ঢাকা, শনিবার, ২৪ কার্তিক ১৪৩১, ০৯ নভেম্বর ২০২৪, ০৭ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

জাতীয়

সরকারের নিষেধাজ্ঞাকে ‘বুড়ো আঙুল’ দেখিয়ে পলিথিন চলছেই

সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট  | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৪১৩ ঘণ্টা, নভেম্বর ৩, ২০২৪
সরকারের নিষেধাজ্ঞাকে ‘বুড়ো আঙুল’ দেখিয়ে পলিথিন চলছেই

ঢাকা: দেশের কাঁচাবাজারসহ খোলাবাজারে ১ নভেম্বর থেকে পলিথিন ও পলিপ্রোপাইলিনের তৈরি ব্যাগের ব্যবহার নিষিদ্ধ করে পরিবেশ অধিদপ্তর। তিন দিন পেরোলেও তা কার্যকর হতে দেখা যায়নি।

গত দেড় মাস আগে এই পলিথিন নিষিদ্ধের ঘোষণা দিয়েও বাজারে থেকে এখনও উঠেনি ক্ষতিকর এই পণ্য।  

সরকারের নিষেধাজ্ঞাকে ‘বুড়ো আঙুল’ দেখিয়ে রাজধানীর কাঁচাবাজার থেকে পাড়া-মহল্লায় অবাধে ব্যবহার হচ্ছে পলিথিন। এমনকি অনেক দোকানে বিকল্প ব্যাগ রাখতেও দেখা যায়নি। ফলে ক্রেতাদের পলিথিনে করেই কাঁচাবাজার নিয়ে যেতে দেখা গেছে। দীর্ঘদিনের এ অভ্যাস পরিবর্তনে সময় প্রয়োজন, বলছেন ক্রেতারা। উৎপাদন বন্ধ করে সরবরাহ কমানোর পাশাপাশি স্বল্প মূল্যে বিকল্প ব্যাগ বাজারে রাখার তাগিদ তাদের।

রোববার (৩ নভেম্বর) সরেজমিনে রাজধানীর সূত্রাপুর বাজার, ধূপখোলা মাঠ বাজার, রায়সাহেব বাজারসহ এসব এলাকার অলিগলি ঘুরে দেখা গেছে, এখনো বাজারে দেদারসে ব্যবহার হচ্ছে পলিথিন ব্যাগ। মুদি দোকান, সবজি বিক্রেতা, মাছ-মাংসের বাজার, খাবারের হোটেলসহ সব স্থানেই ব্যবহার হচ্ছে পলিথিন। বাজারের কোথাও ক্রেতা-বিক্রেতার হাতে দেখা যায়নি পাটের ব্যাগ কিংবা পরিবেশবান্ধব ব্যাগ।  

ছোট-বড় সব ব্যবসায়ীরা জানান, পলিথিন বন্ধ হওয়া উচিত, সেটা সবাই জানেন। কিন্তু মানেন না, আগে সবাই কাপড়ের ব্যাগ ব্যবহার করতেন। যখন পলিথিন বের হলো তখন কাপড়ের ব্যাগ চলে গেল। তখন মালামাল নিতে ব্যাগ নিয়ে আমাদের চিন্তা করতে হতো না। ক্রেতারাই ব্যাগ নিয়ে আসতেন। এখন যদি বলি ব্যাগ নেই। তাহলে ক্রেতা চলে যায়। তাই বাধ্য হয়েই পলিথিন রাখতে হয়। আর দীর্ঘ দিনের অভ্যাস তো আর দুই-চার দিনে চলে যাবে না।  

অবাধে বিক্রি হচ্ছে পলিথিন ব্যাগ

তারা আরও বলেন, পলিথিন বন্ধ করতে হলে আগে উৎপাদন পর্যায়ে বন্ধ করতে হবে। এ ছাড়া পলিথিনের বিকল্প অন্য কোনো ব্যাগ পাওয়া যাচ্ছে না, কীভাবে দেওয়া হবে। ফলে নিরুপায় হয়ে পলিথিনেই করেই মালামাল দেওয়া হচ্ছে। ক্রেতারা যদি ব্যাগ নিয়ে আসেন, বিক্রেতারা তো সেই ব্যাগেই জিনিসপত্র দেবেন। কিন্তু কোনো ক্রেতাকে তো পাটের ব্যাগ আনতে দেখা যাচ্ছে না।

রায় সাহেব বাজারের সবজি বিক্রেতা মো. নুরে আলম বাংলানিউজকে বলেন, পলিথিন নিষিদ্ধ হয়েছে শুনেছি। কী করব ক্রেতারা তো ব্যাগ নিয়ে আসেন না। পলিথিন ছাড়া অন্য কোনো ব্যাগ যে দেব, তার দাম অনেক। একজন ক্রেতা যদি ১০০ টাকার জিনিসপত্র নেন, তাকে যদি আমি ২০ টাকার ব্যাগ দিই, তাহলে আমি লাভ করব কী? হ্যাঁ, ক্রেতারা যদি ব্যাগের টাকা দেন, তাহলে আমাদের পোষাবে। আমাদের প্রতিদিন ২০০ থেকে ৩০০ টাকার পলিথিন লাগে। এর বিপরীত কোথাও থেকে যে পাটের ব্যাগ কিনব সেই ব্যবস্থাতো নেই। ব্যাগ পেলে দোকানে ব্যাগ ঝুলিয়ে রাখতাম।

ধূপখোলা মাঠ সংলগ্ন বাজারের মাংস বিক্রেতা কাদের মিয়া বলেন, বাজারে খুব কম মানুষ ব্যাগ নিয়ে আসেন। তাই বাধ্য হয়ে পলিথিন দিই। কারণ এ ব্যাগ সস্তা, সহজেই পাওয়া যায়। বাজারে যদি না পাওয়া যেতো তাহলে তো আমরা দিতাম না। সরকার যদি সুলভ মূল্যে ছোট-বড় ব্যাগ দেয়, তাহলে মানুষ কিনবে।

সূত্রাপুর বাজারের পলিথিন বিক্রেতা নিলো ভৌমিক বলেন, আমাদের স্টকে যে পলিথিন আছে, তা-ই বিক্রি করছি। দুই এক দিন পর আর বিক্রি করতে পারব না। আমরা যদি পাইকারি বাজারে পলিথিন না পাই, তাহলে বিক্রি করব কোথা থেকে। পলিথিন বন্ধ করতে হলে আগে উৎপাদন বন্ধ করতে হবে।  

সূত্রাপুর বাজারের সবজি বিক্রেতা মো. আব্দুল বলেন, কাঁচাবাজারে পলিথিন ব্যবহার নিষিদ্ধ, তা আমরা জানি। কিন্তু এর বিকল্প নেই। ক্রেতারা বাজার করার সময় ব্যাগ নিয়ে আসেন না। ক্রেতারা ব্যাগ নিয়ে এলে আমাদেরই সুবিধা হবে বেশি। কারণ প্রতিটি সবজির জন্য আমাদের আলাদা আলাদা পলিথিন দিতে হয়। ব্যাগ ব্যবহার বাড়লে আমাদের এ ভোগান্তি কমবে। একইসঙ্গে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরকে বাজারে বাজারে অভিযান না চালিয়ে যেখানে উৎপাদন হয় সেসব কারখানায় অভিযান চালানো উচিত। উৎপাদন ব্যবস্থা বন্ধ করতে পারলে সরবরাহ কমে যাবে। তখন এমনিতেই পলিথিন ব্যবহার বন্ধ হয়ে যাবে।

রাজধানীর রায়সাহেব বাজারে কাঁচাবাজার করতে আসা মো. ইমন সারোয়ার বাংলানিউজকে বলেন, আমি কাঁচাবাজারের জন্য বাসা থেকে ব্যাগ এনেছি। তাতেই বাজার নিয়েছি। কিন্তু মাছ নিতে গিয়ে আমি বিপদে পড়েছি। কারণ মাছ তো পলিথিনে নিতেই হবে। এর বিকল্প তৈরি হওয়া উচিত। আমার মতে, সরকারের উচিত স্বল্পমূল্যে পাট কিংবা কাগজের ব্যাগ বাজারে নিয়ে আসা। সেজন্য ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানসহ এ খাতে সংশ্লিষ্টদের নিয়ে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা হওয়া জরুরি। নয়তো এ সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন হওয়া কঠিন।

কাঁচা বাজারের ব্যবসায়ীদের কাছে পলিথিনের ছড়াছড়ি

এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল ও পরিবেশ বিভাগের অধ্যাপক ও সভাপতি শহীদুল ইসলাম বলেন, পলিথিন উৎপাদন ও ব্যবহার আইনগতভাবে আগে থেকেই নিষিদ্ধ। কিন্তু আইন থাকলেও এতদিন তা কাগজে-কলমেই সীমাবদ্ধ ছিল। মাঝেমধ্যে কিছু অভিযান চললেও তা খুবই নগণ্য।

তিনি বলেন, অন্তর্বর্তী সরকার বিভিন্ন খাতে সংস্কারের জন্য কাজ শুরু করেছে, যা আশার খবর। এরই ধারাবাহিকতায় গত দুই মাস আগ থেকে পলিথিন উৎপাদনকারী ও কাঁচাবাজারে যে পলিথিন নিষিদ্ধ হবে তা প্রচারণা করে যাচ্ছে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়। এখন দুই মাসেও যারা বিকল্প রাখেনি, তাদের বিরুদ্ধে কঠোর আইন প্রয়োগ জরুরি। এর পাশাপাশি সচেতনতা জরুরি।

তিনি আরও বলেন, দীর্ঘদিনের এ অভ্যাস খুব সহজেই পরিবর্তন সম্ভব নয়। তবে শুরুটা করতে হবে। এ ছাড়া পলিথিন এখন ব্যবসায়িক খাতে পরিণত হয়েছে। তাই তাদের দিকটাও বিবেচনা করা উচিত। দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা করতে হবে।  

পরিবেশবাদী যুব সংগঠন গ্রিন ভয়েসের প্রধান সমন্বয়ক আলমগীর কবির বলেন, আমরা দীর্ঘদিন ধরে পরিবেশ ধ্বংসকারী পলিথিন ব্যবহার রোধে লড়াই করে যাচ্ছি। দেশজুড়ে সচেতনতা তৈরিতে শিক্ষার্থীরা বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে র‍্যালিসহ পরিচ্ছন্নতা অভিযান চালিয়ে এ বিষয়ে সচেতনতা বাড়াতে কাজ করে যাচ্ছেন।  

তিনি বলেন, এর মধ্যেই অন্তর্বর্তীকালীন সরকার সুপারশপসহ কাঁচাবাজারে পলিথিন ব্যবহার নিষিদ্ধ করেছে। কিন্তু এর আগে বিকল্প তৈরি করা উচিত ছিল। কারণ এর আগেও পলিথিন ব্যবহার রোধে পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছিল। কিন্তু বিকল্প ব্যবস্থা না থাকায় তা আলোর মুখ দেখেনি। সরকারের উচিত পলিথিন বন্ধে কঠোর আইন প্রয়োগের পাশাপাশি পাট বা কাগজের ব্যাগ ব্যবহারে ক্রেতাদের উৎসাহী করা। ভর্তুকি দিয়ে হলেও তা করা উচিত।

অবাধে বিক্রি হচ্ছে পলিথিন ব্যাগ

সরকারের এ উদ্যোগ কার্যকরে আপনার সংগঠন কী ধরনের পদক্ষেপ নিয়েছে, জানতে চাইলে তিনি আরও বলেন, আমরা খুব শিগগিরই কাঁচাবাজারগুলোতে ক্রেতা-বিক্রেতাদের মাঝে সচেতনতা তৈরিতে কাজ শুরু করব। ইতোমধ্যে রাজধানীর বাইরে এ কার্যক্রম শুরু হয়েছে। পরিবেশ রক্ষায় আমাদের যে সংগ্রাম, তা অব্যাহত থাকবে।

এদিকে পলিথিনের ব্যাগের ব্যবহার বন্ধে বিভিন্ন সুপারশপে মনিটরিং কার্যক্রম চালানো হচ্ছে। মনিটরিং কমিটির পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, পলিথিনের শপিং ব্যাগ উৎপাদনকারীদের বিরুদ্ধে রোববার থেকে কঠোর আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে। কার্যক্রম পরিচালনাকালে মনিটরিং কমিটির সদস্যরা কেনাকাটা করতে আসা লোকজনকে পলিথিন ব্যবহার না করতে অনুরোধ জানান। এর পরিবর্তে পাট বা কাপড়ের ব্যাগ ব্যবহার করতে বলেন। একই সঙ্গে দোকানিদের পলিথিনের ব্যাগ ব্যবহার বন্ধে নির্দেশনা দেন। দোকানিদের বলা হয়, অভিযানে পলিথিন ব্যাগ পাওয়া গেলে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

মনিটরিং কমিটির আহ্বায়ক মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (পরিবেশ দূষণ নিয়ন্ত্রণ ও আইন অনুবিভাগ) তপন কুমার বিশ্বাস সাংবাদিকদের বলেন, বাজারগুলোতে আপাতত জরিমানা করা হবে না। সতর্কতামূলক অভিযান নভেম্বরের প্রথম এক সপ্তাহ চলবে। এর পরের সপ্তাহ থেকে অভিযানে পলিথিনের ব্যাগ পাওয়া গেলে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এ বিষয়ে সব জেলা প্রশাসক ও পরিবেশ অধিদপ্তরের মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তাদের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।

বাংলাদেশ সময়: ১৪৩৪ ঘণ্টা,নভেম্বর ০৩, ২০২৪
জিসিজি/এমএম/আরএইচ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।