ঢাকা, শুক্রবার, ১২ পৌষ ১৪৩১, ২৭ ডিসেম্বর ২০২৪, ২৪ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

জাতীয়

এখন অনেক দায়িত্ব, শহীদদের তালিকা করে তাদের পরিবারের পাশে দাঁড়াতে হবে

নাজমুল আহসান তালুকদার | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৫০২ ঘণ্টা, আগস্ট ১১, ২০২৪
এখন অনেক দায়িত্ব, শহীদদের তালিকা করে তাদের পরিবারের পাশে দাঁড়াতে হবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী উমামা ফাতেমা

দেশের ইতিহাসের বাঁকবদল ঘটলো ২০২৪ সালের জুলাই মাসে। কোটা সংস্কার আন্দোলন থেকে সরকার পতনের এক দফা দাবি।

ছাত্র-জনতার সেই আন্দোলনের মুখে প্রধানমন্ত্রী পদ থেকে পদত্যাগ করে দেশ ছাড়তে বাধ্য হন শেখ হাসিনা। অবসান ঘটে প্রায় ১৬ বছরের কর্তৃত্ববাদী শাসনের। এই আন্দোলনের পুরোটা নেতৃত্ব দিয়েছেন সাধারণ শিক্ষার্থীরা। এই শিক্ষার্থীদের মধ্যে কয়েকজন নারী শিক্ষার্থীও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। তাদের মধ্যে অন্যতম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী উমামা ফাতেমা৷

স্বৈরাচারবিরোধী এই আন্দোলনের শুরু থেকেই তিনি সম্পৃক্ত ছিলেন, নেতৃত্ব দিয়েছেন এবং একজন সমন্বয়ক হিসেবে কাজ করেছেন। বাংলানিউজের সঙ্গে আগামীর ভাবনা ও নিজের স্বপ্নের কথা জানিয়েছেন তিনি।  

বাংলানিউজ: একটি সফল আন্দোলন, নতুন সরকার, কী কী দাবি বা প্রত্যাশা রয়েছে?

উমামা ফাতেমা: এখানে আসলে বলে বোঝানো যাবে না এত এত স্বপ্ন। তবে প্রথমে যেটা মনে করি, দেশের আইন-শৃঙ্খলার পরিস্থিতির বেশ অবনতি ঘটেছে, এটা দ্রুত সময়ের মধ্যে ঠিক করা জরুরি। আমাদের যারা সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠী আছে তাদের নিরাপত্তা দিতে হবে। বর্তমানে ছাত্ররা ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণ করছে, পাশাপাশি বিষয়টি নিয়ে স্টাডি করছে, আমাদের সঙ্গেও পরামর্শ করছে। আমার মনে হয় ছাত্রদের নিয়ে সরকারের পক্ষ থেকে একটা ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা কমিটি গঠন করা উচিত। যেখানে ছাত্র-পুলিশ-বিশেষজ্ঞ সবাই থাকবে। এর চেয়ে বড় বিষয় আমাদের এখানে সংবিধান সংস্কার করতে হবে। আমাদের সংবিধানে মানুষের চাওয়ার প্রতিফলন ঘটেনি, এখানে লাভ হয়েছে বিভিন্ন গোষ্ঠীর। সংবিধানে প্রধানমন্ত্রীকে সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী করা হয়েছে, এটা দ্রুততম সময়ের মধ্যে সংস্কার করতে হবে। যার মাধ্যমে সংবিধানকে গণতন্ত্রমুখী গড়ে তোলা যাবে। এছাড়া দমন-পীড়নমূলক আইন, যেমন সাইবার সিকিউরিটি অ্যাক্ট, বিভিন্ন বাক স্বাধীনতা হরণ করার আইন, এই আইনগুলো দ্রুত সময়ের মধ্যে বাতিল করতে হবে। এছাড়াও উপনিবেশিক আমলের আইন বাতিল করতে হবে। ইনস্টিটিউট সংস্কার করতে হবে।  

বাংলানিউজ: কোটা সংস্কার আন্দোলনে আপনার যুক্ত হওয়া কীভাবে?

উমামা ফাতেমা: আমি সুফিয়া কামাল হলে থাকতাম, শুরুতে সেখান থেকে তেমন কোনো মিছিল হচ্ছিল না। আমরা ব্যক্তিগতভাবে ৬ জুন থেকে মিছিল-সমাবেশ করছিলাম। এরপর একটি প্রোগ্রামে আমাদের হলের আরেক মেয়ে রুপু আক্তারের সঙ্গে আমার দেখা হয়। এরপর আমরা পরিকল্পনা সাজাই কীভাবে মেয়েদের এই আন্দোলনে যুক্ত করা যায়। এই ভাবনা থেকে আমরা আন্দোলনের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে যাই।  

বাংলানিউজ: আপনাদের ওপর হামলা হয়েছিল, এরপর কি ভয় লেগেছিল?

উমামা ফাতেমা: আন্দোলনের সময় আমাদের ওপর ছাত্রলীগের হামলা হয়। তারপরও থেমে না গিয়ে আমরা আন্দোলন করে গেছি। পরে তো আপনারা দেখেছেন যে, এই আন্দোলন সরকার পতনের দিকে গেছে। এটা মূলত ব্যক্তি যোগদানের বিষয় না, যখন সবাই ঐক্যবদ্ধভাবে একসঙ্গে হয়েছি তখনই কিন্তু আমরা সফল হয়েছি।  

বাংলানিউজ: আপনাদের ওপর হামলা হলো, এটি জানার পর পারিবারিকভাবে বাধা আসেনি? 

উমামা ফাতেমা: আমরা তো পড়াশোনা করা পরিবার। থানা, পুলিশ, রাজনীতি এসব তো আমাদের পরিবারে নেই। ছাত্রলীগের হামলার শিকার হই, আমাকে ওই রাতে টেলিভিশনে দেখায়। তখন আমার বাবা-চাচা কেউ ঘুমাতে পারেননি। আমি হাঁটতে পারছিলাম না, খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটছিলাম, আমার বাবা তো ফোন দিয়ে রীতিমতো কান্নাকাটি করছিলেন। ওই রাতে আমরা একটা ভীতিকর পরিস্থিতিতে ছিলাম। আমরা হল ছেড়ে যেতে বাধ্য হই, সেই সময় প্রচুর মানসিক চাপে ছিলাম।  

বাংলানিউজ: এরপর কী ধরনের পদক্ষেপ নিলেন?

উমামা ফাতেমা: সরকার যেসব গুজব ছড়াচ্ছিল, আমরা চেষ্টা করছিলাম সেটিকে ভুয়া খবর প্রমাণিত করতে। এটাই আমাদের মূল কাজ ছিল ওই সময়। আর বাকি যা করার তা করেছে সাধারণ ছাত্র ও জনগণ।  

বাংলানিউজ: ডিবি কিংবা আইনশৃঙ্খলা বাহিনী যখন আপনাদের সমন্বয়কদের উঠিয়ে নিয়ে যাচ্ছিল তখন কেমন চাপে ছিলেন?

উমামা ফাতেমা: একটি ঘটনা আমি বলতে পারি, সম্ভবত সেটি ২৬ জুলাইয়ের। একটি সংবাদ সম্মেলন করার কথা ছিল। আমরা, নাহিদ ভাইরা মিলে ‘চলো চলো ক্যাম্পাসে চলো’ এমন একটি আন্দোলন করার পরিকল্পনা করেছিলাম। সন্ধ্যায় সংবাদ সম্মেলন করার কথা ছিল, কিন্তু শুনি বিকাল ৪টায় নাহিদকে ধরে নিয়ে গেছে। এরপর শনিবার সারজিস ভাই, হাসনাত ভাইদের ধরে নিয়ে গেল। ওইদিন আমার সঙ্গে নুসরাতের ভোর ৪টায়ও কথা হয়। এরপর ঘুমিয়ে যাই। কিন্তু এর দুই ঘণ্টা পরেই নাহিদা সরোয়ার নিভা আপু ফোনকল করে জানান, নুসরাতকে ধরে নিয়ে গেছে। এর পরের মানসিক অবস্থা আর না বলি। তবে এতোটুকু বলি- ওই সময় খুবই বাজে অবস্থার মধ্যে দিয়ে গেছি আমরা।  

বাংলানিউজ: অন্তর্বর্তী সরকারকে আপনারা সমন্বয়করা কীভাবে পরামর্শ বা সহায়তা করবেন? 

উমামা ফাতেমা: এটা আমাদের বুঝতে হবে, যখন আমাদের মধ্যে থেকে দুজন ছাত্র উপদেষ্টা হিসেবে গেছেন, তারা এতটা অভিজ্ঞতা সম্পন্ন নন। তারা কিন্তু গেছেন আমাদের ছাত্রদের প্রতিনিধি হিসেবে। এখানে কিন্তু আমাদের আপামর ছাত্রদের পরামর্শ নিয়েই কাজ করতে হবে। উপদেষ্টাদের সব সময় চাপে রাখতে হবে, যেন তারা এই যে রিফরমেশনের চেষ্টা, এই জায়গা থেকে বিচ্যুত না হন। এই মুহূর্তে আমাদের ছাত্র-জনতা সবার এটা দায়িত্ব, সেটাই আমরা পালন করার জন্য এই মুহূর্তে ভাবছি।  

বাংলানিউজ: এই যে আপনারা সম্মুখ সারিতে নেতৃত্ব দিলেন, বাংলাদেশ তো বটেই, বিশ্বের অনেকেই আপনাদের বাহবা দিচ্ছে। প্রধান সমন্বয়কদের একজন হিসেবে আপনার কেমন লাগছে? 

উমামা ফাতেমা: ভালো তো লাগছে। তবে এখন আমাদের কাঁধে প্রচুর দায়িত্ব। এখনো আমাদের কাছে নিহতদের তালিকা পরিষ্কার নয়৷ তাই দ্রুত সময়ের মধ্যে আমাদের শহীদদের তালিকা তৈরি করতে হবে। এরপর তাদের পরিবারের পাশে দাঁড়াতে হবে। যারা আহত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি তাদের দ্রুততম সময়ের মধ্যে চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে হবে। শুধু তা-ই নয়, তাদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে হবে এবং এটা সরকারিভাবেই হতে হবে৷ 

বাংলানিউজ: সমন্বয়কদের পক্ষ থেকে দেশবাসীর জন্য আপনার কোনো বার্তা আছে কি না? 

উমামা ফাতেমা: দেশবাসীকে বলতে চাই, এটা কোনো একক ব্যক্তির আন্দোলন ছিল না, এটা আমাদের সবার প্রচেষ্টার ফসল। যখন এটা একটি গোষ্ঠীর মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখতে যাবেন, তখন কিন্তু এই গণঅভ্যুত্থান ব্যর্থ হবে। প্রত্যেককেই মাথায় রাখতে হবে আন্দোলনটা আমার আন্দোলন ছিল, এই মন্ত্রিসভায় সবার ওপর আমার হক আছে। এটা যখন ভাবতে পারবো তখনই আমরা চাপ প্রয়োগ করতে পারব যেন আমাদের দাবিটা আদায় হয়। তখনই এই অন্তর্বর্তী সরকারের মাধ্যমে দেশটাকে পুনর্গঠন করা সম্ভব হবে।  

বাংলানিউজ: আপনার স্বপ্ন সম্পর্কে জানতে চাই? 

উমামা ফাতেমা: এই মুহূর্তে আমি যেহেতু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী, তাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় নিয়েই আমার স্বপ্ন। পরে ধীরে ধীরে আমি আরও সামনে এগোতে চাই। এক লাফে আমার মন্ত্রিসভায় যাওয়ার ইচ্ছা নেই।

বাংলাদেশ সময়: ১৪৫৪ ঘণ্টা, আগস্ট ১১, ২০২৪
এনএটি/এইচএ/

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।