ঢাকা, শনিবার, ৭ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ২১ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

জাতীয়

‘সরকারের নৈতিক-রাজনৈতিক পরাজয় হয়েছে’

স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৫০২ ঘণ্টা, আগস্ট ১, ২০২৪
‘সরকারের নৈতিক-রাজনৈতিক পরাজয় হয়েছে’

ঢাকা: চলমান কোটা সংস্কার আন্দোলনকে গণঅভ্যুত্থান বলে আখ্যা দিয়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক রোবায়েত ফেরদৌস। এই গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে সরকারের নৈতিক ও রাজনৈতিক পরাজয় হয়েছে বলেও মন্তব্য করেন তিনি।

বৃহস্পতিবার (১ আগস্ট) দুপুরে রাজধানীর ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে ‘কোটা সংস্কার আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে সৃষ্ট অচলাবস্থা নিরসনের দাবিতে’ সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি এসব কথা বলেন।

অধ্যাপক রোবায়েত ফেরদৌস বলেন, এই আন্দোলনের মধ্য দিয়ে সরকারের নৈতিক এবং রাজনৈতিক পরাজয় নিশ্চিত হয়েছে। ২০২৪ সালে যেটি হয়েছে সেটা একটি গণঅভ্যুত্থান। ’৬৯-এর গণঅভ্যুত্থানে মাত্র ৬১ জন মানুষ মারা গেছে। ২০২৪ সালের গণঅভ্যুত্থানে ’৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান থেকে চারগুণ বেশি মানুষ মারা গেছে। গণঅভ্যুত্থানের চরিত্র কাকে বলে? যেখানে সমস্ত শ্রেণিপেশার মানুষ থাকে। এখানে শিশু, নারী, সাংবাদিক, ডাক্তার, প্রকৌশলী বিভিন্ন শ্রেণিপেশার মানুষরা অন্তর্ভুক্ত হয়েছেন।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এই অধ্যাপক আরও বলেন, ’৫২ এর ভাষা আন্দোলনে ১২ জন মারা গিয়েছেন। আমরা এই আন্দোলনকে সাংস্কৃতিক না একটি রাজনৈতিক আন্দোলন বলি। মানুষের যে পুঞ্জীভূত ক্ষোভ ছিল ৪৭ থেকে ৫২ পর্যন্ত সব ধরনের মানুষ সেই ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ করেছে। ২০২৪ সালে গণঅভ্যুত্থান হয়ে গেছে। তার রেশ এখনো চলছে। এর মধ্য দিয়ে সরকারের নৈতিক এবং রাজনৈতিক পরাজয় নিশ্চিত হয়েছে।

অধ্যাপক রোবায়েত ফেরদৌস বলেন, আপনি আপনার রাষ্ট্রের নিজস্ব নাগরিক মারবার জন্য হেলিকাপ্টারের ব্যবহার করেছেন। সেখান থেকে টিয়ারশেল, সাউন্ডগ্রেন্ড নিক্ষেপ ও গুলি ছোড়া হয়েছে। ঘরের মধ্যে শিশুকে মারা হয়েছে। সাংবাদিককে মারা হয়েছে। এটা যদি গণঅভ্যুত্থান না হয় তাহলে গণঅভ্যুত্থান কোনটা আমি ঠিক জানি না।

তিনি বলেন, আমরা বিএনপিকে দেখেছি ব্যর্থ হয়েছে। জামায়েতকে দেখেছি, জাতীয় পার্টিকে দেখেছি ব্যর্থ হয়েছে। সমস্ত রাজনৈতিক দল যারা ব্যর্থ হয়েছে, তাদের সবাইকে না বলতে হবে। তরুণ প্রজন্মের শিক্ষার্থীরা আমাদের দেখাচ্ছে, কীভাবে নতুন সংবিধান লিখতে হয়। নতুন রাজনৈতিক দল তৈরি করতে হবে।

এরশাদবিরোধী আন্দোলনে এত অল্প সময়ে এত মানুষের মৃত্যু হয়নি জানিয়ে অধ্যাপক রোবায়েত ফেরদৌস বলেন, ছাত্রদের রক্ত এরশাদের হাতে। আওয়ামী লীগের মতো ৭৫ বয়সী একটা দলের হাতে ছাত্রদের রক্ত। পৃথিবীর ইতিহাস বলে, শিক্ষার্থীদের রক্ত (ঝরলে) কোনো আন্দোলন কোনদিন ব্যর্থ হতে পারে না। আমি মনে করি, এই আন্দোলন ব্যর্থ হতে পারে না।

আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের সমালোচনা করে এই অধ্যাপক বলেন, তার দলের লোকজন ডেকে মতবিনিময়ের নামে তিনি সাংবাদিক সম্মেলন করেন। আপনি আপনার নিজ দলের নেতাদের সঙ্গে অসৎ। তাহলে আপনি বিরোধীদল, ছাত্রদের সঙ্গে সংলাপে কি সৎ থাকবেন?

সংবাদ সম্মেলনে সুজন সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার বলেন, ছাত্রসমাজ যে দাবি নিয়ে মাঠে নেমেছে, আমরা সুজনের পক্ষ থেকে একাত্মতা পোষণ করছি। ছাত্রসমাজ তাদের সরকারি চাকরির অধিকার থেকে বঞ্চিত। ক্ষমতাসীন দলের সাথে সম্পৃক্ততা না থাকলে সরকারি, আধা সরকারি থেকে শুরু করে কোনো চাকরি পাওয়া যায় না।  

বদিউল আলম মজুমদার বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে মানবাধিকার লঙ্ঘন হয়েছে। অনেকগুলো মৌলিক অধিকার থেকে ছাত্রছাত্রী থেকে শুরু করে আমরা সবাই বঞ্চিত। ভোটাধিকার থেকে আমরা সবাই বঞ্চিত। মৌলিক নাগরিক অধিকার থেকে বঞ্চিত। নাগরিক হিসেবে যেগুলো আমাদের সংবিধান স্বীকৃত, সেগুলো থেকে আমরা বঞ্চিত।

তিনি বলেন, ভোটাধিকার না থাকার কারণে সরকারের কোনো জবাবদিহিতা নেই। এজন্য তারা বল প্রয়োগের মাধ্যমে সমস্যা সমাধান করার চেষ্টা করছে।

সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ও পরিবেশ সংগঠন বেলা’র প্রধান নির্বাহী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, সরকারের পক্ষ থেকে সংকট নিরসনে কোনো কার্যকর ভূমিকা আমরা দেখছি না। সরকার কোনোরকমভাবে একটা প্রলেপ লাগানোর চেষ্টা করছে। আজকে যে ক্ষতটা এই জাতির হৃদয়ে হয়ে গেছে, সেটা অনেক বেশি গভীর।

রিজওয়ানা হাসান আরও বলেন, শিক্ষার্থীদের আন্দোলনকে কেন্দ্র করে যে ঘটনাগুলো হলো, এটা গোটা জাতিকে প্রভাবিত করেছে। আমরা কেউই এখন আর মানসিকভাবে ভালো থাকতে পারছি না। আন্দোলনকে কেন্দ্র করে যে ঘটনাগুলো হয়েছে, এটি ক্ষমা করার কোনো সুযোগ নেই। এতগুলো মানুষের প্রাণ নিয়ে নেওয়া হয়েছে, এটাকে আমরা কীভাবে ক্ষমা করব?

রিজওয়ানা হাসান বলেন, এবার যদি বাংলাদেশে বিচার না হয় তাহলে দেশ থেকে বিচার শব্দটা একেবারেই উঠে যাবে। এবার নিজ নিজ অবস্থান থেকে বিচারের দাবি জানাতে হবে। বিচার না হওয়া পর্যন্ত স্বচ্ছ প্রক্রিয়ায় আন্তর্জাতিক মহলের সংশ্লিষ্টতা নিশ্চিত করে বিচার না হওয়া অবধি আমাদের চুপ হয়ে যাওয়া অথবা সান্ত্বনা পাওয়ার কোনো সুযোগ নেই।

বর্মান অচলাবস্থা নিরসনে সরকারকে কিছু সুপারিশ করেছে সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন)। সুপারিশগুলো হলো:

১) নিহতদের নাম পরিচয়সহ বিস্তারিত বিবরণ সম্বলিত তালিকা প্রকাশ করা।

২) নিরপেক্ষ ব্যক্তি ও বিশেষজ্ঞদের নিয়ে সহিংসতার সব ঘটনার স্বচ্ছ ও বিশ্বাসযোগ্য তদন্ত করা এবং দায়ীদের বিচারের ব্যবস্থা করা। একইসঙ্গে জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে একটি আন্তর্জাতিক তদন্তও হওয়া উচিত।

৩) ডিবি হেফাজতে আটকে রাখা বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়কারীদের অবিলম্বে পরিবারের কাছে ফিরিয়ে দেওয়া। আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে দায়েরকৃত সকল মামলা প্রত্যাহার, নতুন করে মামলা না দেওয়া এবং গ্রেপ্তারকৃতদের মুক্তি দেওয়া (কেননা প্রধানমন্ত্রীসহ সরকারের মন্ত্রীরাই বলছেন, আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা সহিংসতায় লিপ্ত হয়নি) এবং গায়েবি মামলা ও ব্লক রেইড দিয়ে ঢালাওভাবে গ্রেপ্তার বন্ধ করা। আন্দোলনে নেতৃত্বদানকারীদের নিরাপত্তা দেওয়া এবং ভবিষ্যতে হয়রানি না করার অঙ্গীকার করা।

৪) সহিংসতায় নিহতদের পরিবারকে আর্থিক সহায়তা প্রদান করা এবং প্রয়োজনের নিরিখে পরিবারের কোনো সদস্যের চাকরির ব্যবস্থা করা। আহতদের সরকারি খরচে চিকিৎসাসেবা প্রদানসহ পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করা।

৫) শিক্ষার ক্ষতির বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে অবিলম্বে সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়া। ব্যবসা-বাণিজ্য, শিক্ষাঙ্গনসহ জনজীবনে স্বাভাবিক অবস্থা ফিরিয়ে আনতে কাউফিউ তুলে নিয়ে এবং ইন্টারনেট ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের ওপর বিধি-নিষেধ প্রত্যাহার করে বাকস্বাধীনতাসহ জনগণের সকল মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করা।

৬) পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলোতে ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র সংগঠনের সিট বাণিজ্য বন্ধ করে যথাযথ নিয়মে প্রশাসনিকভাবে সিট বরাদ্দ করা, অছাত্রদের হলে অবস্থান নিষিদ্ধ করা এবং কমনরুম কালচার, ব‍্যাগিং কালচার ইত্যাদি বন্ধ করা। ভবিষ্যতে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে জড়িতদের ছাত্রত্ব বাতিলের অঙ্গীকার করা। শিক্ষার্থীদের নেতৃত্ব বিকাশে সারা দেশের সকল বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজগুলোতে নিয়মিত ছাত্র সংসদ নির্বাচন করা।

৭) গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশের বিধান অনুযায়ী লেজুরবৃত্তির ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ করা এবং স্বাধীন ছাত্ররাজনীতির পরিবেশ সৃষ্টি করা।

৮) আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে দলীয় স্বার্থে ব্যবহার বন্ধ করা এবং পুলিশ ও সেনাবাহিনীকে জনগণের মুখোমুখি দাঁড় করানো থেকে বিরত থাকা।

৯) গণতান্ত্রিক অধিকারসহ নাগরিকদের মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করা।

১০) রাজনীতিতে ধর্মের ব্যবহার ও সাম্প্রদায়িক রাজনীতি নিষিদ্ধ ঘোষণা করা এবং সংবিধানকে প্রকৃত অর্থেই অসাম্প্রদায়িক চরিত্রে ফিরিয়ে আনা।

বাংলাদেশ সময়: ১৪৫৫ ঘণ্টা, আগস্ট ০১, ২০২৪
ইএসএস/এমজেএফ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।