ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে গত ৫ আগস্ট পতন হয় শেখ হাসিনার সরকারের। তারপর থেকে ভারতের কতিপয় গণমাধ্যম ও ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগের অনলাইন অ্যাক্টিভিস্টরা অভিযোগ করতে থাকে, ‘পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে বাংলাদেশে সংখ্যালঘুরা আক্রান্ত হচ্ছেন।
কিন্তু বিবিসি বাংলার খবর বলছে, গত আগস্ট থেকে ডিসেম্বরের তৃতীয় সপ্তাহ পর্যন্ত অবৈধভাবে ভারতে প্রবেশ করতে গিয়ে যতজন বাংলাদেশি নাগরিক ধরা পড়েছেন, তাদের মধ্যে মুসলিমদের সংখ্যাই বেশি।
ভারতীয় সীমান্ত রক্ষী বাহিনী বিএসএফের বরাতে সংবাদমাধ্যমটি বলছে, আগের দুবছরের একই সময়ে তুলনায় ২০২৪ সালে বাংলাদেশ থেকে ভারতে অনুপ্রবেশকারীর সংখ্যা সামান্য বাড়লেও পুরো বছরের তথ্যের সঙ্গে তুলনা করলে আগস্ট থেকে ডিসেম্বরের মধ্যে অনুপ্রবেশ উল্লেখযোগ্যভাবে বাড়েনি।
বিএসএফের দক্ষিণ বঙ্গ সীমান্ত অঞ্চলের একাধিক কর্মকর্তা বলেন, যেসব হিন্দু বাংলাদেশি নাগরিক অবৈধ উপায়ে ভারতে আসতে গিয়ে ধরা পড়েছেন, তাদের প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদের সময়ে বাংলাদেশে হিন্দুদের ওপরে ‘অত্যাচার’ ও ‘সহিংসতা’র কারণে দেশ ছেড়ে এসেছেন, এমনটা জানিয়েছেন ‘সামান্য কিছু’ লোক।
বিবিসি যে নির্দিষ্ট পরিসংখ্যান পেয়েছে, তা বিএসএফের দক্ষিণ বঙ্গ সীমান্তের হলেও বাহিনীর পূর্ব কমান্ড– অর্থাৎ ভারত আর বাংলাদেশের পুরো সীমান্ত অঞ্চলের চিত্র একই।
এ তথ্যে কিছুটা বিস্মিত বিশ্লেষকরা। কারণ বাংলাদেশে হিন্দুদের ওপরে ‘অত্যাচার’র ঘটনায় বহু হিন্দু ধর্মাবলম্বী ভারতে চলে আসছেন বা আসার চেষ্টা করছেন বলে একটা ন্যারেটিভ বা বয়ান ভারতের হিন্দুত্ববাদী সংগঠনগুলোর এবং ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগের অ্যাক্টিভিস্টরা বেশ কিছুদিন ধরে চালিয়ে আসছে।
এমন প্রেক্ষাপটে বিএসএফের এই পরিসংখ্যান সে বয়ানকে খারিজ করে দিচ্ছে বলে মনে হচ্ছে বিশ্লেষকদের কাছে।
বিএসএফের দক্ষিণবঙ্গ সীমান্ত অঞ্চলের সূত্রে যে পরিসংখ্যান পাওয়া গেছে, তাতে দেখা যাচ্ছে এ বছরের আগস্ট মাস থেকে ডিসেম্বরের ২৪ তারিখ পর্যন্ত ৭১৬ জন বাংলাদেশি নাগরিক অবৈধ ভাবে সীমান্ত পেরোতে গিয়ে ভারতীয় সীমান্তরক্ষীদের হাতে ধরা পড়েছেন। এদের মধ্যে ৩০১ জন হিন্দু এবং ৪১৫ জন মুসলমান।
কর্মকর্তারা আরও বলছেন, পুরো বছরের পরিসংখ্যানের দিকে তাকালে দেখা যাবে আগস্ট থেকে ডিসেম্বরের সময়কালে অনুপ্রবেশের সংখ্যায় উল্লেখযোগ্য কোনো বদল ঘটেনি। হিন্দু এবং সব ধরনের অনুপ্রবেশকারীর সংখ্যা সামান্যই বেড়েছে।
বিগত দুই বছরের আগস্ট থেকে ডিসেম্বর সময়কালে ধরা পড়া অনুপ্রবেশকারীর পরিসংখ্যান থেকে জানা যাচ্ছে, ২০২৩ সালে ২০৩ জন হিন্দু এবং ৪৪৯ জন মুসলমান ধরা পড়েছিলেন দক্ষিণবঙ্গ সীমান্ত অঞ্চলে।
আবার তার আগের বছর, ২০২২ সালের আগস্ট থেকে ডিসেম্বরে ১১৪ জন হিন্দু এবং ২৯৮ জন মুসলিম অবৈধভাবে ভারতে প্রবেশ করতে গিয়ে ধরা পড়েছিলেন।
অনুপ্রবেশের কারণ কী বলছেন ধরা পড়া ব্যক্তিরা
শেখ হাসিনার সরকারের পতনের পর থেকে বিএসএফের দক্ষিণবঙ্গ সীমান্ত অঞ্চলে যত জন বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারী ধরা পড়েছেন, তাদের প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদ করেছে সীমান্ত রক্ষী বাহিনী।
বাহিনীর সূত্রগুলির বরাতে বিবিসি বলছে, বাংলাদেশে তাদের ওপরে নির্যাতন বা অত্যাচার হয়েছে বা হওয়ার আশঙ্কা করছেন, এবং সেই কারণেই তারা ভারতে চলে এসেছেন, এমন হিন্দু অনুপ্রবেশকারীর সংখ্যা একেবারেই নগণ্য।
সেই সংখ্যাটা ধরা পড়া অনুপ্রবেশকারীদের মাত্রই এক থেকে দুই শতাংশ।
বিএসএফের এক জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা বলেন, আগস্টের পর থেকে বাংলাদেশিদের খুবই কম ভিসা দিচ্ছে ভারতীয় হাইকমিশন। তবে বাংলাদেশের অনেক মানুষকেই ভারতের এই অঞ্চলে ব্যবসা, পারিবারিক বা নানা প্রয়োজনে আসতে হয়। এরকম আসা যাওয়া চলতেই থাকে বৈধভাবেই। এখন ভিসার ব্যাপক বিধিনিষেধের কারণে হয়তো অনেকে অবৈধ উপায় আসার চেষ্টা করছেন এবং ধরা পড়ে যাচ্ছেন।
হিন্দুত্ববাদীদের বয়ান নস্যাৎ
ভারতে গত কয়েক মাস ধরে একটা প্রচারণা এবং বয়ান প্রতিষ্ঠিত করার অপচেষ্টা চলছে যে বাংলাদেশের হিন্দুরা ‘নির্যাতন’র শিকার হয়ে ভারতে চলে আসতে চাইছেন।
সেই প্রেক্ষাপটে অনুপ্রবেশকারীদের এরকম একটা পরিসংখ্যান পাওয়া যাচ্ছে, যার ফলে ওই বয়ান ও প্রচারণা কিছুটা নস্যাৎ হয়ে যাচ্ছে বলে মনে করেন হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির গবেষক স্নিগ্ধেন্দু ভট্টাচার্য।
তিনি বলেন, দুই দেশের রাজনীতিবিদদের একাংশ তো ঢালাওভাবে বলে চলেছিলেন সেই আগস্ট মাস থেকে যে বাংলাদেশে হিন্দুদের ওপরে ব্যাপক অত্যাচার হচ্ছে। তাই দলে দলে হিন্দুরা ভারতে চলে আসছে বা আসার কথা ভাবছে। এই প্রচারটা বিশেষত চলছে পশ্চিমবঙ্গ, আসামসহ বাংলাদেশ সীমান্তঘেঁষা রাজ্যগুলোতে। পশ্চিমবঙ্গে ২০২৬-এর নির্বাচনকে মাথায় রেখে এই প্রচারের তীব্রতা বাড়ানো হয়েছে। কিন্তু এখন বিএসএফের যে পরিসংখ্যান পাওয়া যাচ্ছে, তাতে তো সামান্য সংখ্যক হিন্দুকেই সীমান্তে ধরা পড়তে দেখা যাচ্ছে। আর মুসলমানরাও অবৈধভাবে সীমান্ত পেরতে গিয়ে যে সংখ্যায় ধরা পড়েছেন, সেটাকেও তো দলে দলে চলে আসছে বলা যায় না!
স্নিগ্ধেন্দু ভট্টাচার্য বলেন, মাত্রই কয়েকশো ধরা পড়েছেন এখানে। তবে হ্যাঁ, এটাও ঠিক যে অনেকে হয়ত ধরা না পড়েই অবৈধভাবে সীমান্ত পেরোতে সক্ষম হয়েছেন। সেই সংখ্যা কত আমরা জানি না, যদি আরও বেশি হয়, বিএসএফ তার দায় এড়াতে পারে না! কিন্তু ব্যাপক হিন্দু পলায়নের হিন্দুত্ববাদী আখ্যানটা তো নস্যাৎ করে দিচ্ছে এই সংখ্যা। এ বছরের আগস্টের পর থেকে অনুপ্রবেশের যে পরিসংখ্যান পাওয়া যাচ্ছে, হিন্দু এবং মুসলমান মিলিয়ে, তা থেকে আরেকটা আখ্যানও মিথ্যা বলে স্পষ্ট হচ্ছে। ’
বাংলাদেশ সময়: ১৭১৭ ঘণ্টা, জানুয়ারি ০১, ২০২৫
এইচএ/