ঢাকা: মানুষ যত শিক্ষিত হচ্ছে তত বেশি অধিকার নিয়ে সচেতন হচ্ছে। তার অধিকার আদায়ের জন্য আইনের দিকে যাচ্ছে।
সোমবার (১৫ জুলাই) বিকেলে ইস্ট ওয়েস্ট মিডিয়া গ্রুপ লিমিটেড পিএলসির (ইডব্লিউএমজিএলপিএলসি) কনফারেন্স রুমে দৈনিক কালের কণ্ঠ ও ক্রিশ্চিয়ান এইড বাংলাদেশ আয়োজিত ‘বাংলাদেশে বৈষম্যবিরোধী আইন ও আমাদের প্রত্যাশা’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকে বক্তারা এসব কথা বলেন।
বৈঠকে জাতীয় সংসদের হুইপ অ্যাডভোকেট সানজিদা খানম বলেন, আমাদের ভুলে গেলে চলবে না জনগণের কল্যাণে সংসদে আইন প্রণয়ন করাই আমাদের প্রধান কাজ। এটাই আমাদের একমাত্র কাজ হওয়া উচিত। প্রধান কাজে না জড়িয়ে অন্য কাজে জড়িয়ে যান সংসদ সদস্যরা। দেশের সাধারণ জনগণ মনে করে, আমার এলাকার যে এমপি সংসদে থাকবেন সে এলাকার রাস্তা তৈরি করে দেবেন। আমরা যারা জনপ্রতিনিধি সাধারণ মানুষের ভোটে সংসদে যাই, জনসাধারণের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে আমাদের (সংসদ সদস্যদের) অনেক কাজে জড়িয়ে পড়তে হয়।
দৈনিক কালের কণ্ঠের প্রধান সম্পাদক ইমদাদুল হক মিলন বলেন, মানুষ যত শিক্ষিত হচ্ছে তত বেশি অধিকার নিয়ে সচেতন হচ্ছে। মানুষ তার অধিকার নিয়ে কথা বলতে শুরু করেছে। মানুষ তার অধিকার আদায়ের জন্য আইনের দিকে যাচ্ছে। মানুষ সচেতন না হলে দেশ বদলায় না। আমরা মানব সভ্যতার শুরু থেকেই বৈষম্য দেখে আসছি। আমরা যেন মানুষ হয়ে প্রত্যেকে প্রত্যেকের পাশে দাঁড়াতে পারি।
কালের কণ্ঠের সহকারী সম্পাদক আলী হাবিবের সঞ্চালনায় বৈঠকে আরও বক্তব্য রাখেন সাবেক সংসদ সদস্য শামীম হায়দার পাটোয়ারী, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. এস এম মাসুম বিল্লাহ, জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের উপ-পরিচালক রবিউল ইসলাম, বিডিইআরএমের সভাপতি উত্তম কুমার ভক্ত, মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের প্রোগ্রাম কো-অর্ডিনেটর রুনা সুলতানা, অ্যাডভোকেট মো. তাজুল ইসলাম, দলিত নারী ফোরামের সাধারণ সম্পাদক মনি রানী দাস, হোপ অ্যান্ড পিস ওয়েলকাম সোসাইটির সেক্রেটারি রানী চৌধুরী, নাগরিক উদ্যোগের প্রোগ্রাম ম্যানেজার নাদিরা পারভীন, ক্রিশ্চিয়ান এইডের কান্ট্রি ডিরেক্টর নূজহাত জাবিন।
গোলটেবিল বৈঠকে বক্তারা বলেন, জন্মগতভাবে প্রতিটি মানুষ স্বাধীন এবং পূর্ণ মানবাধিকার ও সমমর্যাদার অধিকারী। দেশের সংবিধানের প্রস্তাবনায় ঘোষণা করা হয়েছে- রাষ্ট্রের অন্যতম মূল লক্ষ্য হবে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে এমন এক শোষণমুক্ত সমাজতান্ত্রিক সমাজের প্রতিষ্ঠা- যেখানে সব নাগরিকের জন্য আইনের শাসন, মৌলিক মানবাধিকার এবং রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক সাম্য, স্বাধীনতা ও সুবিচার নিশ্চিত হবে। সংবিধানের ২৭ অনুচ্ছেদ মতে- আইনের দৃষ্টিতে সব নাগরিক সমান; ২৮ অনুচ্ছেদ অনুসারে- কেবল ধর্ম, গোষ্ঠী, বর্ণ, নারী পুরুষভেদে বা জন্মস্থানের কারণে কোনো নাগরিকের প্রতি বৈষম্য করা যাবে না এবং ২৯ অনুচ্ছেদ মতে, প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিয়োগ বা পদ লাভের ক্ষেত্রে সব নাগরিকের জন্য সমান সুযোগের নিশ্চয়তা প্রদান এবং যে কোনো ধরনের বৈষম্য প্রদর্শন নিষিদ্ধ করা হয়েছে।
বক্তারা আরও বলেন, দেশের সংবিধান এবং বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ঘোষণা ও সনদসমূহে নির্দেশিত মানুষের সমমর্যাদা এবং সমঅধিকার রক্ষা, সমুন্নত ও নিশ্চিত করার বাধ্যবাধকতায়, নাগরিকদের অধিকার ভোগের ক্ষেত্রে সকল প্রকার বৈষম্য অগ্রহণযোগ্য হলেও বাস্তব অবস্থা ভিন্ন, যা বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার একটি অংশ তথা ধর্মীয়, জাতিগত, লিঙ্গভিত্তিক ও ভৌগোলিক অবস্থানগত জনগোষ্ঠীর দৃশ্যমান পিছিয়ে পড়া অস্তিত্ব থেকে সহজেই অনুমেয়। এমতাবস্থায় সব ধরনের বৈষম্য বিলোপে রাষ্ট্রীয় আইন প্রণয়ন ও প্রয়োগের বিষয়টি খুবই প্রাসঙ্গিক।
বৈঠকে কিছু সুপারিশ তুলে ধরা হয়, সেগুলো হলো—
* প্রস্তাবিত বৈষম্যবিরোধী আইন ২০২২ প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করা এবং আইনের শিরোনাম ‘বৈষম্য বিলোপ আইন’ করা।
*প্রস্তাবিত আইনে বৈষম্যগুলোকে সুনির্দিষ্টভাবে চিহ্নিত ও সংজ্ঞায়িত করা হয়নি। বৈষম্যের ক্ষেত্রে ও ধরনসমূহ চিহ্নিত করে প্রতিকার প্রাপ্তি এবং প্রতিকারের বিধানসমূহ সুনির্দিষ্ট করা।
*বৈষম্যমূলক কাজকে শাস্তিযোগ্য অপরাধ বিবেচনা করা হয়নি এবং সুস্পষ্টভাবে কোনো শাস্তির বিধান রাখা হয়নি। অথচ আইনটিকে যথাযথভাবে কার্যকর করতে হলে বৈষম্যমূলক কাজকে শাস্তিযোগ্য অপরাধ বিবেচনা করতে হবে। বৈষম্যের ক্ষেত্র অনুসারে বিভিন্ন মাত্রার শাস্তির বিধান থাকা আবশ্যক।
*প্রস্তাবিত আইনে আইনমন্ত্রী নেতৃত্বে একটি ২৮ সদস্যের কমিটির কথা বলা আছে, যেখানে ১৭ জন সচিব বা তাদের প্রতিনিধি (যুগ্ম-সচিব) থাকবেন। মন্ত্রণালয়গুলোর বিদ্যমান কার্যাবলী, কাজের ধরন ও ক্ষেত্র বিবেচনায় বিষয়টি কতটা বাস্তবসম্মত হবে, তা বিবেচনা করা।
* আইনটিতে শুধু অভিযোগের কথা বলা হয়েছে, কিন্তু প্রতিকার কী নেওয়া হবে তার কোনো দিক-নির্দেশনা নেই। যেমন কোন ক্ষেত্রে ক্ষতিপূরণ, নিষেধাজ্ঞা, ক্ষমা প্রার্থনা ইত্যাদি প্রতিকার বিধান থাকতে পারতো। আবার বৈষম্য মানুষের শুধু আর্থিক ও সামাজিক ক্ষতিই নয়, বরং এর মানসিক ক্ষতির কারণে মানুষের বিকাশ বাধাপ্রাপ্ত হওয়াসহ অধিকার চর্চায় অনাগ্রহী করে তোলে। এ জন্য বৈষম্যের মানসিক প্রভাব বিবেচনায় নিয়ে আইনে সুনির্দিষ্ট দিক-নির্দেশনা থাকা প্রয়োজন।
*জেলা কমিটিকে অভিযোগ আমলে নেওয়ার স্বতঃপ্রণোদিত ক্ষমতা দিতে হবে এবং এই কমিটির ক্ষমতার প্রকৃতি কি প্রশাসনিক নাকি বিচারিক তা উল্লেখ করতে হবে। জেলা কমিটি কোন কোন আইন বিবেচনায় নেবে এবং কর্মপদ্ধতি কী হবে তার নির্দেশনা থাকতে হবে।
বাংলাদেশ সময়: ০৯৪৫ ঘণ্টা, ১৫ জুলাই, ২০২৪
এমএমআই/এমএম