ঢাকা, শুক্রবার, ৫ পৌষ ১৪৩১, ২০ ডিসেম্বর ২০২৪, ১৭ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

জাতীয়

১৩ বছর ধরে রেলপথে বন্ধ মধ্যপাড়ার পাথর পরিবহন

ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৮৪১ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১১, ২০২৪
১৩ বছর ধরে রেলপথে বন্ধ মধ্যপাড়ার পাথর পরিবহন

নীলফামারী: রেল সংস্কারের অভাবে ১৩ বছর ধরে দেশের একমাত্র উৎপাদনশীল দিনাজপুরের পার্বতীপুরে অবস্থিত মধ্যপাড়া পাথর খনির পাথর রেলপথে পরিবহনের কাজ বন্ধ রয়েছে। রেল না চলায় সড়কপথে পাথর পরিবহনে খরচ বাড়ায় এর প্রভাব পড়ছে পাথরের দামে।

রেলপথের তুলনায় সড়কপথে তাদের পাঁচগুণ অর্থ খরচ করতে হয়।  

সরকারি নির্দেশনা অনুযায়ী এই খনির পাথর রেলপথে পরিবহন করার কথা থাকলেও বাধ্য হয়ে পাঁচগুণ বেশি খরচে মধ্যপাড়া খনির উৎপাদিত পাথর পরিবহন করা হচ্ছে সড়ক পথে।  

বাংলাদেশ তেল, গ্যাস ও খনিজসম্পদ করপোরেশনের (পেট্রোবাংলা) অধীন মধ্যপাড়া গ্রানাইট মাইনিং কোম্পানি লিমিটেড থেকে পাওয়া তথ্যমতে, সরকারি নির্দেশনা অনুযায়ী খনির ৮০ ভাগ পাথর রেলপথে পরিবহন করতে হবে। কিন্তু ওই নির্দেশনা কাজে আসছে না।  

খনি সূত্রে জানা যায়, গড়ে প্রতিদিন পাথর বিক্রি হয়েছে প্রায় আড়াই হাজার টন। সব মিলিয়ে উত্তোলিত পাথরের অর্ধেক থেকে এক-তৃতীয়াংশই অবিক্রিত রয়েছে। বতর্মানে নদী শাসনের জন্য ৮৬ কোটি টাকার বোল্ডার ২ লাখ ৭০ হাজার মেট্রিক টন পাথর এবং রেলপথের জন্য ২২৭ কোটি টাকার ব্লাস্ট ৬ লাখ ২৪ হাজার মেট্রিক টন পাথর ছাড়াও আরও ১১৪ কোটির টাকার পাথর মজুত রয়েছে। বর্তমানে মধ্যপাড়ায় খনি ১২ ইয়ার্ডে ৪২৭ কোটির টাকার অবিক্রিত অবস্থায় পড়ে আছে। ১৯৯০ সালে প্রায় ১০০ কোটি টাকা ব্যয়ে মধ্যপাড়া খনি পর্যন্ত ওই রেলপথের নির্মাণকাজ শুরু হয়। নির্মাণ শেষে ২০০৯ থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত নিরবচ্ছিন্নভাবে চলে রেলপথে পাথর পরিবহন। কারণ ২০১১ সালে পার্বতীপুরের ভবানীপুর রেলস্টেশন থেকে মধ্যপাড়া খনি পর্যন্ত ১৪ কিলোমিটার রেলপথের বেশ কয়েকটি জায়গার ৭০টি স্লিপার (পাটাতন) চুরি যায়। এরপর থেকে বন্ধ হয়ে যায় ওই পথে পাথরবাহী ওয়াগনের চলাচল। অকেজো হয়ে পড়ে ‘পাথর পরিমাপ স্কেল’।

এ রেলপথে অবকাঠামো ও রেললাইন সংলগ্ন জমি স্থানীয় ভূমিদস্যুরা কব্জায় নিয়েছে। পরিত্যক্ত থাকায় এই রেলভূমির ওপর উদ্বাস্তুদের বাড়িঘর নির্মিত হয়েছে। উজাড় হয়েছে রেলভূমির গাছপালা। চুরি হয় এ রেলপথের প্রায় ৫ কিলোমিটার রেললাইন। রেলপথ চালুর প্রসঙ্গে জানতে চাইলে, মধ্যপাড়া গ্রানাইট মাইনিং কোম্পানি লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) প্রকৌশলী মো. ফজলুর রহমান বলেন, রেলপথে পাথর পরিবহনে ভৈরব-ঢাকা পর্যন্ত প্রতি টনে খরচ হয় মাত্র ৩০০-৪০০ টাকা। অথচ সমপরিমাণ পাথর সড়কপথে পরিবহনে প্রতিটনে খরচ হয় ১ হাজার ৪শ টাকা থেকে ১ হাজার ৫শ টাকা (মধ্যপাড়া-ভৈরব-ঢাকা)। এতে পরিবহনে অতিরিক্ত ব্যয় গুনতে হচ্ছে। পাথর পরিবহন খাতে ব্যাপক আর্থিক অপচয় হয়েছে।

দেশে পাথরের বার্ষিক চাহিদা প্রায় ২ কোটি ১৬ লাখ টন। এ চাহিদার সিংহভাগ আমদানি করা হয় ভারত ও ভুটান থেকে। এতে করে সরকার হারাচ্ছে লাখ লাখ টাকার রাজস্ব। সেই সঙ্গে দেশের মেগা প্রকল্পসহ অনেক নির্মাণকাজ বন্ধ থাকায় পাথর বিক্রি কমেছে। সরকারি নির্দেশনা অনুযায়ী রেল কর্তৃপক্ষ ও নদী শাসন এবং দেশের মেগা প্রকল্পগুলোয় বিশ্বের উন্নতমানের পাথর হিসেবে স্বীকৃত মধ্যপাড়ার পাথর ব্যবহার বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। অথচ রেলপথে তা পরিবহনের ব্যবস্থা না থাকায় বড় অঙ্কের টাকা গচ্চা যাচ্ছে।  

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, মধ্যপাড়া গ্রানাইট মাইনিং কোম্পানি লিমিটেড খনিটি পরপর চারবার লাভের মুখ দেখেছে। বর্তমানে খনিটিতে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান জার্মানিয়া ট্রেস্ট কনসোর্টিয়ামের (জিটিসি) শতাধিক বিদেশি খনি বিশেষজ্ঞ ও অর্ধশত দেশি প্রকৌশলী এবং প্রায় ১ হাজার দক্ষ খনি শ্রমিক কাজ করছেন। যারা প্রতিদিন প্রায় সাড়ে ৫ হাজার থেকে ৬ হাজার মেট্রিক টন পাথর উত্তোলন করছেন। ভবানীপুর রেলস্টেশন থেকে মধ্যপাড়া পাথর খনি পর্যন্ত রেলপথ সংস্কার বিষয়ে জানতে চাইলে, রেলওয়ের পূর্ত বিভাগের ঊর্ধ্বতন উপ-সহকারী (পার্বতীপুর/কার্য) প্রকৌশলী মো. রাজা আলী শেখ বলেন, পাথর খনি মুখী ভবানীপুর-মধ্যপাড়া রেলপথে স্লিপার, ফিটিংস, পাথর কিছুই নেই। ওই রেলপথে রেললাইন চুরি গেছে। তাই পাথরের কংক্রিট, নতুন রেললাইন স্থাপন ও দুইধারে মাটির কাজ করতে হবে। এ অবস্থায় ওই রেলপথে পাথর পরিবহন অসম্ভব। রেলপথ সংস্কারের পাশাপাশি পাথর পরিবহন উপযোগী (প্রতি সেটে ৪০টি ওয়াগন) ৫ সেট ওয়াগন রয়েছে।  
 ভবানীপুর রেলস্টেশন-মধ্যপাড়া রেলপথ সংস্কারে পদক্ষেপের বিষয়ে জানতে চাইলে, রেলওয়ের পশ্চিমাঞ্চলের প্রধান যন্ত্র প্রকৌশলী (সিএমই) মো. আসাদুর হক বলেন, প্রায় ২৫ কোটি টাকা ব্যয়ে ভবানীপুর থেকে মধ্যপাড়া পাথরখনি পর্যন্ত রেলপথ সংস্কারের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। আগামী জানুয়ারি মাসে এই রেলপথের কাজ শুরু হবে। ইতোমধ্যে খনি কর্তৃপক্ষের চুক্তি হয়েছে।

এদিকে, মধ্যপাড়া খনির ১২ ইয়ার্ডে ১১ লাখ ২৪ হাজার মেট্রিক টন পাথরের মজুত গড়ে উঠেছে। এর মধ্যে রেলপথে ব্যবহৃত ব্লাস্ট এবং নদী শাসন কাজে ব্যবহৃত বোল্ডার রয়েছে প্রায় সাড়ে ৯ লাখ মেট্রিক টন। এই দুই সাইজের পাথর বিক্রি কমে যাওয়ায় অর্থ সংকটে পড়েছে খনি কর্তৃপক্ষ। ধারদেনা করে ঠিকাদারের বিল ও কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা দিতে হচ্ছে। দ্রুত এসব পাথর বিক্রিতে গতি বাড়াতে না পারলে কিছু দিনের মধ্যে খনির উৎপাদনও বন্ধ হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।  

বর্তমানে দেশের বিভিন্ন মেগা প্রকল্প বন্ধ হয়ে যাওয়ায় এর প্রভাব পড়ছে পাথরে। খনিটির একাধিক ডিলার নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, আগে ১০ চাকার ট্রাকে (ট্রাকের ওজনসহ) ৪২ থেকে ৪৬ টন এবং ৬ চাকার ট্রাকে (ট্রাকের ওজনসহ) ৩০ থেকে ৩২ টন পাথর পরিবহন করা হতো। ২০১৮ সালের মোটরযান এক্সেল লোড নিয়ন্ত্রণবিধি অনুযায়ী ১০ চাকার ট্রাক (ট্রাকের ওজনসহ) ৩২ টন ও ৬ চাকার ট্রাক ২২ টনের বেশি পাথর বহন করতে পারছে না। এতে পরিবহন খরচ প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে। এছাড়া আগে ৫ শতাংশ কমিশনের স্থলে এখন দেওয়া হচ্ছে ৩ শতাংশ। এর ওপর ভ্যাট কাটা হচ্ছে ১৫ শতাংশ।  

বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) প্রসেসিং পরিদপ্তরের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী মুহাম্মদ আনোয়ার সাদাত জানান, সিসি ব্লক তৈরিতে অল্প কিছু পাথর মধ্যপাড়ার খনি থেকে নেওয়া হয়। সিংহভাগই আমদানি করা হয়।  

বাংলাদেশ সময়: ১৮৩৩ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১১, ২০২৪
আরএ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।