ঢাকা: গণঅভ্যুত্থানের সময় গত ৪ আগস্ট আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের সশস্ত্র ক্যাডারদের গুলিতে রাজধানীর মিরপুরে গুলিবিদ্ধ হয়ে প্রাণ হারান জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ইকরামুল হক সাজিদ। গত ৭ সেপ্টেম্বর তার বাবা জিয়াউল হক বাদী হয়ে ঢাকার কাফরুল থানায় মামলা করেন।
সে হত্যা মামলায় আসামি করা হয়েছে চট্টগ্রাম নগরের বহদ্দারহাটে আন্দোলনের সময় গুলিতে শহীদ তানভীর ছিদ্দিকীর চাচা ও চাচাতো ভাইদের। কাফরুল থানার মামলায় যাদের আসামি করা হয়েছে তারা ঘটনার দিন কেউই ঢাকাতে ছিলেন না। বরং তারা সবাই ওদিন চট্টগ্রাম, কক্সবাজার ও চকরিয়ায় ছাত্রদের আন্দোলনে সংহতি জানিয়ে যোগ দিয়েছিলেন। এছাড়া তারা সবাই বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত বলে জানা গেছে।
অভিযোগ মিলেছে, শহীদ তানভীর ছিদ্দিকী হত্যা মামলার পলাতক আসামি ও কক্সবাজারের মহেশখালী উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক তারেক বিন উসমান শরীফের ষড়যন্ত্রে সাজিদ হত্যা মামলার তালিকায় ঢোকানো হয়েছে তানভীরেরই স্বজনদের নাম।
জানা গেছে, তানভীর ছিদ্দিকীর পরিবার ও আত্মীয়রা দীর্ঘদিন ধরেই বিএনপি-জামায়াতের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। এমনকি এক আসামি রাজনৈতিক মামলায় ১২ বছর কারাবাস শেষে ঘটনার এক মাস আগে মুক্ত হয়েছেন। আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকেই তারা ঘরছাড়া হয়েছেন। বাড়ির প্রতিটি ইটও খুলে নিয়ে গেছে তারেক বিন উসমান শরীফের বাহিনী।
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের এমবিএ শিক্ষার্থী সাজিদ হত্যা মামলায় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালকে প্রধান আসামি করে মোট ৭৩ জনকে আসামি করা হয়েছে। এ ছাড়া অজ্ঞাতনামা আসামি করা হয়েছে আরও ১০০-১৫০ জনকে। এর মধ্যে ২৯ নং আসামি জিয়াউর রহমান (৪৫), ৪১ নং আসামি মো. কামাল (৪৩), ৫৪ নং আসামি মিজানুর রহমান মাতব্বর (৫৫) এবং ৬২ নং আসামি নাজমুল হোছাইন (৩৪) শহীদ তানভীরের আত্মীয়।
তানভীর ১৮ জুলাই চট্টগ্রামের বহদ্দারহাটে শহীদ হন। চট্টগ্রাম আশেকানে আউলিয়া ডিগ্রি কলেজের এইচএসসি পরীক্ষার্থী ছিলেন। পাঁচ বিষয়ে পরীক্ষায় অংশ নিলেও ঘাতকের বুলেট কেড়ে নেয় তানভীর ছিদ্দিকীর প্রাণ।
শহীদ তানভীর ছিদ্দিকীর পরিবারের অভিযোগ, ১৫ বছর আগে তানভীর ছিদ্দিকী হত্যার আসামি তারেক বিন উসমান শরীফ ও নোমান শরীফের সন্ত্রাসী বাহিনী ক্ষমতার প্রভাব খাটিয়ে শহীদ তানভীরের বাড়িসহ স্বজনদের শতাধিক ঘরবাড়ি পুড়িয়ে দিয়ে এলাকাছাড়া করে। সর্বশেষ ইটের টুকরোটিও নিয়ে যায় তারা। পুরো একটি গ্রাম বিস্তীর্ণ মাঠে পরিণত হয়েছে। এসময় দখল নেয় পুরো গোষ্ঠীর স্বজনদের কোটি কোটি টাকা মূল্যের ধানি জমি, লবণ চাষের জমি, চিংড়ি প্রজেক্ট ও পুকুর। এতে নিঃস্ব হয়ে পড়েন তারা।
এ ছাড়া টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজি ও সিঙ্গেল পয়েন্ট মুরিং (এসপিএম) প্রকল্প, মাতারবাড়ি গভীর সমুদ্র বন্দর ও মাতারবাড়ি কয়লা বিদ্যুৎ কেন্দ্র প্রকল্পে দুর্নীতি করে তারেক বিন উসমান শরীফ ও নোমান শরীফ শত কোটি টাকার মালিক বনে যান। এসব অবৈধ টাকায় গড়ে তুলেছেন সশস্ত্র বাহিনী। ফ্যাসিস্ট আওয়ামী সরকারের পতন হলেও তার গড়ে তোলা এ বাহিনী কালারমার ছড়ার উত্তর পাশের বিভিন্ন পাহাড়ে অবস্থান করে। পরে গত ১১ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশ নৌবাহিনী এসব পাহাড়ে অভিযান চালিয়ে আগ্নেয়াস্ত্র উদ্ধার করলেও ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যায় তারেক বিন উসমান বাহিনীর সন্ত্রাসীরা। যৌথবাহিনীর অভিযানের মুখে সন্ত্রাসী তারেক বিন উসমান ও নোমান শরীফ ঢাকায় পালিয়ে গেছেন।
শহীদ তানভীরের স্বজনরা বলেন, তারেক বিন উসমান শরীফের ষড়যন্ত্রে শহীদ সাজিদ হত্যা মামলার আসামির তালিকায় ঢোকানো হয়েছে শহীদ তানভীর ছিদ্দিকীর আত্মীয়দের নাম। এর মধ্যে মো. কামাল (৪৩) তানভীরের চাচা। তিনি কালারমার ছড়া ইউনিয়ন যুবদলের সাবেক সদস্য। কিন্তু মামলার এজাহারে লেখা হয়েছে, তিনি ঢাকা মহানগর উত্তর ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক সাগর আহমেদ শামীমের এপিএস। এ ছাড়া জিয়াউর রহমান জিয়া, মিজানুর রহমান মাতাব্বর ও নাজমুল হোছাইন তানভীরের চাচাতো ভাই। জিয়া উপজেলা যুবদলের সাবেক ক্রীড়া বিষয়ক সম্পাদক, কক্সবাজার জেলা যুবদলের সদস্য এবং কালারমার ছড়া ইউনিয়ন যুবদলের সহ-সভাপতি ছিলেন। এজাহারে তাকে জলদস্যু হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। মিজানুর রহমান মাতাব্বর ২০০১ থেকে ২০০৭ পর্যন্ত কালারমার ছড়া ইউনিয়ন ছাত্রদলের সভাপতি ছিলেন। ছিলেন উপজেলা ছাত্রদলের সহ-সভাপতিও। আর নাজমুল হোছাইনও উপজেলা যুবদলের সাবেক ক্রীড়া বিষয়ক সম্পাদক ও বর্তমানে ইউনিয়ন যুবদলের যুগ্ম আহ্বায়ক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।
এ ছাড়া বিভিন্ন সময়ে আওয়ামী লীগের সন্ত্রাসীদের হাতে নিহত হয়েছেন তানভীরের পাঁচ আত্মীয়। ২০০৬ সালের ৪ ডিসেম্বর সকাল ১০টায় ইউনিয়নের ৭ নং ওয়ার্ড যুবদলের সভাপতি উসমান গনিকে কুপিয়ে এক হাত বিচ্ছিন্ন করে হত্যা করা হয়। বিচ্ছিন্ন হাত নিয়ে জয় বাংলা স্লোগান দিয়ে পুরো এলাকায় বিজয় উল্লাস করে আওয়ামী লীগের সন্ত্রাসীরা। একইদিন ওই পরিবারের আরেক সদস্য ও ওয়ার্ড ছাত্রশিবিরের সভাপতি জয়নাল আবেদীন ধইন্নাকে হাত পা শরীর থেকে বিচ্ছিন্ন করে বস্তায় ভরে পাশের কোহেলিয়া নদীতে ফেলে দেয়। তার লাশের সন্ধান পাওয়া যায়নি। পরে ২০০৮ সালের ১৩ জুন পরিবারের আরেক সদস্য জবল চৌধুরীকে কালারমার ছড়া বাজারে প্রকাশ্যে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। তিনি ইউনিয়ন বিএনপির সভাপতি এবং উপজেলা বিএনপির যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক ও সহ-সভাপতি ছিলেন। পরবর্তীতে ২০১৮ সালে মিজানুর রহমান নামে আরেকজনকে গুলি করে হত্যা করে তারেক বিন উসমান বাহিনী।
শহীদ তানভীরের পরিবারের সদস্যরা বলছেন, আওয়ামী সন্ত্রাসীদের হামলায় পরিবারের অনেক সদস্য পঙ্গুত্ববরণ করে মানবেতর জীবনযাপন করছেন। বিভিন্ন সময়ে মিথ্যা মামলা দিয়ে হয়রানি করা হয়েছে দেড় শতাধিক আত্মীয়-স্বজনকে। পরিবারের অনেক সদস্য ১০ থেকে ১৫ বছর পর্যন্ত জেলহাজতে বন্দি ছিলেন।
শহীদ তানভীর ছিদ্দিকী পরিবারের সদস্য তারেক আজিজ ছিদ্দিকী বলেন, স্বৈরাচার সরকারের পতনের পর যখন আমরা আমাদের হারানো বসতভিটায় বাড়িঘর নির্মাণের প্রক্রিয়া শুরু করি ঠিক তখনই এ রকম একটা হত্যা মামলায় আমাদের জড়ানো হয়েছে এমন খবর পেয়ে স্তব্ধ হয়ে পড়ি।
এ বিষয়টি গুরুত্বসহকারে সঠিক তদন্ত ও নিরাপদ মানুষদের হয়রানি থেকে মুক্তি দেওয়ার জন্য আমরা ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার ও কাফরুল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার কাছে লিখিত আবেদন করেছি।
কাফরুল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ওসি কাজী গোলাম মোস্তফা বাংলানিউজকে বলেন, তানভীর ছিদ্দিকীর স্বজনেরা তথ্য উপাত্ত নিয়ে আমাদের সঙ্গে দেখা করেছেন। মামলার তদন্ত কর্মকর্তা সবকিছু সংগ্রহে রেখেছেন। বিষয়টি আমরা তদন্ত করে দেখবো। নিরপরাধ কেউ যেন ক্ষতির সম্মুখীন না হয়।
মামলার বাদী জিয়াউল হকের মোবাইল ফোনে একাধিকবার যোগাযোগ করা হলে তার নাম্বার বন্ধ পাওয়া যায়।
মামলার সাক্ষী মো. তরিকুল ইসলাম ও অয়ন আল আশরাফীর সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তারা বলেন, আমরা মামলার এসব আসামির বিষয়ে জানি না।
কীভাবে তাদের নাম এ মামলায় ঢুকানো হয়েছে সে বিষয়ে মন্তব্য করতে রাজি হননি তারা।
বাংলাদেশ সময়: ১৭১২ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ২৫, ২০২৪
বিই/টিসি