ঢাকা, শুক্রবার, ৩০ মাঘ ১৪৩১, ১৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১৪ শাবান ১৪৪৬

জাতীয়

নিরাপত্তা বাহিনীর হাতে

দেড় দশকে ২৫৯৭ হত্যা, ৭০৮ গুমের তথ্য পেয়েছে জাতিসংঘ

ডিপ্লোম্যাটিক করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৭২৭ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ১২, ২০২৫
দেড় দশকে ২৫৯৭ হত্যা, ৭০৮ গুমের তথ্য পেয়েছে জাতিসংঘ

ক্ষমতাচ্যুত স্বৈরাচার হাসিনা সরকারের নিয়ন্ত্রিত বিচারব্যবস্থা এবং নিরাপত্তা বাহিনীগুলোর অপরাধের দায়মুক্তির বিষয় প্রতিবেদনে তুলে ধরেছে জাতিসংঘ।

ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী সরকারের মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিষয়ে জাতিসংঘের ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং মিশনের ওই প্রতিবেদন বুধবার প্রকাশ করা হয়েছে।

প্রতিবেদনে বলা হয়, রাজনীতিকরণের ফলে শাসক দল এবং নিরাপত্তা বাহিনীগুলোর মধ্যে এক ধরনের পারস্পরিক স্বার্থসংশ্লিষ্ট সম্পর্ক তৈরি হয়েছিল। বিরোধীদের দমন এবং সরকার দলীয় নেতাদের অপরাধে হস্তক্ষেপ না করার বিনিময়ে পুলিশ এবং অন্যান্য নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরা নিজেদের অপরাধ ও দুর্নীতির জন্য দায়মুক্তি আশা করতো।

সেই সময়টাতে গুরুতর অপরাধের জন্য অপরাধীদের জবাবদিহিতা নিশ্চিত করার উদাহরণ ছিল অত্যন্ত বিরল।  

২০০৯ সাল থেকে বাংলাদেশি নাগরিক সংগঠনগুলো দুই হাজার ৫৯৭টি বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড এবং ৭০৮টি গুমের ঘটনা নথিভুক্ত করেছে। শুধু র‍্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র‍্যাব) ৮০০টিরও বেশি বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড এবং প্রায় ২২০টি গুমের সঙ্গে জড়িত বলে অভিযোগ রয়েছে। কিন্তু হত্যার অপরাধে শুধু একটি মামলায় র‍্যাব কর্মকর্তাদের দোষী সাব্যস্ত করা হয়েছে, যেখানে হত্যাকাণ্ডের শিকারদের মধ্যে একজন প্রভাবশালী আওয়ামী লীগ নেতা ছিলেন।

২০১৩ সালে বাংলাদেশে ‘নির্যাতন ও হেফাজতে মৃত্যু (নিষেধাজ্ঞা) আইন’ পাস হয়েছিল। কিন্তু তারপর থেকে অন্তত ১০৩ জন বন্দির ওপর নির্যাতন চালিয়ে হত্যা করা হয়েছে।

সংশ্লিষ্ট নাগরিক সমাজের সংগঠনগুলোর মতে, ডিজিএফআই কর্মকর্তারা ১৭০টিরও বেশি গুমের ঘটনায় জড়িত ছিলেন বলে অভিযোগ রয়েছে। কিন্তু ওই সংস্থার কোনো কর্মকর্তাকেই বিচারের মুখোমুখি করা হয়নি।

বাংলাদেশে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর দ্বারা স্বীকারোক্তি আদায় বা ঘুষ আদায়ের জন্য ব্যাপক এবং নিয়মিত নির্যাতনের বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে জাতিসংঘের নির্যাতনবিরোধী কমিটি।

২০১৩ সালে বাংলাদেশে ‘নির্যাতন ও হেফাজতে মৃত্যু (নিষেধাজ্ঞা) আইন’ পাস হয়েছিল। কিন্তু তারপর থেকে অন্তত ১০৩ জন বন্দির ওপর নির্যাতন চালিয়ে হত্যা করা হয়েছে। সরকারের তথ্য অনুযায়ী, ওই আইনের আওতায় মাত্র ২৪টি মামলা দায়ের করা হয়েছে এবং মাত্র একটি মামলায় পুলিশ কর্মকর্তাদের দোষী সাব্যস্ত করা হয়েছে।

এই অপরাধমুক্তির সংস্কৃতি প্রাতিষ্ঠানিকভাবে সংহত হয়ে আইন দ্বারা সুরক্ষিত হয়েছে। ফৌজদারি কার্যবিধির ১৩২ ধারা অনুযায়ী, সরকারি কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করতে হলে সরকারের অনুমোদন প্রয়োজন এবং যদি তারা ‘সৎ উদ্দেশ্যে’ কাজ করেন, তাহলে তারা দায়মুক্তি পান। এই ধরনের বিধান অপরাধীদের পক্ষে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপের সুযোগ তৈরি করেছে।

বাংলাদেশ জাতীয় মানবাধিকার কমিশন জাতিসংঘের নির্ধারিত মানদণ্ডের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়।

প্রতিবেদনে বলা আরও হয়, বাংলাদেশে পুলিশ নিজেই নিজেকে তদন্ত করার ক্ষমতা রাখে। পুলিশি অপরাধের অভিযোগ সাধারণত সেই একই এলাকার কর্মকর্তারা তদন্ত করেন যেখানে অভিযুক্তরা কর্মরত।

২০০৯ সালে পুলিশ অভ্যন্তরীণ পর্যবেক্ষণ ইউনিট গঠন করা হয়েছিল, কিন্তু এটি মূলত নিম্নপদস্থ কর্মকর্তাদের সামান্য অসদাচরণের বিষয়গুলোর তদন্তেই সীমাবদ্ধ ছিল।

বাংলাদেশের নিয়মিত বিচার ব্যবস্থা স্বাধীন পেশাদার প্রসিকিউশন সার্ভিসের অভাবে ভুগছে, যা পুলিশি তদন্তের তত্ত্বাবধান ও দিকনির্দেশনা দিতে পারত। কিন্তু এখানে সরকার নিয়োগপ্রাপ্ত আইনজীবীদের রাজনৈতিক আনুগত্যের ভিত্তিতে মামলা পরিচালনার জন্য নিয়োগ দিয়ে বিচারব্যবস্থাকে নিয়ন্ত্রণ করার চর্চা তৈরি করা হয়।

গত সরকারের আমলে পুরো বিচার বিভাগ ছিল অবহেলিত এবং পর্যাপ্ত অর্থায়নও এখানে ছিল না। বর্তমানে প্রায় ৪২ লাখ মামলা নিষ্পত্তির অপেক্ষায় রয়েছে, যার মধ্যে ২৪ লাখ ফৌজদারি মামলা।  

হাসিনা সরকারের আমলে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা কমে যায়। আদালত ব্যাপকভাবে রাজনৈতিক প্রভাব, দুর্নীতি এবং ভীতির শিকার হয় বলে মনে করা হয়। আইন মন্ত্রণালয় বিচারকদের বদলি ও পদোন্নতি পরিচালনা করে, যা বিচারকদের ওপর নেতিবাচক প্রভাব বিস্তার করে।

২০১৬ সালে সংসদ একটি সংবিধান সংশোধনী পাস করে, যা সংসদকে সরাসরি বিচারকদের অপসারণের ক্ষমতা দেয়। তবে ২০২৪ সালের ২০ অক্টোবর সুপ্রিম কোর্ট এই সিদ্ধান্ত বাতিল করে বিচারকদের অপসারণের ক্ষমতা সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের কাছে ফিরিয়ে দেয়।

অন্যান্য পর্যবেক্ষণ সংস্থাগুলোও একই ধরনের রাজনৈতিক প্রভাব, ক্ষমতাহীনতা এবং অযোগ্যতার শিকার হয়েছে।  

বাংলাদেশ জাতীয় মানবাধিকার কমিশন জাতিসংঘের নির্ধারিত মানদণ্ডের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়।

প্রতিবেদনে বলা হয়, অপরাধীদের দায়মুক্তি ভুক্তভোগীদের জন্য ন্যায়বিচার ও প্রতিকার পাওয়ার পথ রুদ্ধ করে। মানবাধিকার লঙ্ঘনের এই দায়মুক্তি পরবর্তী সময়ে সামাজিক ও রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা তৈরি করে, যা সংহতি ও স্থিতিশীলতার জন্য হুমকি সৃষ্টি করতে পারে।

বাংলাদেশ সময়: ১৫১৪ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ১২, ২০২৫
এমএম

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।