ঢাকা, বুধবার, ৫ চৈত্র ১৪৩১, ১৯ মার্চ ২০২৫, ১৮ রমজান ১৪৪৬

জাতীয়

নিক্কেই এশিয়ার প্রতিবেদন

বাংলাদেশ-পাকিস্তান ঘনিষ্ঠতায় কৌশলগত চাপে ভারত

নিউজ ডেস্ক  | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২০৫০ ঘণ্টা, মার্চ ১৯, ২০২৫
বাংলাদেশ-পাকিস্তান ঘনিষ্ঠতায় কৌশলগত চাপে ভারত বাঁয়ে শেহবাজ শরিফ, মধ্যে নরেন্দ্র মোদী, ডানে অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস

শীর্ষ পর্যায়ের কূটনীতি কখনো কখনো আন্তর্জাতিক সম্পর্কের অচলাবস্থা ভাঙতে পারে এবং এমনকি বৈশ্বিক ব্যবস্থাকেও প্রভাবিত করতে পারে, যেমনটি ইউক্রেন ইস্যুতে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখা গেছে।

হোয়াইট হাউসে ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কির বিরুদ্ধে তার সাম্প্রতিক ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া এবং রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের প্রতি নমনীয় মনোভাব ইউরোপীয় ইউনিয়নকে (ইইউ) প্রতিরক্ষা ব্যয় বাড়ানো ও নিজেদের পুনরায় সশস্ত্র করার পরিকল্পনা নিতে উদ্বুদ্ধ করেছে।

ছোট পরিসরে হলেও পাকিস্তান ও বাংলাদেশের উচ্চপর্যায়ের যোগাযোগ দক্ষিণ এশিয়ার আঞ্চলিক পরিস্থিতি বদলে দিচ্ছে। গত সেপ্টেম্বরে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে যোগ দিতে গিয়ে নিউইয়র্কে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শেহবাজ শরিফের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। এই পদক্ষেপ দুই দেশের সম্পর্কোন্নয়নের পথে নতুন গতি এনেছে।

এর দুই মাস পর বাংলাদেশ ও পাকিস্তান দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যে গুরুত্বপূর্ণ অগ্রগতি হিসেবে প্রথম নিয়মিত কার্গো শিপিং রুট চালু করে। এরপর ডিসেম্বর মাসে, সাত বছর পর দুই দেশের মধ্যে সরাসরি বিমান চলাচল পুনরায় শুরু হয়। নতুন বছরেও এই গতি অব্যাহত থাকে। জানুয়ারিতে পাকিস্তানের শীর্ষ ব্যবসায়ীদের একটি প্রতিনিধিদল ঢাকা সফর করে, যেখানে অর্থনৈতিক সহযোগিতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে একটি যৌথ পরিষদ গঠনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।

আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) তথ্যানুসারে, ২০২২ সালে বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের মধ্যে বাণিজ্যের পরিমাণ ছিল মাত্র এক বিলিয়ন ডলার। এতে মূলত পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশে তুলা রপ্তানি এবং বাংলাদেশ থেকে পাকিস্তানে পাট রপ্তানি অন্তর্ভুক্ত ছিল। ফেব্রুয়ারিতে জাপান সফরের সময়, বাংলাদেশের বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিডা) নির্বাহী চেয়ারম্যান আশিক চৌধুরী দ্বিপক্ষীয় সহযোগিতার আরও সম্ভাবনার ওপর গুরুত্বারোপ করেন, বিশেষ করে চিনি উৎপাদনে।

‘বাংলাদেশের বৃহৎ রাষ্ট্রায়ত্ত চিনি উৎপাদন অবকাঠামো ও কারখানা রয়েছে... কিন্তু আমরা চিনি আমদানি করি, কারণ আমাদের উৎপাদন পর্যাপ্ত নয়,’ বলেন আশিক চৌধুরী। পাকিস্তানের বিনিয়োগ বাংলাদেশে বিদ্যমান কারখানাগুলো আধুনিকায়নে সহায়তা করতে পারে এবং দেশের বাজারের চাহিদা মেটাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। ‘যেসব খাতে পাকিস্তান দক্ষ, সেগুলো আমরা ভালোভাবে কাজে লাগাতে পারি,’ বলেন তিনি।

সম্পর্কের উন্নতি শুধু অর্থনৈতিক সহযোগিতার মধ্যেই সীমাবদ্ধ নেই। জানুয়ারিতে, বাংলাদেশের ঊর্ধ্বতন সামরিক কর্মকর্তারা পাকিস্তান সফর করেন, যেখানে যৌথ সামরিক মহড়া ও অস্ত্র সরবরাহ নিয়ে আলোচনা হয়। সম্পর্কের প্রসার শিক্ষা ও সংস্কৃতিতেও ছড়িয়ে পড়েছে। শিক্ষার্থী বিনিময়ের জন্য দুই দেশের মধ্যে বৃত্তি কার্যক্রম চালু করা হচ্ছে। পাশাপাশি ঢাকায় পাকিস্তানি কাওয়ালি শিল্পীর সংগীত পরিবেশনার আয়োজনও করা হয়েছে।

তবে, বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের সম্পর্ক ইতিহাসের এক জটিল ও বিতর্কিত অধ্যায়ের মাধ্যমে গড়ে উঠেছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষে ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ শাসিত ভারত ধর্মীয় ভিত্তিতে দুটি দেশে বিভক্ত হয়— এক হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ ভারত, দুই মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ পাকিস্তান। নতুন ইসলামিক রাষ্ট্রটি দুটি ভাগে বিভক্ত ছিল— পশ্চিম পাকিস্তান (বর্তমান পাকিস্তান) এবং পূর্ব পাকিস্তান (বর্তমান বাংলাদেশ)। মাঝে ছিল ভারতের ভূখণ্ড।

১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে বাংলাদেশ স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে, যেখানে ভারত গুরুত্বপূর্ণ সমর্থন দেয়। তবে পশ্চিম পাকিস্তানি বাহিনীর হাতে প্রায় ৩০ লাখ মানুষ হত্যার শিকার হয়, যা বাংলাদেশের হৃদয়ে গভীর ক্ষোভের জন্ম দেয়।  

বাংলাদেশের প্রথম রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমানের কন্যা শেখ হাসিনা দ্বিতীয় মেয়াদে প্রধানমন্ত্রী হয়ে ক্ষমতায় আসেন ২০০৯ সালে। এরপর তিনি ভারতের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে তোলেন এবং পাকিস্তানের প্রতি কঠোর অবস্থান নেন, যুদ্ধাপরাধের বিচারের অঙ্গীকার করেন।

গত আগস্টে ব্যাপক সরকারবিরোধী আন্দোলনের মুখে শেখ হাসিনা ক্ষমতাচ্যুত হন। শহীদ ও বীর মুক্তিযোদ্ধাদের পরিবারকে দেওয়া বিশেষ সুবিধা নিয়ে জনগণের অসন্তোষ থেকেই এই আন্দোলনের সূত্রপাত হয়। তার ১৫ বছরের শাসনকে অনেকেই কর্তৃত্ববাদী হিসেবে দেখেছে, আর এই ক্ষোভের বড় অংশ ভারতের দিকেও ছিল। ভারত ছিল তার প্রধান মিত্র।

বাংলাদেশি গণমাধ্যম ঢাকা ট্রিবিউন একটি নিবন্ধ প্রকাশ করে, যার শিরোনাম ছিল ‘বাংলাদেশ সম্পর্কে ভারতের জানা দরকার এমন ১০টি বিষয়’। এতে ভারতের মনোভাবের সমালোচনা করা হয় এবং উল্লেখ করা হয়: সবচেয়ে বিরক্তিকর হলো পুরোনো সেই ‘আমাদের জন্যই তোমরা স্বাধীন’ কথাটি। ১৯৭১ সালে ভারতের ভূমিকা অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ ছিল, তবে এখন এই বক্তব্য থেকে সরে আসার সময় হয়েছে।

ভারতে পালিয়ে থাকা শেখ হাসিনা এখনো অন্তর্বর্তী সরকারের সমালোচনা করে চলেছেন। এই সরকার দেশের স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনার দায়িত্বে রয়েছে। তার প্রত্যাবর্তন নিয়ে ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে টানাপোড়েন তৈরি হয়েছে। অন্যদিকে, অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস এখনো ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর সঙ্গে সরাসরি বৈঠক করেননি। তবে ডিসেম্বর মাসে তিনি দ্বিতীয়বারের মতো পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শেহবাজ শরিফের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন।

উন্নয়নশীল ইসলামিক দেশগুলোর অর্থনৈতিক সহযোগিতার প্ল্যাটফর্ম ডি-এইট সম্মেলনের সাইডলাইনে শেহবাজ শরিফ বলেন, পাকিস্তান ভ্রাতৃপ্রতিম দেশ বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ক আরও জোরদার করতে আগ্রহী। এর জবাবে, অধ্যাপক ইউনূস দক্ষিণ এশীয় আঞ্চলিক সহযোগিতা সংস্থা (সার্ক) পুনরুজ্জীবিত করার প্রস্তাব দেন এবং এর সম্মেলন ঢাকায় আয়োজনের আহ্বান জানান।

১৯৮৫ সালে প্রতিষ্ঠিত সার্ক (দক্ষিণ এশীয় আঞ্চলিক সহযোগিতা সংস্থা) আটটি সদস্য রাষ্ট্রের একটি আঞ্চলিক প্ল্যাটফর্ম। সার্কভুক্ত দেশগুলোর সম্মিলিত জিডিপি বিশ্ব অর্থনীতির মাত্র ৪ শতাংশ। তবে এসব দেশে বসবাসকারী জনসংখ্যা বিশ্বের মোট জনসংখ্যার ২৫ শতাংশ। ২০১৪ সালের পর কোনো সম্মেলন না হওয়ায় সংস্থাটি কার্যত অচল অবস্থায় রয়েছে।

ইউনূস কেন এখন এই প্রায় ‘অচল’ সংস্থাটিকে পুনরুজ্জীবিত করার প্রসঙ্গ তুলেছেন, তা বুঝতে হলে ৪০ বছর আগে সার্কের প্রতিষ্ঠার পেছনের প্রেক্ষাপট ফিরে দেখা জরুরি। সার্ক গঠনের প্রধান প্রেক্ষাপট ছিল ১৯৭৯ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের আফগানিস্তান আক্রমণ। ১৯৭১ সালে ভারত সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে শান্তি, মৈত্রী ও সহযোগিতা চুক্তি সই করে, যা কার্যত একটি সামরিক জোটের সমতুল্য ছিল। কিন্তু দক্ষিণ এশিয়ার অন্য দেশগুলোর তেমন কোনো নিরাপত্তার নিশ্চয়তা ছিল না।  

এই পরিস্থিতিতে উদ্বিগ্ন হয়ে বাংলাদেশের ষষ্ঠ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান ১৯৮০ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে সার্ক গঠনের প্রস্তাব দেন। প্রস্তাবটি প্রথমে সন্দেহের চোখে দেখেছিল ভারত। দক্ষিণ এশিয়ার প্রধান শক্তি হিসেবে ভারত বহুপক্ষীয় আলোচনার চেয়ে দ্বিপক্ষীয় আলোচনাকেই প্রাধান্য দিত। তারা আশঙ্কা করেছিল, আঞ্চলিকভাবে সম্মিলিত উদ্যোগ নেওয়া হলে তাদের প্রভাব কমে যেতে পারে।

তবে, শেষ পর্যন্ত ভারত যুক্তরাষ্ট্রের চাপের মুখে সার্কে যোগ দিতে রাজি হয়। তখনকার মার্কিন প্রেসিডেন্ট জিমি কার্টার সোভিয়েত প্রভাব কমাতে চাচ্ছিলেন। স্বঘোষিত নিরপেক্ষ নীতির পরও সোভিয়েতপন্থী হিসেবে চিহ্নিত হওয়ার ঝুঁকি এবং কূটনৈতিকভাবে বিচ্ছিন্ন হওয়ার শঙ্কা এড়াতে ভারত সার্কে যোগ দেয়। তবে, শর্ত ছিল— সংস্থার সব সিদ্ধান্ত সর্বসম্মতিক্রমে নেওয়া হবে এবং দ্বিপক্ষীয় বিষয়গুলো আলোচনার বাইরে থাকবে।

সার্ক গঠনের ক্ষেত্রে ১৯৬৭ সালে প্রতিষ্ঠিত আসিয়ানের কিছুটা প্রভাব থাকতে পারে। তবে দুটি সংস্থার উদ্দেশ্য আলাদা ছিল। আসিয়ান গঠিত হয়েছিল কমিউনিস্ট চীনের বিস্তার রোধে ঐক্যবদ্ধ হতে, কিন্তু সার্ককে বরাবরই ভারতের প্রভাব মোকাবিলা করতে হয়েছে। প্রতিষ্ঠাতা দেশগুলো সোভিয়েত হুমকিকে কৌশলীভাবে ব্যবহার করে ভারতকে সার্কে অন্তর্ভুক্ত করতে সক্ষম হয়েছিল। তবে এর বিনিময়ে তাদের একটি বড় মূল্য দিতে হয়েছে— সার্কের প্রতিটি সিদ্ধান্তে ভারতের আধিপত্য মেনে নেওয়া।

অনেক দিক থেকেই সার্ক শুরু থেকেই আসিয়ানের চেয়ে এগিয়ে ছিল। সংস্থাটি দ্রুতই একটি সনদ নেয়, যা কার্যত একটি আঞ্চলিক সংবিধানের মতো কাজ করে। পাশাপাশি, প্রতিবছর শীর্ষ সম্মেলন আয়োজনকে নিয়মিত চর্চায় পরিণত করে। ২০০৫ সালে সার্ক আফগানিস্তানকে অষ্টম সদস্য হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করে এবং জাপান, যুক্তরাষ্ট্র, চীন ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের মতো দেশ ও সংস্থাগুলোকে পর্যবেক্ষক হিসেবে স্বাগত জানায়।

তবে সার্কের শীর্ষ সম্মেলন রাজনৈতিক অস্থিরতাসহ নানা কারণে বারবার বাধাগ্রস্ত হয়েছে। ২০১৬ সালে  পাকিস্তানভিত্তিক উগ্রবাদীদের হামলায় ক্ষুব্ধ হয়ে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী পাকিস্তানে নির্ধারিত সার্ক সম্মেলনে যোগ দিতে অস্বীকৃতি জানান। পরে শেখ হাসিনাও একই অবস্থান নেন। এর ফলে ওই সম্মেলন অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত করা হয় এবং এরপর থেকে সার্ক কার্যত অচল হয়ে পড়ে।

এরপর থেকে মোদী ও হাসিনা পশ্চিমমুখী সার্কের বদলে পূর্বমুখী আঞ্চলিক সহযোগিতার দিকে নজর দেন। তারা বেশি গুরুত্ব দিতে শুরু করেন বে অব বেঙ্গল ইনিশিয়েটিভ ফর মাল্টি-সেক্টরাল টেকনিক্যাল অ্যান্ড ইকোনমিক কো-অপারেশনকে (বিমসটেক)। ১৯৯৭ সালে প্রতিষ্ঠিত এবং ঢাকায় সদরদপ্তর থাকা এই সংস্থার সদস্য সাতটি। দক্ষিণ এশিয়ার পাঁচটি দেশ (বাংলাদেশ, ভারত, শ্রীলঙ্কা, নেপাল ও ভুটান) এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দুই দেশ (থাইল্যান্ড ও মিয়ানমার)। লক্ষণীয় বিষয় হলো, এতে পাকিস্তান নেই।

জাপান এক্সটার্নাল ট্রেড অর্গানাইজেশনের ইনস্টিটিউট অব ডেভেলপিং ইকোনমিজ-এর নির্বাহী সহ-সভাপতি মায়ুমি মুরায়ামা বলছিলেন, গত এক দশক ধরে ভারত ও বাংলাদেশ এমনভাবে তাদের কার্যক্রম চালিয়েছে, যেন দক্ষিণ এশিয়ায় পাকিস্তানের অস্তিত্বই নেই। তার মতে, ইউনূসের সার্ক পুনরুজ্জীবনের পরিকল্পনা মূলত ‘পাকিস্তানকে আবার দক্ষিণ এশীয় কাঠামোয় ফিরিয়ে আনা এবং ভূরাজনৈতিক পরিস্থিতিকে হাসিনা-পরবর্তী সময়ে পুনর্বিন্যাস করার একটি উদ্যোগ। ’

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক লাইলুফার ইয়াসমিন ইউনুসের উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়েছেন। তিনি বলেন, এটি দক্ষিণ এশিয়ায় আঞ্চলিক সহযোগিতা বৃদ্ধিতে বাংলাদেশের ঐতিহাসিক ভূমিকার পুনর্জাগরণকে তুলে ধরে। তিনি আরও বলেন, ‘এটি প্রমাণ করে যে বাংলাদেশ এখন নির্দিষ্ট কোনো দেশের (ভারতের) ওপর নির্ভর না করে সব দেশের সঙ্গে মিলেমিশে কাজ করতে চায়। ’

তবে নয়াদিল্লির সেন্টার ফর সোশ্যাল অ্যান্ড ইকোনমিক প্রোগ্রেসের জ্যেষ্ঠ গবেষক কনস্টান্টিনো জেভিয়ার এ বিষয়ে সন্দিহান। তিনি বলেন, ভারত সার্ক-এ নতুন করে সক্রিয় হবে না, যতক্ষণ না পাকিস্তানের সঙ্গে তার দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক স্বাভাবিক হয়। তার মতে, ‘গত প্রায় এক দশক ধরে ভারত এ নীতিতেই চলছে, এবং বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের আশা ও আহ্বান সত্ত্বেও এতে পরিবর্তনের সম্ভাবনা কম। ’

জেভিয়ারের মতে, ইউনূসের সার্ক পুনরুজ্জীবিত চেষ্টা কিছুটা বিস্ময়কর। তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশেই বিমসটেকের সদরদপ্তর রয়েছে, যা সার্কের বিকল্প একটি আঞ্চলিক সহযোগিতা প্ল্যাটফর্ম এবং কার্যক্রমের দিক থেকে অনেক বেশি সক্রিয়। এটি বাংলাদেশের ভূ-অর্থনৈতিক স্বার্থের সঙ্গেও বেশি সামঞ্জস্যপূর্ণ। ’

জেভিয়ার আরও বলেন, ‘ইউনূসের সার্ক নিয়ে আগ্রহ হয়তো আঞ্চলিক সহযোগিতা নিয়ে তার পুরনো চিন্তার প্রতিফলন, নয়তো এটি একটি রাজনৈতিক কৌশল— হাসিনার বিমসটেক কেন্দ্রিক নীতির বিপরীতে অবস্থান নেওয়া, পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক জোরদার করা এবং ভারতের মনোযোগ আকর্ষণ করার চেষ্টা। ’

তবে এই মুহূর্তে বিশ্ব রাজনীতি দ্রুত পরিবর্তন আসছে এবং ‘ট্রাম্প ২.০’ যুগের অনিশ্চয়তার মধ্যে আঞ্চলিক জোটগুলোর গুরুত্ব আরও বাড়বে বলে মনে করা হচ্ছে।

সম্প্রতি কলম্বিয়ার প্রেসিডেন্ট গুস্তাভো পেত্রো যুক্তরাষ্ট্র থেকে তাড়িয়ে দেওয়া কলম্বিয়ানদের বহনকারী দুটি সামরিক বিমানের অবতরণ নিষিদ্ধ করলে দেশটি ট্রাম্প প্রশাসনের সঙ্গে কূটনৈতিক টানাপোড়েনে জড়িয়ে পড়ে। এতে আঞ্চলিক জোট কমিউনিটি অব লাতিন আমেরিকান অ্যান্ড ক্যারিবিয়ান স্টেটস (সিল্যাক) যৌথ প্রতিক্রিয়া নিয়ে আলোচনা করতে জরুরি সম্মেলন ডাকার কথা ভেবেছিল। তবে শেষ পর্যন্ত সেই পরিকল্পনার বাস্তবায়ন হয়নি।

একইভাবে ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) ঘন ঘন সম্মেলনের মাধ্যমে বারবার তাদের ঐক্য পুনর্ব্যক্ত করেছে। আর আসিয়ান ছয়টি উপসাগরীয় দেশের সমন্বয়ে গঠিত গাল্ফ কো-অপারেশন কাউন্সিলের (জিসিসি) সঙ্গে সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ করার চেষ্টা চালাচ্ছে। এসব উদ্যোগ বিশ্বব্যাপী যৌথ আত্মরক্ষার প্রবণতার প্রতিফলন।

কূটনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা থাকলেও একই অঞ্চলের দেশগুলো বহিরাগত চাপ মোকাবিলায় প্রায়ই এক ধরনের চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হয়। দক্ষিণ এশিয়ায় প্রভাবশালী শক্তি হিসেবে ভারত চাইলে সার্ক ব্যবহার করে যুক্তরাষ্ট্রের চাপ মোকাবিলা করতে বা চীনের ক্রমবর্ধমান প্রভাব প্রতিহত করতে কৌশলগত সুবিধা নিতে পারে।

সামনে এক গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্ত। সবকিছু পরিকল্পনা অনুযায়ী এগোলে এপ্রিলের প্রথম দিকে থাইল্যান্ডে অনুষ্ঠিত বিমসটেক সম্মেলন হবে ইউনূস ও মোদীর প্রথম সরাসরি সাক্ষাৎস্থল। এখন দক্ষিণ এশিয়ার জন্য বড় প্রশ্ন হলো— যদি ইউনূস সার্ক পুনরুজ্জীবিত করার প্রস্তাব দেন, তাহলে মোদী কীভাবে প্রতিক্রিয়া জানাবেন? 

মোদীর ‘নেইবার ফার্স্ট’ নীতির ভবিষ্যৎ অনেকটাই এর ওপর নির্ভর করবে।

বাংলাদেশ সময়: ২০৩৯ ঘণ্টা, মার্চ ১৯, ২০২৫
আরএইচ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।