সাতক্ষীরা: দীর্ঘ দুই মাসের নিষেধাজ্ঞা শেষে সুন্দরবনে কাঁকড়া আহরণ শুরু হয়েছে। এতে স্বস্তির নিশ্বাস ফেলেছেন জেলেরা।
শনিবার (১ মার্চ) সকাল থেকে বন বিভাগের পাশ (অনুমতিপত্র) নিয়ে কাঁকড়া আহরণের লক্ষ্যে সুন্দরবনে প্রবেশ করছেন তারা।
পশ্চিম সুন্দরবনের সাতক্ষীরা রেঞ্জ অফিস সূত্রে জানা যায়, সাতক্ষীরা রেঞ্জের বুড়িগোয়ালিনী, কদমতলা, কৈখালী ও কোবাদক ফরেস্ট স্টেশনের আওতায় ২ হাজার ৯শটি নৌকার সুন্দরবনে প্রবেশের অনুমতিপত্র আছে। এর মধ্যে কাঁকড়া ধরার নৌকা ১ হাজার ৬শটি।
বন বিভাগ আরও জানায়, পশ্চিম সুন্দরবনের সাতক্ষীরা রেঞ্জের চারটি স্টেশনের আওতাধীন পুষ্পকাটি, মান্দারবাড়িয়া, নটাবেঁকি ও হলদেবুনিয়া এলাকা অভয়ারণ্য। এছাড়া দোবেকী ও কাঁচিকাটার ৫২ শতাংশ অভয়ারণ্য ঘোষিত। এছাড়াও সাতক্ষীরা রেঞ্জের সুন্দরবনের মধ্যে অভয়ারণ্য ঘোষিত ছোট কেয়াখালী খাল, বড় কেয়াখালী খাল, খোলশিবুনিয়া খাল ও সাপখালী খাল এবং ২৫ ফুটের কম প্রশস্ত খালে সারা বছরই কাঁকড়া ধরা নিষিদ্ধ থাকে। বাকি অংশের নদী ও খালে বৈধ পাস-পারমিটধারী প্রায় ১৫ হাজার জেলে শুধু কাঁকড়া আহরণ করে জীবন-জীবিকা নির্বাহ করেন। ১৯৯৮ সালে কাঁকড়া রপ্তানির নীতিমালা প্রণয়নের পর থেকেই প্রতিবছর দুই মাস কাঁকড়া ধরার পাস-পারমিট বন্ধ রাখা হয়।
জেলে পরিবারে স্বস্তি:
নিষেধাজ্ঞা উঠে যাওয়ায় স্বস্তি ফিরেছে উপকূলের বনজীবী পরিবারগুলোতে। শুরু হয়েছে কর্মচাঞ্চল্য।
সুন্দরবনসংলগ্ন দাঁতিনাখালী গ্রামের জেলে আব্দুল আজিজ মোড়ল (৫৫) বলেন, বাদাই (সুন্দরবনে) কোনো সচ্ছল মানুষ জীবনের ঝুঁকি নিয়ে কাঁকড়া ধরতে যায় না। যাঁরা যায়, তারা প্রায় সবাই দরিদ্র। দুই মাস নিষেধাজ্ঞা চলাকালে জেলেদের চরম দুর্দিন গেছে। বন্ধের দুই মাস সরকারিভাবে কোনো ভাতার ব্যবস্থা না থাকায় মানবেতর জীবনযাপন করতি (করতে) হুয়ে (হয়েছে)। শনিবার থেকে কাঁকড়া ধরার অনুমতি পেয়ে একটু স্বস্তি পাইছি (পেয়েছি)। ’
বুড়িগোয়ালিনীর দাঁতিনাখালীর মালঞ্চ নদীর চরে বেঁধে রাখা নৌকার পাটাতনে কাঁকড়া বাঁধার সরঞ্জাম গোছাচ্ছিলেন আফছার সানা (৬৫)। তিনি জানান, সুন্দরবনে কাঁকড়া ধরেই পাঁচ সদস্যের সংসার চালান। এলাকায় অন্য কোনো কাজ নেই। কাঁকড়া ধরা বন্ধ থাকায় বাড়িতে অলস সময় কাটাতে হয়েছে। গত দুই মাস সংসার চালাতে মহাজনদের কাছ থেকে প্রায় ২০ হাজার টাকা দাদন (বিশেষ শর্তে ঋণ) নিয়েছেন। এখন কাঁকড়া ধরে ঋণ পরিশোধ করেন তিনি।
একই এলাকার আকরাম হোসেন (৪৫) বলেন, আমরা উপকূলের মানুষ। আমাদের জীবন জীবিকার একমাত্র আয়ের পথ সুন্দরবন। গত দুই মাস সুন্দরবনের কাঁকড়া ধরার পাস পারমিট বন্ধ থাকার কারণে অভাব-অনটনে দিন কাটাতে হয়েছে।
নিষেধাজ্ঞা চলাকালীন অবৈধভাবে কাঁকড়া ধরার অভিযোগ-
তবে বন বিভাগ যে উদ্দেশ্যে দুই মাসের কাঁকড়া ধরায় নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছিল, তা সফল হয়নি বলে দাবি করেছেন স্থানীয়রা। কারণ হিসাবে তারা বলছেন, প্রজনন মৌসুমে কাঁকড়া শিকার নিষিদ্ধ হলেও তা উপেক্ষা করে অসাধু জেলেরা মাছ ধরার অনুমতি নিয়ে সুন্দরবনে ঢুকে ডিমওয়ালা মা কাঁকড়া শিকার করেছেন। এতে প্রকৃত জেলেরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। আর এসব অপকর্ম করতে সহযোগিতা করেছেন স্থানীয় প্রভাবশালী গোষ্ঠী। কোম্পানি মহাজনরা জেলেদের প্ররোচিত করে নিষিদ্ধ সময়ে কাঁকড়া আহরণে বাধ্য করেন। এ কাজে সহযোগিতা করেন বনবিভাগের অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। ঘুষ বাণিজ্যের মাধ্যমে অভয়ারণ্যের নদী-খালে ঢুকে মাছ-কাঁকড়া ধরার সুযোগ করে দেন তারা। অসাধু এই চক্রটিকে সহযোগিতা করেন নামধারী কিছু সাংবাদিক।
যা বলছে বনবিভাগ-
পশ্চিম সুন্দরবনের সাতক্ষীরা রেঞ্জের সহকারী বন সংরক্ষক (এসিএফ) মো. মসিউর রহমান বলেন, কাঁকড়া বৃদ্ধির লক্ষ্যে সুন্দরবনে বিভিন্ন নদী-খালে দুই মাস জেলেদের কাঁকড়া আহরণ নিষিদ্ধ ছিল। ১ মার্চ থেকে বন বিভাগের অনুমতি নিয়ে জেলেরা প্রবেশ নিষিদ্ধ অভয়াশ্রম ছাড়া অন্য নদী-খালে কাঁকড়া আহরণ করতে পারবেন। তবে কেউ যাতে সুন্দরবনে কাঁকড়া ধরার অনুমতি নিয়ে বেআইনি কর্মকাণ্ডে জড়িত হতে না পারে, সে জন্য বনরক্ষীদের টহল ও অন্যান্য কার্যক্রম জোরদার করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। তবে ইঞ্জিনচালিত নৌকা বা ট্রলারে কাঁকড়া পরিবহনে নিষেধাজ্ঞা রয়েছে।
বাংলাদেশ সময়: ১৩২৭ ঘণ্টা, মার্চ ১, ২০২৫
এমআরএম