ঢাকা, শুক্রবার, ৭ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২২ নভেম্বর ২০২৪, ২০ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

জাতীয়

শহীদ রাজিবের শিশুপুত্রের প্রশ্ন, বাবা কবে আসবে?

মুহাম্মদ মাসুদ আলম, ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১১২২ ঘণ্টা, অক্টোবর ১৪, ২০২৪
শহীদ রাজিবের শিশুপুত্রের প্রশ্ন, বাবা কবে আসবে?

চাঁদপুর: মা, দাদা-দাদির কাছে জানতে চায় বাবা কোথায়। বাবা কবে আসবে।

চার বছর বয়সী শিশু ইব্রাহীমের এমন প্রশ্নের জবাব দিতে পারে না কেউ।  

চাঁদপুরের মতলব উত্তর উপজেলার গজরা ইউনিয়নের টরকী এওয়াজ গ্রামের রজ্জব আলীর ছেলে আরিফ হোসেন রাজিব (২৯)। গত ২০ জুলাই গাজীপুর বোর্ডবাজার আইইউটি গেট এলাকায় ছাত্র-জনতার আন্দোলনে গিয়ে পেটে গুলিবিদ্ধ হয়ে শহীদ হন। তারই শিশু পুত্র ইব্রাহীম। স্ত্রীসহ পুরো পরিবারে এখনও শোকাহত।

সম্প্রতি সরেজমিনে রাজিবের বাড়িতে গিয়ে দেখা গেছে, জরাজীর্ণ ঘরের সামনে বসে আছেন পরিবারের সদস্যরা। রাজিবের বাবা রজ্জব আলী পেশায় ছিলেন কৃষক। তবে গত কয়েক বছর আগে কাজে গিয়ে ডান হাত অকেজো হয়ে পড়েন। সেই থেকে তিনি কর্মক্ষম। মা আমেনা বেগম গৃহিণী।

তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, রাজিবের চার বোন। ভাই বোনদের মধ্যে রাজিব দ্বিতীয়। সবার বড় বোন মনি আক্তার, ছোট বোন নুরজাহান, মুক্তা ও মীম। মীম ছাড়া বাকী তিন বোনের বিয়ে হয়েছে। ছোট ভাই শরীফ বয়স ১৭। সে বোন মুক্তার সঙ্গে গাজীপুর একটি পোশাক কারখানায় শ্রমিক কাজ করতেন। রাজিবের মৃত্যুর পর পরিবারের অনেকেই গ্রামের বাড়িতে অবস্থান করছেন।

আরিফের বাবা-মা এক সময় পার্শ্ববর্তী কুমিল্লা জেলার হোমনায় থাকতেন। সেখানে আমেনা বেগম মানুষের বাড়িতে কাজ করে ছেলে-মেয়েদের বড় করেছেন। গত প্রায় এক যুগ ধরে নিজ বাড়ি মতলবে চলে আসেন তারা।

রাজিবের মৃত্যুর বর্ণনা দিলেন ছোট বোন মুক্তা ও ভাই শরীফ। মুক্তা বলেন, পোশাক কারখানায় কাজ করার কারণে গাজীপুর বোর্ড বাজার এলাকায় ভাড়া বাসায় থাকতেন তারা। সেখানে গিয়ে ভাঙারি দোকানে কাজ নেন ভাই রাজিব। দোকান মালিক থেকে টাকা নিয়ে ভাঙারি কিনে আনতেন। তার আয়েই চলছিল বাবা-মার সংসার। ঘটনার দিন ২০ জুলাই বিকেলে কাউকে না জানিয়ে কাজ রেখে ছাত্র-জনতার আন্দোলনে যায়। সেখানে আইইউটি গেটের সামনে ছাত্র-জনতার সঙ্গে সংঘর্ষ হয় আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর। ওই স্থানেই পেটে গুলিবিদ্ধ হন রাজিব। ভাইয়ের পরিচিত ফজলু নামে এক ব্যক্তি আমাকে ফোন দিয়ে জানান তিনি গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা গেছেন।

ছোট ভাই শরীফ বলেন, ২০ জুলাই ভাই আমার সঙ্গে ফোনে কথা বলেন। আমাকে বলেন তুমি কোথায়। আমি ভাইকে জানিয়েছি আন্দোলনের কারণে কারখানা বন্ধ। বাসায় চলে যাচ্ছি। আর কথা হয়নি। পরে জানতে পারি গুলিবিদ্ধ হয়েছেন তিনি। স্থানীয় গুটিয়া ইন্টারন্যাশনাল মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে এলে চিকিৎসক ভাইকে মৃত ঘোষণা করেন।

শরীফ আরও বলেন, ভাইয়ের মৃত্যুর সংবাদ পেয়ে আমরা ওই হাসপাতালে যাই। সেখান থেকে রাতেই ভাইয়ের মরদেহ নিয়ে আসি বাড়িতে। পরদিন সকালে এলাকায় নামাজে জানাজার পর স্থানীয় কবরস্থানে দাফন করা হয়।

ছোট বোন মুক্তা আরও বলেন, রাজিব গাজীপুর থাকাকালীন সময়ে গত প্রায় পাঁচ বছর পূর্বে নেত্রকোনা জেলার সদরের শাসনকান্দা এলাকার রাকিব মিয়ার মেয়ে শরীফাকে বিয়ে করেন। স্ত্রীকে নিয়ে প্রথমে গ্রামের বাড়িতে থাকলেও ভাঙারি কাজে আয় রোজগার কম থাকায় গাজীপুরে ভাড়া বাসায় চলে আসেন।

রাজিবের স্ত্রী শরীফা বেগম বলেন, তার বাবা রাকিব মিয়া (৫৫) পেশায় আইসক্রিম বিক্রেতা। মা নাছিমা আক্তার (৪০) গৃহিণী। ঘটনার দিন তার স্বামী রাজিব কাজে বের হয়ে যান। এরপর আর কথা হয়নি। ছাত্র-জনতার আন্দোলনে প্রথমে যোগ দেয়নি। কিন্তু গাজীপুরে বোর্ডবাজার এলাকায় প্রথমেই আন্দোলন শুরু হয় ২০ জুলাই। ওইদিনই তিনি আন্দোলনে যান। সেখানে গিয়ে তিনি গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান।

রাজিবের বাবা রজ্জব আলী কথা কম বলেন। শারীরিক অসুস্থতার কারণে এবং ছেলেকে হারিয়ে তিনি শোকাহত। কারণ ছেলের আয় রোজগারে চলতে তাদের সংসার। বাড়িতে রাজিবের মা, ছোট বোন মীমসহ থাকতেন।

ছেলেকে হারিয়ে শোকাহত মা আমেনা বেগম কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, ছেলে আমার দ্বিতীয় শ্রেণি পর্যন্ত পড়েছে। ছোট বেলা থেকে রিকশা চালিয়ে সংসারে খরচ দিয়েছে। এরপর এলাকায় ভাঙারি দোকানে কাজ করেছে। মেয়ে মুক্তার বিয়ের পরে গাজীপুরে চলে যায়। বিয়ের পর বউকে নিয়ে বাড়িতে ছিল প্রায় দেড় বছর। আয় রোজগার কম হওয়ায় গাজীপুর চলে যায়। কিছুদিন পূর্বে আমার স্বামী গাজীপুর গেলে ছেলে আমার নাতিকে মাদরাসায় পড়ানোর জন্য অনুরোধ করে এবং নাতিকে দাদার হাতে তুলে দেয়। তখনই তার কথাগুলো আমাদের সবাইকে ব্যথিত করে।

তিনি আরও বলেন, ছেলের মৃত্যুর পরে এলাকার লোকজনের সহযোগিতায় মিলাদ ও দোয়া অনুষ্ঠিত হয়েছে। রাজনৈতিক নেতারাও এসে খোঁজ খবর নিয়েছেন। আমাদের কোনো সমার্থ ছিল না ছেলের জন্য কোনো আয়োজন করার। তবে সরকারিভাবে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা নগদ ১০ হাজার টাকা এবং কিছু ফল দিয়ে গেছেন।

আমেনা বেগম বলেন, ছেলেকে হারিয়ে আমরা এখন দিশেহারা। ছেলের বউ, নাতি এবং আমার অসুস্থ স্বামীকে নিয়ে সংসার চলার অবস্থা নেই। ছোট ছেলেও কাজ হারিয়ে বেকার।

বাংলাদেশ সময়: ১১২২ ঘণ্টা, অক্টোবর ১৪, ২০২৪
এসএম

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।