাস্থলে মারা যায়। ঘটনার সময় রাস্তার পাশ দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিলেন জাপান দূতাবাসের গাড়িচালক সাজ্জাদ হোসেন। তিনিও কাউসার আলীর এলোপাতাড়ি গুলির কারণে গুলিবিদ্ধ হয়েছেন। তিনি বর্তমানে রাজধানীর ইউনাইটেড হাসপাতালে আশঙ্কাজনক অবস্থায় চিকিৎসাধীন রয়েছেন।
পরে সংবাদ পেয়ে গুলশান থানার বেশ কয়েকটি টিম ঘটনাস্থল থেকে আসামি কাউসার আলীকে গ্রেপ্তার করে নিয়ে যায়। ঘটনাস্থল থেকে ২২ রাউন্ড গুলি একটি ম্যাগাজিন ও গুলির খোসা জব্দ করা হয়।
মামলার এজাহারে আরও বলা হয়, কাউসার পুলিশ বাহিনীর একজন সদস্য হয়ে সশস্ত্র অবস্থায় সামান্য কারণে উত্তেজিত হয়ে আমার ভাইকে এলোপাতাড়ি গুলি করে হত্যা করেছেন। আমার ভাইয়ের মাথার বামপাশে একাধিক গুলির আঘাতে রক্তাক্ত জখম হয়, বাম চোখ গুলিবিদ্ধ হয়েছে। নাক ও কান দিয়ে রক্ত বের হয়েছে, বুক, পেট ও পিঠের বিভিন্নস্থানে বেশ কয়েকটি গুলির আঘাতে রক্তাক্ত জখমের চিহ্ন দেখা গেছে। গুলশান থানা পুলিশ আমার ভাইয়ের সুরতহাল প্রতিবেদন প্রস্তুত করে লাশ ময়নাতদন্তের জন্য শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠায়।
ঘটনাস্থল
রাজধানীর বারিধারা ডিপ্লোমেটিক জোনের পার্ক রোডে ফিলিস্তিন দূতাবাসের পূর্ব পাশে সড়কের সঙ্গে রয়েছে একটি পুলিশ বক্স। শনিবার রাতে এই পুলিশ বক্সের সামনেই দায়িত্বরত কনস্টেবল কাউসার আলীর অস্ত্রের গুলিতে নিহত হন কনস্টেবল মনিরুল হক। ফিলিস্তিনি দূতাবাসের পাশে রয়েছে চীন ও জাপানের দূতাবাস। ফিলিস্তিন দূতাবাসের দক্ষিণে গেটে রয়েছে তুরস্ক, ফ্রান্স, সৌদি আরব, কানাডা ও যুক্তরাষ্ট্রের দূতাবাস। ঘটনাস্থলের উত্তর দিকে রয়েছে যুক্তরাজ্যের দূতাবাস।
ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) ডিপ্লোম্যাটিক সিকিউরিটি জোনের সহকারী পুলিশ কমিশনার আরিফুল ইসলাম সরকার বলেন, আমাদের প্রাথমিকভাবে মনে হচ্ছে, কনস্টেবল কাউসার আলী মানসিকভাবে বিপর্যস্ত অবস্থায় ছিলেন। প্রাথমিকভাবে আমরা তার ব্যাচমেটদের সঙ্গে কথা বলে জেনেছি, গত ৫-৬ দিন ধরে কাউসার খুব চুপচাপ ছিলেন। তিনি তার অন্যান্য সহকর্মীদের সঙ্গে তেমন একটা কথা বলছিলেন না।
পুলিশ সূত্রে জানা যায়, ডিপ্লোমেটিক জোনে বিভিন্ন দূতাবাসের নিরাপত্তায় দায়িত্ব পালনের জন্য পুলিশ সদস্যদের এসএমটি সাবমেশিনগান দেওয়া হয়। এই অস্ত্রটি ব্রাজিল থেকে আমদানি করা। অস্ত্রটি মিনিটে ৬০০ রাউন্ড গুলি করার ক্ষমতা সম্পন্ন।
এর আগে, শনিবার (৮ জুন) রাত ২টা ৩০ মিনিটে বারিধারায় ফিলিস্তিন দূতাবাসের সামনে ঘটনাস্থল পরিদর্শনে গিয়ে পুলিশ মহাপরিদর্শক (আইজিপি) চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন বলেন, ‘কনস্টেবল কাউসার আহমেদ উন্মাদের মতো এলোপাতাড়ি গুলি ছুড়েছেন। ঘটনাস্থল থেকে আমরা কিছু গুলির খোসা ও ২০ রাউন্ড গুলি উদ্ধার করেছি। ’
আইজিপি বলেন, ‘ঘটনার পর কাউসার তার অস্ত্রটা রেখে ঘটনাস্থলের আশপাশে ঘোরাফেরা করছিলেন। তখন তাকে সেখান থেকেই আটক করা হয় আক্রমণকারী পুলিশ সদস্যকে নিরস্ত্র করে গুলশান থানায় নেওয়া হয়েছে। এই ঘটনার প্রকৃত রহস্য জানতে তদন্ত চলছে৷’
আরও পড়ুন >> সহকর্মীকে গুলি করে হত্যা: কনস্টেবল কাউসার ৭ দিনের রিমান্ডে
বাংলাদেশ সময়: ১৭২১ ঘণ্টা, জুন ৯, ২০২৪
এসজেএ/এসএএইচ