ঢাকা, মঙ্গলবার, ১১ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৬ নভেম্বর ২০২৪, ২৪ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

জাতীয়

ডাকঘরের ‘ঘর’ নেই

মো. নিজাম উদ্দিন, ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৬৪৫ ঘণ্টা, অক্টোবর ১০, ২০২৪
ডাকঘরের ‘ঘর’ নেই

লক্ষ্মীপুর: কাউকে যখন তার ঠিকানা লিখতে হয়, তখন সেখানে ওই ব্যক্তির পোস্ট অফিস বা ডাকঘরের নাম উল্লেখ করতে হয়। পোস্ট অফিসের মাধ্যমেই সে ব্যক্তির সঠিক ও নির্ভুল ঠিকানা লিপিবদ্ধ করা হয়।

 

ওই ঠিকানা অনুযায়ী তার কাছে চিঠিপত্র বা কোনো ডাক আসে। মূলত পোস্ট অফিসের মাধ্যমে একজন ব্যক্তির ঠিকানা নিশ্চিত হওয়া যায়। কিন্তু যে পোস্ট অফিসের মাধ্যমে ব্যক্তির ঠিকানা নিশ্চিত হওয়া যায়, সে পোস্ট অফিস বা ডাকঘরের ঠিকানা কোথায়? 

দেশের জেলা-উপজেলার প্রতিটা গ্রাম বা ইউনিয়নে একাধিক পোস্ট অফিস রয়েছে। এলাকার নাম অনুসারে পোস্ট অফিসের নামকরণ হয়। জেলা-উপজেলা কিংবা ইউনিয়ন পর্যায়ে চিঠিপত্র, পার্সেল বা পোস্ট অফিসের যাবতীয় কার্যক্রম পরিচালনার জন্য একটি করে অফিস রয়েছে।  

কিন্তু গ্রাম বা ইউনিয়ন পর্যায়ের লোকজন নিজেদের ঠিকানায় যে পোস্ট অফিসের নাম দেন, তাতে পোস্ট অফিসের কোনো অস্তিত্বই নেই। শুধুমাত্র এলাকার নাম অনুসারে ‘পোস্ট অফিস’ নাম ব্যবহার করা হয়।  

স্বাধীনতার পর বাংলাদেশে ডাক বিভাগের প্রচলন শুরু হওয়ার পর গ্রামগঞ্জে কোনো অবকাঠামোগত অফিস ছাড়াই এলাকাভিত্তিক পোস্ট অফিস নাম দেওয়া হয়।  

প্রযুক্তির প্রভাবে এক সময়ের কর্মচঞ্চল ডাক বিভাগের কার্যক্রম বদলে গেলেও সরকারি কিংবা বেসরকারি সংস্থার চিঠি ও কাগজপত্র আদানপ্রদান হয় ডাক বিভাগের মাধ্যমে।

লক্ষ্মীপুর সদর উপজেলার লাহারকান্দি ইউনিয়ন। জেলা শহরের পাশের এ ইউনিয়নে প্রায় অর্ধলক্ষাধিক লোকজনের বসবাস। ইউনিয়নের চারটি পোস্ট অফিসের ঠিকানা ব্যবহার হয়। এর মধ্যে লক্ষ্মীপুর পোস্ট অফিস, জকসিন পোস্ট অফিস, রামানন্দি পোস্ট অফিস, পিয়ারাপুর পোস্ট অফিস। চারটি অফিসের মধ্যে শুধু লক্ষ্মীপুর পোস্ট অফিস এর অস্তিত্ব আছে, যেটি জেলা পোস্ট অফিস। কিন্তু বাকি তিনটি পোস্ট অফিসের কোনো অস্তিত্ব নেই। কিন্তু ইউনিয়নের বাসিন্দারা তাদের ঠিকানায় ওই তিনটি ‘অদৃশ্য’ পোস্ট অফিসের নাম যুগ যুগ ধরে উল্লেখ করে আসছেন।

অফিস নেই, কিন্তু কীভাবে চলে এসব পোস্ট অফিসের কার্যক্রম- তা দেখতে লাহারকান্দি ইউনিয়নের রামানন্দি গ্রামে গিয়ে জানা যায়, ‘রামানন্দি পোস্ট অফিসে’র নাম আছে কিন্তু বাস্তবে পোস্ট অফিসের কোনো অফিস নেই। এ পোস্ট অফিসের আওতায় একজন পোস্ট মাস্টার, একজন পিয়ন ও একজন রানার কাজ করেন।

রামানন্দি পোস্ট অফিসের আওতায় যে চিঠিপত্র বা পার্সেলগুলো আসে, কিংবা গ্রহণ করা হয়- সেগুলোর কার্যক্রম এবং গ্রাহকসেবা চলে একটি চায়ের দোকানে।

স্থানীয় লোকজন জানান, রামানন্দি পোস্ট অফিস নামে একটি পোস্ট অফিসের নাম থাকলেও এ অফিসের কোনো অস্তিত্ব বা অবকাঠামোগত কোনো অফিস নেই। স্বাধীনতার পর যখন এ পোস্ট অফিসের কার্যক্রম শুরু হয়, তখন থেকেই অদৃশ্য অফিস কিংবা চায়ের দেকানে বসে চিঠিপত্র বিলি চলে আসছিল।

ওই পোস্ট অফিসের ডাক পিয়ন শামছুল আলম। অবকাঠামোগত অফিস না থাকার বিষয়টি নিয়ে তিনি বলেন, প্রায় ৩০ বছর ধরে এ পোস্ট অফিসের পিয়ন হিসেবে চাকরি করে আসছি। কিন্তু কোনো অফিস পাইনি। কয়েক বছর আগে রামানন্দি গ্রামের একটি সামাজিক সংগঠনের ক্লাবকে অফিস হিসেবে ব্যবহার করতাম। এখন সেটিও নেই। গ্রামের একটি চায়ের দোকানে বসে প্রতিদিনকার কার্যক্রম চালাই। একটি স্থায়ী অফিসের জন্য আমি জেলা কার্যায়লের মিটিংয়ে বলেছি। কিন্তু কোনো দাতা জমি দান না করায় আজও স্থায়ী কার্যালয় স্থাপন সম্ভব হয়নি।

তিনি বলেন, ডাকঘর বা পোস্ট অফিসের নির্দিষ্ট অফিস না থাকায় চিঠিপত্র নিয়ে নানা বিড়ম্বনায় পড়তে হয়। ঠিকমতো কোথাও বসার জায়গা নেই, চিঠি রাখার জায়গা নেই। সরকারি গুরুত্বপূর্ণ চিঠি বা ডকুমেন্টস আসে আমাদের কাছে। সেগুলো গ্রাহক পর্যায়ে পৌঁছে দিতে হয়৷ কিন্তু নির্দিষ্ট অফিস না থাকায় গ্রাহকসেবা বিঘ্নিত হচ্ছে।

লাহারকান্দি ইউনিয়নের জকসিন পোস্ট অফিসের কার্যক্রম চলে জকসিন বাজারের একটি দোকান থেকে। আর একই ইউনিয়নের পিয়ারাপুর পোস্ট অফিসের কার্যক্রমও চলে স্থানীয় পোস্ট মাস্টারের ব্যক্তিগত দোকানে।

শুধু যে লাহাকান্দি ইউনিয়নের অবস্থা এমন- তা কিন্তু নয়। লক্ষ্মীপুর জেলার ডাক বিভাগ জেলা সদর উপজেলার একাংশ, রায়পুর, কমলনগর ও রামগতি উপজেলা নিয়ে বিস্তৃত। বাকি রামগঞ্জ উপজেলা এবং সদরের চন্দ্রগঞ্জ এলাকা পরিচালিত হয় নোয়াখালী ডাক বিভাগ থেকে।

সূত্র জানায়, লক্ষ্মীপুর ডাক বিভাগের আওতাধীন একটি জেলা অফিস, দুটি উপজেলা ডাকঘর, ১০টি উপ-ডাকঘর ও ৫২টি শাখা ডাকঘর রয়েছে।

প্রতিটি সাব পোস্ট অফিসে একজন ইডিএ (পোস্ট মাস্টার), একজন ইডিডিএ (পিয়ন) ও একজন ইডিএমসি (রানার) নিযুক্ত রয়েছে। একইভাবে শাখা পোস্ট অফিসগুলোতেও ওই সব পদের তিনজন করে লোক কাজ করেন। তবে শাখা পোস্ট অফিসের কেউই নিয়মিত বেতনভুক্ত নন। সবাই মাস্টাররোলে নামমাত্র সম্মানীতে কাজে নিযুক্ত রয়েছেন।

ডাক বিভাগের শাখা অফিসগুলো শুধুমাত্র নামে, কিন্তু এর বেশিরভাগই অবকাঠামোগত কোনো অফিস নেই।

৫২টি শাখা অফিসের মধ্যে ১০ থেকে ১২টির অফিস রয়েছ। বাকি অফিসগুলো অদৃশ্য। অফিস সংশ্লিষ্টরা চায়ের দোকান, হাটবাজার, ক্লাব, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বা নিজের বাড়িতে বসে পোস্ট অফিসের কার্যক্রম পরিচালনা করেন।

লাহারকান্দি ইউনিয়নের রামানন্দি গ্রামের বাসিন্দা রবিন হোসেন বাংলানিউজকে বলেন, আমাদের গ্রামের নামানুসারে আমাদের পোস্ট অফিসের নাম। কিন্তু আমাদের গ্রামে কোনো অফিস নেই। পথে-ঘাটে ডাক সংক্রান্ত কার্যক্রম পরিচালিত হতে দেখে আসছি।

জেলার কমলনগর উপজেলার চর লরেন্স ইউনিয়নের বাসিন্দা সানা উল্যা বলেন, আমাদের ডাকঘরের নাম তোরাবগঞ্জ বাজার। কিন্তু এ বাজারে কোনো ডাকঘরের অস্তিত্ব নেই। ডাক বিভাগের লোকজন কারো দোকানে বা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বসে তাদের কার্যক্রম চালান।  

এ বিষয়ে জানতে চাইলে লক্ষ্মীপুর জেলার পোস্ট অফিস ইন্সপেক্টর আব্দুর রহিম বাংলানিউজকে বলেন, সরকারের নীতিমালা অনুযায়ী যেসব এলাকায় স্থানীয় দাতা গোষ্ঠী জমি দান করেছেন, সেসব জায়গায় শাখা পোস্ট অফিস বাস্তবে রয়েছে। আর যেখানে জমি অনুদান পাওয়া যায়নি সেখানে স্কুল, কলেজ, মাদরাসা কিংবা অন্য কোনো আশ্রয়ে পোস্ট অফিসের কাজ চালানো হয়। কোনো এলাকায় জমি অনুদান পেলেই অফিস ঘর করে দেওয়া হবে।

বাংলাদেশ সময়: ১৬৩৩ ঘণ্টা, অক্টোবর ১০, ২০২৪
এসআই
 

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।