অনিয়ম, দুর্নীতি আর লুটপাটের মাধ্যমে বিদ্যুৎ খাত থেকে ইউনাইটেড গ্রুপ হাতিয়ে নিয়েছে হাজার হাজার কোটি টাকা। বিদ্যুৎকেন্দ্র অলস বসিয়ে রেখে শুধু ক্যাপাসিটি চার্জের নামে করেছে হরিলুট।
৪৭৮ কোটি টাকার গ্যাস বিল বকেয়া থাকায় সোমবার (২৮ এপ্রিল) ঢাকা ইপিজিডে অবস্থিত ইউনাইটেড গ্রুপের বিদ্যুৎকেন্দ্রের গ্যাস সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছে তিতাস গ্যাস কর্তৃপক্ষ। ২০১৮ সাল থেকে পুঞ্জিভূত ওই বকেয়ার বিষয়ে বারবার তাগাদা দেওয়ার পরও বিল পরিশোধ না করায় তাদের সংযোগ বিচ্ছিন্ন করার তথ্য নিশ্চিত করেছেন তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক শাহনেওয়াজ পারভেজ।
রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান আশুগঞ্জ পাওয়ার স্টেশন কোম্পানির (এপিএসসিএল) ২০ শতাংশ শেয়ার আত্মসাতের অভিযোগও রয়েছে ইউনাইটেড গ্রুপের বিরুদ্ধে। যৌথ মালিকানার আশুগঞ্জ বিদ্যুৎকেন্দ্রের ওই শেয়ার গোপন আঁতাতের মাধ্যমে আত্মসাৎ করে নেয় গ্রুপটি।
আর এসব অপকর্ম ইউনাইটেড গ্রুপ অনায়াসে করতে পেরেছে বিএনপি চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়াকে শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের স্মৃতিবিজড়িত সেনানিবাসের শহীদ মইনুল হক সড়কের বাড়ি ভাঙার পুরস্কার হিসেবে। খালেদা জিয়ার বাড়ি ভাঙার নেপথ্যে বিশেষ ভূমিকা রেখেছিলেন ইউনাইটেড গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মইনুদ্দীন হাসান রশীদের এক নিকটাত্মীয়। যিনি ওই সময় সরকারের গুরুত্বপূর্ণ পদে ছিলেন। তার মাধ্যমেই সরাসরি হাসিনা সরকারের আশীর্বাদ পেতে শুরু করে ইউনাইটেড গ্রুপ। আর সেই আশীর্বাদপুষ্ট হয়েই গত দেড় দশকে ইউনাইটেড গ্রুপ অঢেল সম্পদের পাহাড় গড়েছে।
গত বছরের ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে স্বৈরাচারী আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে ইউনাইটেড গ্রুপের নানা অনিয়মের তথ্য বেরিয়ে আসছে। এরমধ্যেই বহুল আলোচিত ঢাকা ইপিজেডের ইউনাইটেড গ্রুপের বিদ্যুৎকেন্দ্রের গ্যাস সংযোগ বিচ্ছিন্ন করল তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি।
তিতাস গ্যাস সূত্র জানিয়েছে, কোম্পানিটি ২০২২ সালের দিকে একবার বকেয়া কিস্তিতে দেওয়ার বিষয়ে আবেদন করেছিল। আদালত তাদের বকেয়া কিস্তিতে পরিশোধ করার জন্য আদেশ দিয়েছিলেন। কিন্তু তারপরও তারা কোনো বকেয়া পরিশোধ করেনি। ইউনাইটেড গ্রুপের দুটি বিদ্যুৎকেন্দ্রের গ্যাসের দাম নিয়ে নজিরবিহীন পক্ষপাত দেখিয়েছে বিগত আওয়ামী লীগ সরকার। ঢাকা ইপিজেড এলাকায় ৮৬ মেগাওয়াট ও চট্টগ্রাম ইপিজেডে অবস্থিত ৭২ মেগাওয়াটের বিদ্যুৎকেন্দ্র দুটির বিষয়ে সরকারের নগ্ন হস্তক্ষেপের কারণে দিনে দিনে বেপরোয়া হয়ে উঠেছিল ইউনাইটেড গ্রুপ।
ঢাকা ইপিজেডে ইউনাইটেড গ্রুপের বিদ্যুৎকেন্দ্রটি যেহেতু সরকারের কাছে বিদ্যুৎ বিক্রি করে না, তাই ক্যাপটিভ বিবেচনায় গ্যাসের দাম ঘনমিটার প্রতি ৩১.৫০ টাকা নির্ধারণ করে বিইআরসি। একই সময়ে আইপিপি (ইন্ডিপেন্ডেন্ট পাওয়ার প্রডিউসার)-এর জন্য গ্যাসের দর ছিল ১৬ টাকা। আইপিপি রেটে গ্যাস পেতে তদবির শুরু করে ইউনাইটেড গ্রুপ। বিইআরসি সেই দাবি নাকচ করে দেয়। এরপর হাইকোর্টে গেলে সেখানেও নাকচ হলে সুপ্রিম কোর্টে গিয়েও হেরেছে গ্রুপটি। তারপরও সব আইন-কানুন উপেক্ষা করে নির্বাহী আদেশে তাদের সেই চাওয়া পূরণ করে দেয় আওয়ামী লীগ সরকার।
সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, সাবেক প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বিপু আর সাবেক মুখ্যসচিব আহমেদ কায়কাউসকে সিঁড়ি হিসেবে ব্যবহার করে ‘তুঘলকি কাণ্ড’ চালিয়ে গেছে ইউনাইটেড গ্রুপ। সরকারের এই তিন শীর্ষ ব্যক্তির প্রভাব খাটিয়ে জোরপূর্বক ক্যাপটিভ বিদ্যুৎকেন্দ্রকে বানিয়েছে ইন্ডিপেন্ডেন্ট পাওয়ার প্রডিউসার (আইপিপি)। ইপিজেডে বিদ্যুৎ দেওয়ার নামে বিদ্যুৎকেন্দ্র বানিয়ে সেই বিদ্যুতের বড় অংশ চড়া দামে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) কাছে বিক্রি করে সাধারণ গ্রাহকের পকেট কেটেছে।
প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়, বিদ্যুৎ বিভাগ, বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিডা) এবং বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) কতিপয় অসাধু শীর্ষ কর্মকর্তাদের সহায়তায় আইপিপি নাম বাগিয়ে কম দামে গ্যাস কিনেছে ইউনাইটেড গ্রুপ। কম দামে গ্যাস কিনে উৎপাদিত বিদ্যুৎ ক্যাপটিভ রেটে বিক্রি করেছে। এ খাত থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা আয় করেছে গ্রুপটি। এতে কমপক্ষে ৫০০ কোটি টাকা রাজস্ব হারিয়েছে তিতাস গ্যাস কোম্পানি লিমিটেড। পাওনা আদায়ে তিতাস গ্যাসের পক্ষ থেকে একাধিকবার চিঠি দিলেও সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভয় দেখিয়ে তিতাস গ্যাস কর্মকর্তাদের চুপ করিয়ে রাখা হতো। এক পর্যায়ে খোদ সাবেক প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে ক্যাপটিভ বিদ্যুৎকেন্দ্রকে আইপিপি করিয়ে নেয় ইউনাইটেড গ্রুপ।
বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের (বিইআরসি) তৎকালীন সদস্য (গ্যাস) মকবুল ই-এলাহী চৌধুরী গণমাধ্যমকে বলেছেন, আমার কাছে বিষয়টি আশ্চার্যজনক মনে হয়েছে। কীভাবে তারা আইপিপির দর পেল বুঝতে পারি না। তারা বিইআরসিতে এলে আমরা নাকচ করে দেই। পরে রিভিউয়ের আবেদন করে সেখানেও নাকচ হয়ে যায়। আমি যতদূর জানি হাইকোর্টও তাদের নাকচ করে দিয়েছেন। তাদের প্রকল্পের শুরুই হয়েছে ক্যাপটিভ হিসেবে। আইপিপি হওয়ার কোনো সুযোগ দেখি না।
এ বিষয়ে বিইআরসির সাবেক একজন চেয়ারম্যান জানান, আইন অনুযায়ী ইউনাইটেডের বিদ্যুৎকেন্দ্র দুটি ক্যাপটিভ ক্যাটাগরির। আইপিপি হিসেবে তাদের দর নির্ধারণের কোনো সুযোগ নেই। ইউনাইটেড বিইআরসিতে এলে আমরা তাদের আবেদন নাকচ করে দেই। রিভিউয়ের আবেদনও নাকচ হয়ে যায়। আমি যতদূর জানি হাইকোর্টও তাদের আবেদন নাকচ করে দিয়েছেন। ইউনাইটেডের দুটি প্রকল্প শুরু হয়েছে ক্যাপটিভ হিসেবে। আইপিপি হওয়ার কোনো সুযোগ ছিল না। আমরা সেই রায় দিয়েছিলাম। পরে কী হয়েছে আমার জানা নেই।
সম্প্রতি অন্তর্বর্তী সরকার ইউনাইটেড গ্রুপকে শেখ হাসিনার দেওয়া সেই অন্যায্য সুবিধা বাতিল করে দিয়েছে। গত ৭ মার্চ জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগের চিঠিতে বলা হয়েছে, ইউনাইটেড গ্রুপকে ক্যাপটিভ রেটেই গ্যাসের দাম দিতে হবে। এরপরই তৎপর হয়ে ওঠে তিতাস গ্যাস। দফায় দফায় যোগাযোগ করলেও ইউনাইটেড গ্রুপ সাড়া না দেওয়ায় গ্যাস সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া হয়।
এ বিষয়ে ইউনাইটেড গ্রুপের হেড অব রেগুলেটরি অ্যাফেয়ার্স ও প্রাইভেট সেক্রেটারি শামীম মিয়া গণমাধ্যমকে বলেছেন, ইউনাইটেড গ্রুপ সব ধরনের আইন-কানুন মেনে তিতাস গ্যাসের সঙ্গে চুক্তি করেছে। এ সংক্রান্ত সব ধরনের কাগজপত্র আছে। আমাদের কোনো বিল বকেয়া নেই। সরকার ইপিজেডে বিদ্যুৎ দেওয়ার জন্য আমাদের দুটি বিদ্যুৎকেন্দ্র তৈরির অনুমোদন দিয়েছে। বিদ্যুৎকেন্দ্রের বিদ্যুৎ রিজার্ভ করে রাখার সুযোগ নেই। এ কারণে ইপিজেডের অব্যবহৃত বিদ্যুৎ আমাদের বাইরে বিক্রি করতে হচ্ছে।
তিনি বলেন, সরকার আমাদের আইপিপি রেটে গ্যাস কেনার অনুমোদন দিয়েছে। কিন্তু তিতাস গ্যাস আমাদের বিল দিচ্ছে ক্যাপটিভ রেটে। এই সমস্যা নিরসনে পরবর্তী সময়ে সাবেক প্রধানমন্ত্রীর সভাপতিত্বে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়, বিডা, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি বিভাগ এবং তিতাসের সঙ্গে বৈঠক হয়। সেই বৈঠকের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী আমরা তিতাসকে বিল দিয়ে যাচ্ছি। কোনো অনিয়ম হয়নি। তারা যে রেটে বিল দাবি করেছে, সেটা অযৌক্তিক। আমাদের গ্যাস বিল আইপিপি দরেই হওয়া উচিৎ। ইপিজেডে অবস্থিত কারখানায় আমরা বিদ্যুৎ সরবরাহ করি। সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছে, এখন ইপিজেড বুঝুক তারা কী করবে। আমরা এখন কিছুই করতে যাচ্ছি না।
এদিকে বিদ্যুৎ বিভাগের তৎকালীন উপসচিব সাইফুল আজাদ স্বাক্ষরিত একটি চিঠিতে বলা হয়েছে, প্রধানমন্ত্রীর অনুমোদনের প্রেক্ষিতে ২০২৩ সালের ফেব্রুয়ারি মাস থেকে ক্যাপটিভ শ্রেণিতে ৩০ টাকা (ঘনমিটার) হিসাবে গ্যাস ক্রয় করে ঢাকা-চট্টগ্রাম ইপিজেডে স্থাপিত দুটি বিদ্যুৎকেন্দ্র আইপিপি হিসেবে লাইসেন্স দেওয়ার বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে। চিঠিতে বর্ণিত সিদ্ধান্তের আলোকে আইপিপি গ্যাস শ্রেণির জন্য বিদ্যুৎ ট্যারিফ নির্ধারণে বিইআরসিকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার সিদ্ধান্ত জানানো হয়।
ঢাকা ও চট্টগ্রামের দুটি ইপিজেডে ইউনাইটেড গ্রুপের দুই বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে যথাক্রমে ৮৬ ও ৭২ মেগাওয়াট করে বিদ্যুৎ উৎপাদিত হয়। কথা ছিল তারা সরকারি গ্যাস ব্যবহার করে এই দুই কেন্দ্র থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন করে সেই বিদ্যুৎ কম দামে দুটি ইপিজেডে বিক্রি করবে। ইপিজেডে অব্যবহৃত বিদ্যুৎ তারা ক্যাপটিভ রেটে বাইরে বিক্রি করবে। সেক্ষেত্রে বাইরে বিক্রি করা বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য যে গ্যাস ব্যবহার করবে সে গ্যাসের দাম হবে ক্যাপটিভ রেটে।
এখানেই রয়েছে ইউনাইটেড গ্রুপের ছলচাতুরি! ইকোনোমিক জোনগুলোতে তেমন বিদ্যুৎ ব্যবহৃত হতো না। ফলে তারা ইপিজেডে সামান্য বিদ্যুৎ দিয়ে বাকি বিদ্যুৎ বেশি দামে বাইরে বিক্রি করে দিত। এতে কম দামের গ্যাস ব্যবহার করে প্রতি ইউনিট বিদ্যুৎ উৎপাদনে তাদের খরচ হয় মাত্র ৪ টাকা ১৭ পয়সা। অথচ এই বিদ্যুৎ তারা বাইরে বিক্রি করেছে প্রতি ইউনিট ১০ টাকা ৮৮ পয়সা। আয় হচ্ছে দ্বিগুণের বেশি। বিদ্যুৎ বিভাগ ও জ্বালানি বিভাগ বিষয়টি টের পাওয়ার পর তাদের বিদ্যুৎকেন্দ্রে গ্যাসের বিল ক্যাপটিভ রেটে করার নির্দেশ দিলেও সে নির্দেশনা তারা মানেনি ইউনাইটেড গ্রুপ। এমনকি ক্ষমতার প্রভাব খাটিয়ে তিতাস গ্যাসের ৫০০ কোটি টাকার বিলও আটকে রেখেছে।
পতিত সরকারের সাবেক বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বিপুকে মোটা অঙ্কের টাকা ও জমি ঘুষ দিয়ে ক্যাপটিভ বিদ্যুৎকেন্দ্রকে আইপিপিতে রূপান্তর করে ইউনাইটেড গ্রুপ। কারণ গ্যাসভিত্তিক আইপিপি বিদ্যুৎকেন্দ্রে গ্যাসের দাম ক্যাপটিভের অর্ধেকের চেয়েও কম। শুধু এমন চাতুরিই নয়, রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান আশুগঞ্জ পাওয়ার স্টেশন কোম্পানির (এপিএসসিএল) ২০ শতাংশ শেয়ারও আত্মসাৎ করেছে ইউনাইটেড গ্রুপ। যৌথ মালিকানার আশুগঞ্জ ১৯৫ মেগাওয়াট বিদ্যুৎকেন্দ্রটির শেয়ারগুলো গোপন আঁতাতের মাধ্যমে আত্মসাৎ করেছে গ্রুপটি।
চুক্তির শর্ত অনুযায়ী, বিদ্যুৎকেন্দ্রটিতে ইউনাইটেড গ্রুপের ৭১ শতাংশ আর ২৯ শতাংশ শেয়ার সরকারি প্রতিষ্ঠান আশুগঞ্জ পাওয়ার স্টেশন কোম্পানির হাতে থাকার কথা। কিন্তু রহস্যজনকভাবে দেখা গেছে বিদ্যুৎকেন্দ্রটিতে সরকারের শেয়ার মাত্র ৯ শতাংশ আর ইউনাইটেড গ্রুপের শেয়ার ৯১ শতাংশ। অথচ বিদ্যুৎকেন্দ্রটি নির্মাণে পুরো জমি দিয়েছে আশুগঞ্জ পাওয়ার স্টেশন কোম্পানি। খুলনায় অবস্থিত দুটি বিদ্যুৎকেন্দ্র বিক্রি করে দিয়েছে ইউনাইটেড গ্রুপ।
এ ছাড়াও খুলনা পাওয়ার কোম্পানি লিমিটেড (কেপিসিএল)-২ (১১৫ মেগাওয়াট) বিদ্যুৎকেন্দ্র ২০১০ সালে প্রথম ৫ বছরের জন্য চুক্তিবদ্ধ হয়। প্রথম ৫ বছরেই তাদের বিনিয়োগ তুলে নিলেও ২০১৬ সালে আবারও ক্যাপাসিটি পেমেন্টের নামে কয়েক হাজার কোটি টাকা হাওয়া করে দেয় ইউনাইটেড।
কেপিসিএলের মাধ্যমে বিদ্যুৎ খাতে যাত্রা শুরু হয় ইউনাইটেড গ্রুপের। সামিট গ্রুপের সঙ্গে যৌথভাবে এ যাত্রা শুরু হয় তাদের। পরে এককভাবে একের পর এক বিদ্যুৎকেন্দ্র গড়ে তোলে গ্রুপটি। বেসরকারি খাতে দ্বিতীয় বৃহৎ বিদ্যুৎ উৎপাদনকারী ইউনাইটেড গ্রুপ। বর্তমানে ইউনাইটেড গ্রুপের ৬টি নিজস্ব বিদ্যুৎকেন্দ্র রয়েছে। এ ছাড়া কেপিসিএলের ৩৫ শতাংশ, পায়রায় একটি কেন্দ্রের ৮২ দশমিক ৫০ শতাংশ ও আশুগঞ্জের একটি কেন্দ্রের ৯৩ শতাংশ শেয়ার রয়েছে ইউনাইটেডের। যদিও অভিযোগ আছে, এই ৯৩ শতাংশ শেয়ার হাতিয়ে নেওয়ার ক্ষেত্রে বড় ধরনের লেনদেন হয়েছে একটি সরকারি কোম্পানির সঙ্গে। সব মিলিয়ে বর্তমানে ইউনাইটেড গ্রুপের বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা ১ হাজার ৫ মেগাওয়াট।
বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, ১৩ বছরে গ্রুপটি নিজস্ব কেন্দ্রগুলোর জন্য প্রায় ৬ হাজার ৬০৪ কোটি ৭৪ লাখ টাকা ক্যাপাসিটি চার্জ হাতিয়ে নিয়েছে। আর কেপিসিএলের ৩৫ শতাংশ ক্যাপাসিটি চার্জ বাবদ ১২ বছরে নিয়েছে প্রায় এক হাজার ২৭৫ কোটি ১৪ লাখ টাকা। সব মিলিয়ে প্রায় ৭ হাজার ৮৮০ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে ইউনাইটেড গ্রুপ।
এ বিষয়ে কনজ্যুমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) জ্বালানি বিষয়ক উপদেষ্টা ড. শামসুল আলম জানান, ইউনাইটেড গ্রুপকে দেওয়া লাইসেন্স রাষ্ট্রের মৌলিক কাঠামোর পরিপন্থি। রাষ্ট্রের সংবিধান, আইন ও নীতির সঙ্গে সাংঘর্ষিক। বেসরকারি কোনো কোম্পানিকে ডিস্ট্রিবিউশন লাইসেন্স দেওয়ার এখতিয়ার নেই। কিন্তু ইউনাইটেড গ্রুপ ডিস্ট্রিবিউশন করছে। সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কি আইনের ঊর্ধ্বে ছিলেন? তিনি নির্দেশ দিলেই অনুমোদন দেওয়া যাবে না। এটা দেওয়ার এখতিয়ার প্রধানমন্ত্রীর নেই। ক্যাপটিভ শ্রেণির গ্রাহককে আইপিপির রেটে গ্যাস দেওয়ার কোনো সুযোগ নেই।
বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী হিসেবে নসরুল হামিদ বিপু দায়িত্ব নেওয়ার পর একের পর এক বিদ্যুৎকেন্দ্রের লাইসেন্স পেতে থাকে ইউনাইটেড গ্রুপ। ২০১৬-২০১৭ অর্থবছরে গ্রুপটির বিদ্যুৎ খাতে উৎপাদন সক্ষমতা ছিল ২৯৩ মেগাওয়াট। ওই অর্থবছরে গ্রুপটি ক্যাপাসিটি চার্জ পেয়েছে ৪৩৬ কোটি ৩২ লাখ টাকা। ২০১৭-২০১৮ অর্থবছরের শেষ দিকে ২০০ মেগাওয়াটের ফার্নেস অয়েল চালিত আরেকটি কেন্দ্র উৎপাদন শুরু করে। এতে চার কেন্দ্রের উৎপাদন সক্ষমতা দাঁড়ায় ৪৯৩ মেগাওয়াট। আর সে অর্থবছরে তাদের ক্যাপাসিটি চার্জ দেওয়া হয় ৪৪২ কোটি ৫৬ লাখ টাকা। ২০১৮-২০১৯ অর্থবছরে জামালপুরে ফার্নেস অয়েল চালিত ১১৫ মেগাওয়াটের আরেকটি বিদ্যুৎকেন্দ্রে উৎপাদন শুরু করে ইউনাইটেড। এতে গ্রুপটির উৎপাদন সক্ষমতা বেড়ে দাঁড়ায় ৬০৮ মেগাওয়াট। সে অর্থবছর পিডিবিকে ক্যাপাসিটি চার্জ গুনতে হয় ৭৬৫ কোটি ২৬ লাখ টাকা। ২০১৯-২০২০ অর্থবছরে চট্টগ্রামের আনোয়ারায় ৩০০ মেগাওয়াটের ফার্নেস অয়েল চালিত আরেকটি কেন্দ্রে উৎপাদন শুরু করে গ্রুপটি। এতে ইউনাইটেডের উৎপাদন সক্ষমতা বেড়ে দাঁড়ায় ৮৫৫ মেগাওয়াট। আর এ কেন্দ্রগুলোর জন্য পিডিবিকে ক্যাপাসিটি চার্জ গুনতে হয় এক হাজার ২৩৬ কোটি ১৮ লাখ টাকা। ২০২০-২০২১ অর্থবছরের বাজারে আসে ১৫০ মেগাওয়াটের ইউনাইটেড পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্র। এতে গ্রুপটির উৎপাদন সক্ষমতা বেড়ে দাঁড়ায় এক হাজার পাঁচ মেগাওয়াট। এগুলোর ক্যাপাসিটি চার্জ ছিল এক হাজার ৩৩৫ কোটি ৪৫ টাকা। গত অর্থবছরে এসব বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য পিডিবিকে ক্যাপাসিটি চার্জ গুনতে হয়েছে এক হাজার ৩৬৬ কোটি ৮০ লাখ টাকা।
এসব কেন্দ্রের বাইরেও কেপিসিএলের ৩৫ শতাংশ শেয়ার রয়েছে ইউনাইটেড গ্রুপ ও এর কয়েকজন পরিচালকের হাতে। ২০১০ সালের এপ্রিলে কেপিসিএল পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হয়। ওই কোম্পানির অধীনে এক সময় তিনটি বিদ্যুৎকেন্দ্র ছিল। এসব কেন্দ্রের জন্য ১২ বছরে ইউনাইটেড ক্যাপাসিটি চার্জ পেয়েছে প্রায় এক হাজার ২৭৫ কোটি ১৪ লাখ টাকা।
জিসিজি/এমজেএফ