যশোর: দুর্নীতির মামলায় আদালতের নির্দেশে যশোর শহরের রেলগেট এলাকায় ‘রাশিদা মহল’ নামে জমিসহ পাঁচতলা বাড়ি ক্রোক করেছে জেলা প্রশাসন। বাড়ির সামনে জেলা প্রশাসনের সাইনবোর্ড টাঙিয়ে দেওয়া হয়েছে।
কাগজে-কলমে আলোচিত বাড়িটির মালিক ইমিগ্রেশন ও পাসপোর্ট অধিদপ্তরের সাবেক মহাপরিচালকের বরখাস্তকৃত গাড়িচালক মহসীন আলীর শাশুড়ি ফিরোজা বেগমের। বাড়ির সামনে টাঙিয়ে দেওয়া হয়েছে ক্রোককৃত সম্পত্তির রিসিভার নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি।
বাড়ির মালিক মোছা. ফিরোজা বেগম যশোরের মণিরামপুর উপজেলার গলদা গ্রামের মৃত রফিক উল্লাহর স্ত্রী। তার মেয়ের স্বামী একই উপজেলার খেদাপাড়া গ্রামের আবদুল ওহাবের ছেলে এবং পাসপোর্ট অধিদপ্তরের বরখাস্তকৃত গাড়িচালক মহসীন আলী। তারা দুজনেই দুদকের মামলার আসামি।
অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) সুজন সরকার বলেন, দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) মামলায় আদালতের নির্দেশে জমিসহ রাশিদা মহল ক্রোক করা হয়েছে। আদালতের আদেশে ওই ভবনের রিসিভার হিসেবে জেলা প্রশাসককে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। জেলা প্রশাসক প্রতি ছয় মাস পরপর ওই ভবনের আয়–ব্যয়ের হিসাব আদালতে দাখিল করবে। ভবনটি রক্ষণাবেক্ষণের জন্য জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে।
দুদক সূত্রে জানা গেছে, দুর্নীতি ও ঘুষ নেওয়ার মাধ্যমে অর্জিত অর্থ স্থানান্তর ও রূপান্তর করে শাশুড়ি মোছা. ফিরোজা বেগমকে ১ কোটি ৭৪ লাখ ৬৯ হাজার ৯৬২ টাকা ৮৫ পয়সা জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের সহযোগিতা করেছেন ইমিগ্রেশন ও পাসপোর্ট অধিদপ্তরের বরখাস্তকৃত গাড়িচালক মহসীন আলী। অনুসন্ধান শেষে ২০২৩ সালের ২২ নভেম্বর ফিরোজা বেগম ও মহসীন আলীর বিরুদ্ধে মামলা করেন দুদক সমন্বিত জেলা কার্যালয় ঢাকা-১ এর সহকারী পরিচালক খন্দকার নিলুফা জাহান। মামলায় চলতি বছরের ১২ ফেব্রুয়ারি মহানগর দায়রা জজ ও মহানগর স্পেশাল জজ আদালত ঢাকার এক আদেশে মোছা. ফিরোজা বেগমের নামে কেনা যশোর পৌরসভার রেলরোডে অবস্থিত ৭৭ নম্বর চাঁচড়া মৌজায় ৭ দশমিক ৭৪ শতাংশ জমিসহ ভবন মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইনে ক্রোক করে জেলা প্রশাসককে রিসিভার নিয়োগ দিয়েছেন।
পরে ৩ জুলাই জেলা প্রশাসকের পক্ষে অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) এ সংক্রান্ত একটি সাইনবোর্ড ওই ভবনের সামনে টাঙিয়ে দিয়েছেন। নোটিশে বলা হয়েছে, ক্রোক সম্পত্তি কোনোভাবে বা কোনো প্রকারে অন্যত্র হস্তান্তর, সম্পত্তি সংশ্লিষ্ট কোনো প্রকার লেনদেন বা সম্পত্তিকে কোনোভাবে দায়মুক্ত করা আইনত নিষিদ্ধ।
শনিবার (০৬ জুলাই) রেলগেট এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, ভবনটির প্রধান ফটকের সামনে কয়েকজন যুবক দাঁড়িয়ে আছেন। জানতে চাইলে তারা বলেন, এই ভবনে নিচতলা থেকে তৃতীয় তলা পর্যন্ত ভাড়া নেওয়া আছে। এখানে খেলাধুলার পুরস্কার (ক্রেস্ট, ট্রফি) তৈরির কারখানা আছে। সেখানে তারা কাজ করেন। শ্রমিকরা ভবনের মালিককে চেনেন না। বাড়ির মালিকপক্ষের কেউ তেমন আসেনও না।
ভবনটির নিচতলার আরেকটি ইউনিটে আছে মোটরযান মেরামতের গ্যারেজ। এই গ্যারেজ মালিক বলেন, ভবনের মালিকের সঙ্গে তেমন যোগাযোগ নেই। মাঝেমধ্যে তাদের প্রতিনিধি এসে ভাড়া নিয়ে যান। কয়েকদিন আগে জেলা প্রশাসনের লোকজন এসে সাইনবোর্ড টাঙিয়ে দিয়েছেন। শুনছি, দুর্নীতির মামলায় ভবনটি ক্রোক করেছেন আদালত।
বাড়িটির আশপাশের একাধিক দোকানদার ও প্রতিবেশী জানান, বাড়িটির মালিক পাসপোর্ট অধিদপ্তরের সাবেক মহাপরিচালকের গাড়িচালক মহসীন আলী ও তার স্ত্রী পাসপোর্ট অধিদপ্তরের বরখাস্তকৃত অফিস সহকারী (স্টেনোগ্রাফার) রাশিদা বেগমের। ২০০৮ সালে রাশিদা বেগমের মা ফিরোজা বেগমের নামে ৭ দশমিক ৭৪ শতক জমি কেনা হয়। পরে সেখানে পাঁচতলা আলিশান বাড়ি নির্মাণ করা হয়। এলাকার লোকজন মহসীন আলীকে সচিবালয়ের শীর্ষ কর্মকর্তা বলে জানতেন। পরে দুর্নীতির মামলা হলে তাদের সম্পর্কে অনেক চাঞ্চল্যকর তথ্য বেরিয়ে আসে।
এদিকে, সম্প্রতি আলোচিত ওই আলিসান বাড়ির ছবি ফেসবুকে পোস্ট করে নির্মাণে অর্থের উৎস নিয়ে প্রশ্ন তোলেন যশোর জেলা পরিষদের সাবেক সদস্য ও আওয়ামী লীগ নেতা শহিদুল ইসলাম মিলন। এরপর ওই পোস্টের নিচে আলোচিত বাড়িটির মালিক ইমিগ্রেশন ও পাসপোর্ট অধিদপ্তরের বরখাস্তকৃত গাড়িচালক মহসীন আলী খিস্তি-খেউড় ভাষা ব্যবহার করে লেখেন, ‘আমি চুইপারের (ছুঁইপার) চাকরি করি, তোদের কি? এতো লেখালেখি করে আমার *** ফেলাতে পারবি না। আরো বেশি করে লিখলে আমার জন্য ভালো, আমার ভাইরাল হওয়া দরকার। ’
এছাড়াও একই পোস্টে আরও একটি মন্তব্যে তিনি লেখেন, ‘এই বাড়িটি তোর বাবার। আমি ঢাকায় থাকি তাই তোর নামে মামলা ঢাকায় করতেছি, তুই আওয়ামী লীগের নেতা বলে আমার কাছে চাঁদা চাইতে পারলি? আমি প্রয়োজনে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রীর কাছে যাবো তার পরে পরামর্শ করে মামলা করবো। ওই পোস্টে আরও অসংখ্য মন্তব্য দেখা গেছে। ’
বাংলাদেশ সময়: ১০১২ ঘণ্টা, জুলাই ০৬, ২০২৪
ইউজি/এফআর