লক্ষ্মীপুর: ‘অভাবের সংসার। আমার ছেলে সেই ছোটবেলা থেকে সংসারের হাল ধরেছে।
কথাগুলো বলছিলেন ঢাকায় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত পারভেজ হোসেনের (২২) মা ফাতেমা বেগম। তিনি জানান, ঘটনার একদিন আগে পারভেজের সঙ্গে কথা হয় তার মা ফাতেমা বেগমের। ছেলে ফোনে তার মাকে বলে ‘মা আমি বাঁচবো না, না খেয়েই মারা যাবো। ’ প্রতিউত্তরে তার মা বলেন, ‘বাবা তুই বাড়ি চলে আয়। মা যদি এক মুঠো খেতে পারি, তুইও পারবি। তবে ছেলেটি না খেয়ে মারা না গেলেও, গুলি খেয়ে ঠিকি মারা গেল। ’
জীবনের সঙ্গে যুদ্ধ করেও বাঁচতে পারলো না। সেই ছোট বেলা থেকেই যে তার পরিবারকে বটগাছের মতো ছায়া দিয়ে আগলে রেখেছিল। পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করে সবাইকে ছেড়ে পরপারে পাড়ি জমিয়েছে পারভেজ।
পারভেজ লক্ষ্মীপুর সদর উপজেলার চন্দ্রগঞ্জ ইউনিয়নের ৮ নম্বর ওয়ার্ডের ধন্যপুর গ্রামের মিন্নত আলী হাজী বাড়ির নবী উল্যার ছেলে। ঢাকার থাই গ্লাসের দোকানে কাজ করে পরিবারের খরচ চালাতেন তিনি।
পারভেজের দুই বোন এবং ছোট আরও দুটি ভাই আছে। পারভেজকে হারিয়ে এখন পুরোপুরি অসহায় হয়ে পড়েছে তার পরিবার। অভাবের সংসারে যেন ঘোর অন্ধকার নেমে এসেছে।
জানা গেছে, বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের সময় ৪ আগস্ট রাজধানীর মিরপুর ১০ নম্বরে আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয়ের সামনে পারভেজের মাথায় গুলি লাগে। এরপর এক মাস আট দিন চিকিৎসাধীন থেকে ১২ সেপ্টেম্বর সকালে রাজধানীর ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরো সায়েন্সেস হাসপাতালের ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিটে (আইসিইউ) তিনি মারা যান। তিনি মিরপুর ১০ নম্বরে সেনপাড়া থাই গ্লাসের দোকানে কাজ করতেন।
পারভেজের মা ফাতেমা বেগম বলেন, ঢাকার মিরপুর ১০ নম্বরে স্ত্রী রুপা আক্তারকে নিয়ে পারভেজ ভাড়া বাসায় থাকতেন। আন্দোলনের সময় দোকান বন্ধ ছিল। তার বাসায়ও পর্যাপ্ত খাবার ছিল না। এজন্য আমাকে বলেছে মা ঘরে চাল নেই, না খেয়েই মারা যাবো মনে হচ্ছে। আমি চলে আসতে বলেছি, কিন্তু তিনি আর আসেনি। তার মরদেহ এসেছে বাড়িতে। পারভেজের স্ত্রী তার বাবার বাড়ি পাবনায় চলে গেছে।
তিনি আরও বলেন, ঘটনার দিন এক ডাক্তার ফোন দিয়ে বলছে মোবাইলের মালিক কে হয় আমার? আমি বলেছি আমার ছেলে হয়। বলেছে নাম কি, বললাম পারভেজ। তখন বলেছে আপনার ছেলে গুলিবিদ্ধ হয়েছে, তাকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। পরে হাসপাতালে গিয়ে দেখি, আমার ছেলে কথা বলতে পারে না। প্রথম থেকেই একই অবস্থা, মাঝেমধ্যে হাতের ইশারা দিয়ে কিছু বুঝানোর চেষ্টা করতো, কিন্তু কিছুই বুঝতাম না।
ফাতেমা বেগম বলেন, পারভেজ ছোট বেলা থেকেই সংসার খরচ দিতেন। ছেলেটি পড়ালেখা বেশি করতে পারেনি। শিশুকাল কেটেছিল নানার বাড়িতে। চতুর্থ শ্রেণি পর্যন্ত পড়ার সুযোগ পেয়েছে। কিন্তু আমাদের অভাব অনটনের কারণে ১২ বছর বয়সেই তিনি ঢাকায় কাজের সন্ধানে যায়। সেখানে থাই গ্লাসের দোকানে কাজ শুরু করে। তার বোনদের পড়ালেখার খরচও বহন করতেন তিনি। আজ পারভেজ নেই। আগেতো সংসার খরচ পারভেজ চালাতো। সামনে চালাবে কে? তার বাবার সামর্থ্য নেই কোনো কাজ করার। তিনি মানসিকভাবে অসুস্থ।
ঢাকায় হাসপাতালে পারভেজকে দেখতে যায় তার বোন নাহিদা আক্তার। কিন্তু শেষ বারের জন্যও ভাইয়ের সঙ্গে একটি শব্দও কথা বলতে পারেনি। উল্টো তার দাবি ভাই তার সঙ্গে রাগ করেই চলে গেছে না ফেরার দেশে। তিনি বলেন, আমি হাসপাতালে গিয়েছি। ভাইকে আইসিউতে রাখা হয়েছিল। সেখানে থাকা লোকজনকে পরিচয় দিলে তারা আমাকে ভাইয়ের কাছে যেতে দেয়। ভাই প্রথমে চোখ বন্ধ করে রেখেছিল। পরে চোখ খুলে আমাকে দেখতে পেয়ে হাতে লাগানো স্যালাইনসহ বিভিন্ন ডাক্তারি সরঞ্জাম খুলতে ইশারা করে। খুলে না দেওয়ায় একপর্যায়ে ভাই আমার ওপর রাগ হয়ে গেছে। পরে হাসপাতালের লোকজন আমাকে আইসিইউ থেকে বের হয়ে যেতে বলে। ভাইয়ের কথা মনে পড়ার বিষয়ে জানতে চাইলে দুই চোখে পানি চলে আসে নাহিদার।
পারভেজের বাবা নবী উল্যা বলেন, হঠাৎ দুনিয়া ছেড়ে ছেলেটা চলে গেছে। ছেলেটার জন্য মন টানে। কুরবানির ঈদের সময়ও বাড়িতে আসেনি। বাড়িতে থাকলেতো আর ছেলেটা এভাবে মারা যেতো না।
পারভেজের চাচাতো ভাই আরাফাত হোসেন বলেন, পারভেজই পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি ছিলেন। আমার বিকাশ নম্বরের বাড়ির জন্য সবসময় টাকা পাঠাতো। বাড়িতে আসলে আমার সঙ্গেই সবচেয়ে বেশি সময় কাটাতো।
বাংলাদেশ সময়: ১২৩৮ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ২১, ২০২৪
এসএম