বাংলাদেশে দীর্ঘ ১৫ বছর জেঁকে বসেছিল ফ্যাসিবাদী শাসন। জুলাই গণঅভ্যুত্থানের মধ্যে দিয়ে দীর্ঘদিনের ফ্যাসিবাদের অবসান হয়েছে।
এ বছর শোভাযাত্রার প্রতিপাদ্য ছিল ‘নববর্ষের ঐকতান, ফ্যাসিবাদের অবসান’। দীর্ঘ তিন দশক পেরিয়ে আবারও নববর্ষের শোভাযাত্রার নাম ‘আনন্দ শোভাযাত্রা’ হিসেবে ফিরে পেয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
শোভাযাত্রায় অংশ নিতে সকাল থেকেই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থী থেকে শুরু করে বিভিন্ন শ্রেণিপেশার মানুষ টিএসসি এলাকায় এসেছেন। শোভাযাত্রায় আসা পুরুষদের অনেকেই পরেছেন পাঞ্জাবি। নারীদের অনেকের পরনে বাঙালির চিরাচরিত শাড়ি; কারও কারও মাথায় সমন্বিত ফুলের টায়রা। সবার চোখে দীর্ঘ সময়ের ফ্যাসিবাদী শাসন পেরিয়ে নতুন দেশ গড়ার প্রত্যয়।
নতুন বর্ষকে স্বাগত জানিয়ে অনেকেই গালে অল্পনা এঁকেছেন। আল্পনায় কেউ কেউ লিখেছেন শুভ নববর্ষ-১৪৩২। অনেকেই পরিবারের সদস্যদের নিয়ে এসেছেন।
সকাল ৯টায় চারুকলা অনুষদের সামনে থেকে শোভাযাত্রাটি শুরু হয়। পরে শাহবাগ মোড় ঘুরে টিএসসি মোড়, শহীদ মিনার, শারীরিক শিক্ষা কেন্দ্র, দোয়েল চত্বর হয়ে বাংলা একাডেমির সামনের রাস্তা দিয়ে পুনরায় চারুকলা অনুষদে গিয়ে শেষ হয়।
শোভাযাত্রায় অংশ নিয়েছেন সংস্কৃতি উপদেষ্টা মোস্তফা সরওয়ার ফারুকী। এবারের শোভাযাত্রা বাঙালির প্রাণের উৎসব থেকে বাংলাদেশিদের প্রাণের উৎসব হিসেবে পরিণত হয়েছে বলে জানিয়েছেন তিনি।
তিনি বলেন, এবার শোভাযাত্রা রাজনৈতিক নয়। আমরা এবার শুধুমাত্র ফ্যাসিস্টের মুখাবয়ব ব্যবহার করেছি। কারণ ফ্যাসিস্ট কোনো রাজনীতির অংশ নয়। ফ্যাসিস্ট সবচেয়ে বড় অশুভ শক্তি।
তিনি বলেন, তবে এখানে বাংলাদেশের রাজনীতি রয়েছে। এখানে বাংলাদেশের সকল জনগোষ্ঠী, সকল ঐতিহ্য-সেই আকবর আমলের ঐতিহ্য, সুলতানি আমলের ঐতিহ্য সবকিছুর মিশ্রণ এখানে দেখবেন। তবে টিপিক্যাল রাজনীতির কিছু এখানে নাই।
তিনি আরও বলেন, এটা আর কেবল বাঙালির প্রাণের উৎসব নয়। এটাকে আমরা অনেকদিন বাঙালির প্রাণের উৎসব বানিয়ে রেখেছি। এটি বাংলাদেশের প্রাণের উৎসব। বাঙালি, চাকমা, মারমা, গারোসহ সকল জনগোষ্ঠী বর্ষবরণ পালন করে। ফলে আমরা এটাকে বাংলাদেশের উৎসব হিসেবে পালন করা শুরু করলাম।
আনন্দ শোভাযাত্রায় যা ছিল
এবারের আনন্দ শোভাযাত্রায় পুরনো ঐতিহ্য ও স্বকীয়তার পাশাপাশি লোক-শিল্প ও জুলাই গণঅভ্যুত্থানের ছাপ রাখা হয়েছে। শোভাযাত্রায় সবার সামনে পুলিশের সুসজ্জিত ১৮টি ঘোড়ার বহর রাখা হয়েছে।
এরপর ছিলেন ২৮ জাতিগোষ্ঠীর শিল্পীরা। এরমধ্যে ম্রো, মারমা, লুসাই, বম, খিয়াং, চাকমা, ত্রিপুরা, তঞ্চঙ্গ্যা, পাংখোয়া, সাঁওতাল, মাহালী, কোল, মালপাহাড়িয়া, হাজংসহ একাধিক জাতিগোষ্ঠী রয়েছে। ডোল-তবলায় নিজস্ব সংস্কৃতিতে নেচে গেয়ে তারা শোভাযাত্রা উৎসবকে রাঙিয়ে তুলেছেন।
এরপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের একটি অংশ নেয়। শোভাযাত্রায় এরপর ছিলেন বাংলাদেশ নারী ফুটবল দলের সদস্যরা। এরপর ছিলেন সংস্কৃতি উপদেষ্টা মোস্তফা সরওয়ার ফারুকী। এরপর চারুকলার মূল ব্যানার স্থান পেয়েছে।
ব্যানারের সাথে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক নিয়াজ আহমেদ খান, উপ-উপাচার্য (শিক্ষা) অধ্যাপক মামুন আহমেদ, উপ-উপাচার্য (প্রশাসন) অধ্যাপক সায়মা হক বিদিশা, প্রক্টর সহযোগী অধ্যাপক সাইফুদ্দীন আহমদ ও রেজিস্ট্রার মুন্সি শামস উদ্দিন আহমেদসহ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, কর্মকর্তা-কর্মচারীরা উপস্থিত ছিলেন।
এরপর স্থান পেয়েছে হাতে বানানো ঘোড়ার দল এবং ব্যান্ডদল। এ বছর কৃষকদের তুলে ধরতে একদল প্রতীকীভাবে কৃষকদের পোশাক পরেছিলেন। তারা কৃষকদের মাথায় দেওয়া মাথুল পরেছেন। এছাড়া হাতে সজলী, গায়ে সাদা গেঞ্জি, লুঙ্গি ও কোমরে গামছা পরেছেন। এরপর স্থান পেয়েছে ঘোড়ার গাড়ি।
এরপর স্থান পেয়েছে এবারের আনন্দ শোভাযাত্রার ছোটবড় সব মোটিফ। এ বছর প্রধান ৭টি মোটিফ রাখা হয়েছে। এরমধ্যে বাংলাদেশে দীর্ঘসময়ের ফ্যাসিবাদী শাসনের চিত্র তুলে ধরতে ‘ফ্যাসিবাদের মুখাকৃতি’ মোটিফ রাখা হয়েছে।
বাঁশের বেত-কাঠ দিয়ে মুখাকৃতিটি তৈরির পর শনিবার ভোরে এক দুর্বৃত্ত এটি জ্বালিয়ে দেন। পরে কর্কশিট দিয়ে পুনরায় এটি তৈরি করা হয়।
এবারের শোভাযাত্রায় জুলাই গণঅভ্যুত্থানে শহীদ আবু সাঈদের ‘প্রতীকী মোটিফ’ রাখার প্রাথমিক চিন্তা ছিল। তবে পরিবারের অনুরোধে সেটি আর রাখা হয়নি।
আবু সাঈদের প্রসারিত দুইহাত না থাকলেও আনন্দ শোভাযাত্রায় স্থান পেয়েছে মুগ্ধের প্রতীকী পানির বোতল। একটি বিশালাকৃতির বোতল তৈরি করে তারমধ্যে সহস্রাধিক বোতল রাখা হয়েছে এই মোটিফে। জুলাই গণঅভ্যুত্থানে জীবন দেওয়া শহীদদের প্রতি ইঙ্গিত করে এই মোটিফ করা হয়েছে।
এছাড়াও এবারের শোভাযাত্রায় বাংলাদেশের জাতীয় প্রতীক বাঘ, ইলিশ মাছ, শান্তির পায়রা, পালকি স্থান পেয়েছে। শান্তির পায়রার মাথায় পাঁচটি প্রতীকী হাত রাখা হয়েছে। সেখানে ‘মুসলিম’, ‘হিন্দু’, ‘বৌদ্ধ’, ‘খ্রিস্টান’, ও ‘বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠী’ শব্দ লেখা হয়েছে।
এ বছর ফিলিস্তিনের নিপীড়িত মুসলমানদের লড়াই সংগ্রামের সঙ্গে সংহতি জানিয়ে তরমুজের ফালি মোটিফ হিসেবে রাখা হয়েছে। তরমুজ ফিলিস্তিনিদের কাছে প্রতিরোধ ও অধ্যাবসায়ের প্রতীক হিসেবে পরিচিত।
বড় মোটিফের পাশাপাশি এবছর মাঝারি মোটিফ ছিল ৭টি। এরমধ্যে সুলতানি ও মুঘল আমলের মুখোশ, রঙিন চরকি, তালপাতার সেপাই, তুহিন পাখি, পাখা, ঘোড়া ও লোকজ চিত্রাবলির ক্যানভাস রয়েছে।
এছাড়া ছোট মোটিফগুলোর মধ্যে ফ্যাসিবাদের মুখাকৃতি, বাঘের মাথা, পলো, মাছের চাঁই, মাথাল, লাঙল এবং মাছের ডোলা রাখা হয়েছে।
এবারের শোভাযাত্রায় বিশেষ স্থান করে নিয়েছে বাংলার প্রাচীন সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য পটচিত্র। পট বা বস্ত্রের ওপর এই লোকচিত্র আঁকা হয়। চারুকলায় এবার ১০০ ফুট দীর্ঘ লোকজ চিত্রাবলির পটচিত্র আঁকা হয়েছে।
এবারের পটচিত্রে আকবর; বাংলাদেশের জাতীয় পশু বাঘ; বাংলাদেশের ঐতিহাসিক সংগ্রাম ১৯৫২ ও ১৯৭১ এবং ২০২৪ সালের জুলাই অভ্যুত্থানে শহীদ আবু সাঈদ; বেহুলা লখিন্দর; বনবিবি এবং গাজীরপট আঁকা হয়েছে। প্রত্যেকটি চিত্রে উল্লেখযোগ্যভাবে বাঘ এবং বাঘের রঙ।
এবারের শোভাযাত্রায় কেউ কেউ বিভিন্ন প্ল্যাকার্ড নিয়ে এসেছেন। প্ল্যাকার্ডে ‘হাসিনার বিচার কর’, ‘জুলাই গণহত্যার বিচার কবে?’, ‘ভারতের সাথে সকল অসম চুক্তি বাতিল কর’, ‘নদী বাঁচাও’ লেখা দেখা গেছে।
এছাড়া বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর সদস্যরা বাংলাদেশের লোকজ দা, বটি, ছাত্রা, কুলাসহ বিভিন্ন প্রতীকী নিয়ে এসেছেন।
শোভাযাত্রা উপলক্ষে রোববার বিকেল থেকেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করা হয়। নিরাপত্তার স্বার্থে বাংলামোটর, বার্ন ইউনিট, বারডেম এবং মৎস্যভবন থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রবেশের রাস্তায় ব্যারিকেড দেওয়া হয়। এছাড়া সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের রমনা কালিমন্দির, রাজু ভাস্কর্যের পেছনে ও ছবির হাটের ফটক বন্ধ রাখা হয়।
সোমবার সকাল থেকে আনন্দ শোভাযাত্রা শেষ হওয়া পর্যন্ত মেট্রোরেলের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও শাহবাগ বন্ধ ছিল। শোভাযাত্রা চলাকালীন বিপুল পরিমাণ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যের পাশাপাশি রোভার স্কাউট, বিএনসিসির সদস্যরা নিয়োজিত ছিলেন।
প্রতিবারের মতো এবারও আয়োজনে ছিল চারুকলা অনুষদ। গত একমাস ধরে তারা এই শোভাযাত্রার প্রস্তুতি নিয়েছেন। তবে এবার অন্যান্য বছরের মতো বর্তমান শিক্ষার্থীদের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ দেখা যায়নি।
২০০৬ সাল থেকে প্রতিবছর একটি করে ব্যাচকে বর্ষবরণ উদযাপনের দায়িত্ব দেওয়া হয়। ধারা অনুযায়ী এবার ২৬ ব্যাচ এই দায়িত্ব পাওয়ার কথা। তবে আয়োজনে ‘রাষ্ট্রীয় হস্তক্ষেপের’ অভিযোগ তুলে অনুষদের ২৬ ব্যাচের এই শিক্ষার্থীরা এবারের কার্যক্রম থেকে বিরত থেকেছেন।
১৯৮৯ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদ থেকে শুরু হওয়া এই উৎসব অল্প সময়ের মধ্যেই মানুষের কাছে পৌঁছে গেছে। গত তিনদশকে ঢাকার পাশাপাশি দেশের বিভিন্ন স্থানে এই শোভাযাত্রা বের হয়েছে। ২০১৬ সালে ইউনেসকো এই শোভাযাত্রাকে সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের স্বীকৃতি দেয়।
বাংলাদেশ সময়: ১১৪১ ঘণ্টা, এপ্রিল ১৪, ২০২৫
এমএম