লক্ষ্মীপুর: বন্যার কবলে মারাত্মক বিপর্যস্ত লক্ষ্মীপুরের জনজীবন। সেই সঙ্গে গবাদি পশু গরু, ছাগল, হাঁস-মুরগি নিয়ে বিপাকে পড়েছেন বন্যাকবলিত এলাকার মানুষ।
এদিকে পশুর রাখার জায়গা না থাকায় কেউ কেউ মানুষের আশ্রয়কেন্দ্রে গবাদি পশুকে রেখেছেন। আবার কেউ ভবনের ছাদে রেখেছেন। একই সঙ্গে ঠিকমতো খাবার সরবরাহ করতে হিমশিম খাচ্ছেন। স্থানীয় প্রাণিসম্পদ বিভাগের সঙ্গেও কোনো যোগাযোগ করতে পারছেন না মানুষজন।
এমনি একজন কৃষক হেলাল উদ্দিন। সদর উপজেলার পূর্ব দিঘলী ভূইয়া বাড়িতে তাদের বসবাস। তার ছয়টি গরু রয়েছে। তিনি তার পরিবার পরিজনসহ গরুগুলো নিয়ে উঠেছেন বাড়ি থেকে অদূরে দিঘলী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের অস্থায়ী আশ্রয়কেন্দ্রে।
একইভাবে আরেক প্রতিবেশী সিরাজ মিয়া তিনিও একই কেন্দ্রে সাতটি গরু নিয়ে উঠেছেন। আরেকজন ফরিদা বেগম তিনি দুইটা ছাগল নিয়ে উঠেছেন ওই কেন্দ্রে।
মান্দারী-দিঘলী পাকা সড়কের পাশে একতলা দুইটি ভবনের ওই কেন্দ্রে সরেজমিনে দেখা যায়, কেন্দ্রের মাঠ সহ তিনপাশে থই থই পানি। ভেতরে ছয়টি কক্ষে নারী-শিশুসহ ছয়টি পরিবার আশ্রয় নিয়েছে। আর দুইটি বারান্দায় ১৩টি গরু, দুইটি ছাগল, পৃথক খাঁচায় অনেকগুলো হাঁস-মুরগি। সঙ্গে সামান্য কিছু খড়কুটো। বারান্দার এককোণে চলছে রান্নাসহ গৃহস্থালি কাজ। আর বাকী বারান্দায় গবাদি পশুর রাখা হয়েছে। এক ছাদের নিচে মানুষ আর গবাদি পশু মিলেমিশে থাকছে এ যেন এক করুন পরিণতি।
খামারি হেলাল উদ্দিন বলেন, স্কুল থেকে অদূরে পূর্বদিকে আমাদের বাড়ি। বুক পরিমাণ পানি বাড়ির উঠানে। বসত ঘরের অর্ধেক পানির তলে। গোয়াল ঘর ভেঙে গেছে। নিজেরা না হয় কোনো মতে খেয়ে না খেয়ে স্বজনদের বাড়িতে গিয়ে আশ্রয় নিতে পারতাম। কিন্তু গরুগুলো নিয়ে পড়েছি বিপদে। তাই এখানে পরিবারসহ গরুগুলোকে নিয়ে উঠেছি।
আরেক খামারি সিরাজ মিয়া বলেন, আমার ১৩টি গরু। সাতটি এখানে আশ্রয়কেন্দ্রে উঠাতে পেরেছি। বাকী ছয়টি অন্য একজনের বাড়ির উঠানে রেখে এসেছি। গরুগুলোর খড়-ঘাসসহ খাবারের মারাত্মক সংকটে পড়েছে।
তিনি আরও বলেন, পাশের বাজার থেকে আধা কেজি করে খৈল কিনে এনে সামান্য কিছু ভিজা খড়ের সঙ্গে মিশিয়ে গরুকে খেতে দেই। এভাবে আর বেশি দিনও চলা যাবে না। এদিকে গরুগুলো অর্ধাহারে আর পানির কারণে অসুস্থ হয়ে পড়ছে। প্রাণিসম্পদের কারও সঙ্গে যোগাযোগও করতে পারছি না। গরুগুলোর কোনো চিকিৎসা করাতেও পারছি না।
গিয়াস উদ্দিন ও মিনহাজ নামের দুইজন জানান, তাদের বাড়ি এখানকার পাকা সড়ক থেকে অনেক দূরের গ্রামে। তাদের পৃথক খামার রয়েছে। পানি উঠার পর পরিবার পরিজনদের অনেক দূরে আত্মীয়দের বাড়িতে রেখে এসেছেন। আর খামারের গরুগুলো নিরাপদ আশ্রয়ের জন্য এখানে পাকা সড়কের পাশে একজন থেকে একটু জায়গা চেয়ে নিয়েছেন। সেখানে একটা একচালা দিয়ে দুইজনে আপাতত ১৮টি গরুর আশ্রয় গড়ে তুলেছেন।
তারা আরও জানান, গরুগুলোকে পরিমাণ মতো খাবার সরবরাহ করতে পারছেন না। খড় পচে গেছে। দানাদার খাবারের দামও বেড়েছে।
এদিকে লক্ষ্মীপুর জেলা প্রাণিসম্পদ বিভাগ সূত্রে জানা যায়, লক্ষ্মীপুরের পাঁচটি উপজেলার ১৩ হাজার ৭০০ একর চারণ ভূমি প্লাবিত হয়েছে। বন্যায় ক্ষতির শিকার হয়েছে ২২ হাজার ৪১৩টি গরু, দুই হাজার ৮৮৯টি মহিষ, ১৩ হাজার ৪১৯টি ছাগল, ৯৬০টি ভেড়া, ২১ হাজার ৭৮৫ টি হাঁস ও প্রায় চার কোটি ২০ হাজার মুরগি। এছাড়া ১০৮টি খামারের ৪৪৫টি গরু, ১৯০টি হাঁস-মুরগির খামারের তিন লাখ ৩৬ হাজার হাঁস-মুরগি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
মারা গেছে ১৮টি গরু, ৫২টি ছাগল ও ১৫টি ভেড়া, এক লাখ ৫১ হাজার মুরগি ও ৯৭৩টি হাঁস। সবমিলিয়ে গবাদি পশু ও হাঁস-মুরগিতে ছয় কোটি ৪১ লাখ ৫৮ হাজার ৫০০ টাকার ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে।
এছাড়াও দুই কোটি ৮৬ লাখ ৭ হাজার ৫০০ টাকার খড়, সাত কোটি ৭১ হাজার ২০০ টাকার দানাদার খাদ্য, তিন কোটি ৭০ লাখ টাকা মূল্যের ঘাস বিনষ্ট হয়েছে। ১০ হাজার ৯৭৩ হাঁস-মুরগি ও ৪১৩ গবাদি পশুকে চিকিৎসা প্রদান করা হয়েছে।
জেলা প্রাণী সম্পদ কর্মকর্তা ডা. কুমুধ রঞ্জন মিত্র বলেন, প্রথম দিকে কিছুটা ঝুঁকি ছিল। আমরা সার্বক্ষণিক মনিটর করেছি। আপাতত গবাদিপশুর তেমন কোনো ঝুঁকি নেই। আমরা উপজেলা কর্মকর্তাদের মাধ্যমে নিয়মিত খোঁজ-খবর রাখছি।
তিনি আর বলেন, গো-খাদ্যের কিছুটা সংকট রয়েছে। এ অবস্থায় প্রত্যেক উপজেলায় এক লাখ টাকা করে বরাদ্দ বিতরণ করা হয়েছে। ক্ষয়ক্ষতির তালিকা পাঠানো হয়েছে। আরও বরাদ্দ এলে চাষি ও খামারিদের মধ্যে বিতরণ করা হবে।
বাংলাদেশ সময়: ০৯০৮ ঘণ্টা, আগস্ট ২৮, ২০২৪
এসএম