ঢাকা: বৈষম্যের দিক দিয়ে বিশ্বের নিচের ১০টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশ একটি বলে মন্তব্য করেছেন শ্রম সংস্কার কমিশনের প্রধান ও বিলসের নির্বাহী পরিচালক সৈয়দ সুলতান উদ্দীন আহম্মদ।
মঙ্গলবার (৩ ডিসেম্বর) রাজধানীর বিজয় নগরে শ্রমভবনের সম্প্রীতি সভাকক্ষে পরিচ্ছন্নতাকর্মী এবং গৃহশ্রমিকদের সঙ্গে মতবিনিময় সভায় তিনি এই মন্তব্য করেন।
শ্রম সংস্কার কমিশনের প্রধান বলেন, বাংলাদেশে এখন হাজারো শ্রমজীবী গোষ্ঠী আছে, যাদের অধিকার, জীবনমানের কথা আলোচনা হয় না। প্রথম পর্যায়ে আমরা সবাই মিলে চাই, তাদের কথা যেন মানুষ জানতে পারে। আমরা ধীরে ধীরে সবার সাথে বসব। সবার কথা শুনলে দেখবেন, বাংলাদেশ কোথায় আছে। বাংলাদেশ এখন বৈষম্যের দিক দিয়ে নিচের দশটি দেশের একটি।
তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশের সবচেয়ে অবহেলিত ও অরক্ষিত যে দুইটি জনগোষ্ঠী তাদের একটি পরিচ্ছন্নতাকর্মী, যাদের আমরা হরিজন ও দলিত বলি। আমরা একদম উদ্দেশ্য নিয়েই তাদের ডেকেছি। শ্রম সংস্কার কমিশন যাত্রা শুরু করেছে খুব সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য নিয়ে। বাংলাদেশে শত বছর যাবত যারা অবহেলিত, যারা সমস্ত সুরক্ষার বাইরে, তাদের জীবনমান উন্নয়নের জন্য, তাদের অধিকার নিশ্চিতের জন্য, তারা যাতে ঠিকানার জন্য চাকরি থেকে বঞ্চিত না হয়, তাদের নামের শেষে যে বিশেষণ আছে, সেটা যেন সম্মানের ব্যাপার হয়, সেটা যেন বৈষম্য, অবহেলা, অচ্ছুতের ব্যাপার না হয়, সেটা বাংলাদেশের নাগরিকদের নিশ্চিত করতে হবে। স্বাধীনতার ৫৩ বছর পরে আমরা এই বিতর্ক রাখতে চাই না।
শ্রম সংস্কার কমিশনের প্রধান আরও বলেন, পরিচ্ছন্নতাকর্মীদের মাতৃত্বকালীন ছুটি নেই। সরকারি অফিসে কাজ করে, সরকারি অফিস ঝকঝকে তকতকে রাখে, কিন্তু তারা সরকারি কর্মচারী না। ঈদের বোনাস পায় না। এর চেয়ে দুঃখজনক কথা আর নেই। আমরা এসব তুলে ধরতে চাচ্ছি। আমরা গণমাধ্যমের মাধ্যমে জানাতে চাই, আমাদের দেশেই একদল শ্রমজীবী মানুষ আছে, যারা শতবছর যাবত বঞ্চনা, বৈষম্যের শিকার হয়ে আছে, সমস্ত অধিকারহীনতার শিকার হয়ে আছে এবং সেটা বাড়ছে।
তিনি বলেন, আমরা আমাদের গৃহকর্মী ভাই-বোনদের আমন্ত্রণ জানিয়েছি। প্রতি মাসে রুটিন করে গৃহকর্মী নির্যাতনের খবর পত্রিকায় আসে। গ্রাম থেকে আমাদের কিশোরীরা আসে পরিবারের মুখের দিকে তাকিয়ে, যে নিজে একটু ভালো থাকবে এবং পরিবারকেও একটু ভালো রাখবে। আসার সাথে সাথে তারা চার দেয়ালের মধ্যে বন্দি হয়ে যায়। যখন তাদের নির্যাতনের কান্না দেয়াল ভেদ করতে পারে, তখনই আমরা গণমাধ্যমের মাধ্যমে জানি। তখন হয়তো কিছু প্রতিকার হয়। কিন্তু গবেষণা বলছে, এখন পর্যন্ত কোনোদিনই বাংলাদেশে গৃহশ্রমিক নির্যাতন, হত্যার জন্য কারো কোনো শাস্তি হয়নি, একটিও না। কিছুদিন আলোড়ন হয, তারপর সব বন্ধ হয়ে যায়। আমরা অনেক নির্যাতিত গৃহশ্রমিকের গল্প শুনেছি, তারা ৫-৭ বছর ঢাকা শহরে থাকে, কিন্তু টাকা পায় তার অভিভাবক, দেখা হয় না। তারা টয়লেট পরিষ্কার করে, কিন্তু সেই টয়লেট ব্যবহার করতে পারে না। এমনিভাবে আমাদের গৃহশ্রমিক ও পরিচ্ছন্নকর্মীদের জীবন চলে। এটাই শেষ নয়, এই কাফেলা অনেক বড়। আমরা আস্তে আস্তে সবার কাছেই যাব। আমরা বলেছি, জেলে, রিকশাচালকসহ সবার কাছে যাব।
শ্রম সংস্কার কমিশনের প্রধান সৈয়দ সুলতান উদ্দীন আহমেদের সভাপতিত্বে মতবিনিময় সভায় আরও উপস্থিত ছিলেন লেবার কোর্ট বার অ্যাসোসিয়েশনের সাবেক সভাপতি ও আইনজীবী অ্যাডভোকেট একেএম নাসিম, সাবেক শ্রম সচিব ড. মাহফুজুল হক, গার্মেন্ট শ্রমিক সংহতির সভাপ্রধান তাসলিমা আখতার প্রমুখ।
সভায় ঢাকা ও ঢাকার আশেপাশের এলাকা থেকে আগত পরিচ্ছন্নতাকর্মী এবং শ্রম ভবনের নারীকর্মীরা তাদের বর্তমান পরিস্থিতিতে তাদের সামাজিক অবস্থান, বেতন বৈষম্য, তাদের সন্তানদের সুযোগের অভাবসহ বিভিন্ন বিষয়ে তাদের দুঃখ ও বঞ্চনা তুলে ধরেন। নিজেদের প্রাত্যহিক জীবনের দুর্বিষহ অভিজ্ঞতার কথা। গৃহশ্রমিকরা তাদের বিভিন্ন ভালো খারাপ অভিজ্ঞতা কমিশনের কাছে তুলে ধরেন। তাদের সামাজিক মর্যাদা, বেতন, যৌন নির্যাতনের কথা তুলে ধরেন। একজন গৃহশ্রমিক জানান তাদের ‘বুয়া’ বলে সম্বোধন করার কারণে তারা নিজের সুন্দর নামটিও আর মনে করতে পারেন না। তারা কমিশনের কাছে দাবি রাখেন তাদের যেন আইনের আওতায় আনা হয়।
কমিশন প্রধান সৈয়দ সুলতান উদ্দীন আহম্মেদ পরিচ্ছনাতাকর্মী এবং গৃহকর্মীদের আলোচনা শেষে আশ্বাস দিয়ে জানান যে, সকল শ্রমিকদের বঞ্চনার কথা মূল প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হবে এবং সেই আলোকেই সুপারিশ প্রণয়ন করা হবে। সকল শ্রেণির সকল শ্রমিকদের কাছ থেকে প্রাপ্ত তথ্য ও উপাত্তের আলোকেই কমিশন শ্রম আইন ও নীতিসমূহের পর্যালোচনা, শ্রমিকের ন্যায্যবিচার প্রাপ্তির, কর্মসংস্থান উন্নয়ন, দক্ষতা উন্নয়ন, কাজের নিরাপত্তার বিধান ও মজুরির ন্যায্য হিস্যা নিশ্চিতকরন প্রভৃতি বিষয়ে সুপারিশ প্রণয়ণ করবে।
বাংলাদেশ সময়: ২০৩৭ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ০৩, ২০২৪
এসসি/এমজেএফ