সিরাজগঞ্জ: যমুনার ভাঙনে সব হারানো শাহীনুর খাতুন (২৭) এক টুকরো সুখের আশায় পাঁচ লাখ টাকা ঋণ নিয়ে স্বামীকে মালয়েশিয়ায় পাঠিয়েছেন। ভেবেছিলেন স্বামী ইমরান হোসেন সরকার মালয়েশিয়ায় কাজ করে টাকা পাঠাবে-সেই টাকায় ঋণ শোধ হবে, নতুন বাড়ি হবে, ঘর হবে, সন্তানদের মানুষের মতো মানুষ করে বড় করবে।
এক বছর ধরে মালয়েশিয়ায় পাড়ি জমিয়েও কোনো কাজ পায়নি ইমরান হোসেন। এখন বিদেশে বেকার বসে খেয়ে না খেয়ে অসহায় দিন কাটাচ্ছে স্বামী ইমরান, আর দেশে তিন শিশুসন্তান নিয়ে মানবেতর জীবনযাপন করতে হচ্ছে গৃহবধূ শাহীনুরকে।
সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুর উপজেলার গোপালপুর গ্রামের মঞ্জিল ফকিরের মেয়ে শাহীনুর খাতুনকে সন্তানদের মুখে আহার তুলে দিতে এখন অন্যের বাড়িতে ঝিয়ের কাজ করতে হচ্ছে।
জানা যায়, উপজেলার কৈজুরী ইউনিয়নের হাঁট পাচিল গ্রামের গিয়াস উদ্দিন সরকারের ছেলে ইমরান সরকারের সাথে ১০ বছর আগে বিয়ে হয় শাহীনূরের। শ্বশুরের ছিল বড় বাড়ি। পরিবার নিয়ে সবাই ওই বাড়িতে বসবাস করতেন। স্বামী ইমরান মৎস্যজীবীর কাজ করে সংসার চালাতেন। বছর দুয়েক আগে আগ্রাসী যমুনার ভাঙনে শ্বশুরবাড়ি সম্পূর্ণ নদীগর্ভে বিলিন হয়ে যায়। এরপরই বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় পুরো পরিবারটি। ইমরান-শাহীনূর দম্পতি গোপালপুর এলাকার একটি ভাড়া বাড়িতে বসবাস করতে শুরু করেন। কর্মহীন হয়ে পড়ে ইমরান, তিনটি সন্তান নিয়ে সংসারে নেমে আসে অভাব অনটন।
সংসারের অভাব ঘোচাতে এবং নতুন সুখের স্বপ্নের আশায় পার্শ্ববর্তী চর কৈজুরী গ্রামের আমিরুল ইসলামের পরামর্শে মালয়েশিয়ায় পাড়ি জমানোর সিদ্ধান্ত নেয় ইমরান। ২০২৩ সালের অক্টোবর মাসে ৫ লাখ টাকা ঋণ করে ইমরান মালয়েশিয়ায় যান।
কিন্তু এক বছর ধরে মালয়েশিয়ায় গেলেও এখন পর্যন্ত কোনো কাজ পাননি ইমরান। বাড়িতে পাঠানো তো দূরের কথা, উল্টো নিজের খাবার জন্য বাড়ি থেকে টাকা নিতে হচ্ছে তাকে।
এদিকে ৯ বছর বয়সী ইশামনি, ৭ বছরের সোহাগ ও ৩ বছর বয়সী সন্তান স্বাধীনকে নিয়ে চরম মানবেতর জীবনযাপন করতে হচ্ছে শাহীনুরকে। সংসার চালাতে ও স্বামীকে পাঠাতে আরও ৫০ হাজার টাকা কিস্তির লোন তুলতে হয়েছে তাকে।
শাহীনুর বলেন, আমিরুল মালয়েশিয়ায় থাহে, প্রত্যেকবার দ্যাশে আইস্যা কোম্পানির মাধ্যমে মেলা লোক মালয়েশিয়ায় নেয়। আমার স্বামী তার কথামতোই গ্যাছে, কিন্তু আর আমিরুল ফির্যা আসে নাই। আমার স্বামীও কাজকাম ছাড়া এক বছর ধইর্যা বইস্যা আছে।
কাঁদতে কাঁদতে শাহীনুর আরও বলেন, অন্যের বাড়িতে কাম কইর্যা ৫০-১শ ট্যাহা পাই, তাই দিয়্যা ছওয়ালপালের মুহে আহার তুলে দেই। রাইতে ভাত রাইন্দ্যা পরদিন হারাদিন পোলাপানগুলোরে পান্তা খাওয়া রাহি। মালয়েশিয়ায় স্বামীর কষ্টের কথা হুইন্য্যা আরও খারাপ লাগে। আর প্রত্যিক দিনই পাওনাদরগোরে তাদাগা, গালিগালাজ শুইনতে অয়। জানি না আল্লাহ কবে আমাগোরে মুহে ফির্যা তাহাইবো।
মেয়ের কষ্টে কেঁদে ফেলেন শাহীনুরের বাবা মঞ্জিল ফকিরও। তিনি বলেন, নদীভাঙনের পরে মেয়ে-জামাই অসহায় পড়ে। নিজের গ্রামে একটি বাড়ি ভাড়া করে দিয়েছি। সংসার চালাতে পারছিল না। তখন জামাই ঋণ করে বিদেশে গেল। কিন্তু বিদেশে গিয়ে কোনো কাজ পায় নাই। এখন আমারই সংসার চলে না, মেয়েকে কিভাবে দেখবো। বাধ্য হয়ে মেয়ে শাহীনুর অন্যের বাড়িতে কাজ করে।
স্থানীয় স্কুলশিক্ষক মো. শাহীন আলম বলেন, শাহীনুর খুব অভাবে রয়েছে। তার স্বামী বিদেশে গিয়েও কোনো কাজ না পেয়ে খেয়ে না খেয়ে দিন কাটাচ্ছে। এদিকে তিনটি ছোট ছেলে-মেয়ে নিয়ে শাহীনুর অন্যের বাড়িতে ঝিঁয়ের কাজ করছে।
বাংলাদেশ সময়: ১৭২৪ ঘণ্টা, নভেম্বর ০২, ২০২৪
এএটি