ঢাকা, মঙ্গলবার, ২৯ বৈশাখ ১৪৩২, ১৩ মে ২০২৫, ১৫ জিলকদ ১৪৪৬

জাতীয়

জুলাইযোদ্ধা সন্তানকে নিয়ে এক মায়ের জীবনযুদ্ধ

জান্নাতুল ফেরদাউস | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৫:১২, মে ১১, ২০২৫
জুলাইযোদ্ধা সন্তানকে নিয়ে এক মায়ের জীবনযুদ্ধ হনুফা বিবি কাজ থেকে দুই ঘণ্টা ছুটি নিয়ে ছেলেকে দেখতে হাসপাতালে ছুটে যান। তানজিলও বসে থাকেন মায়ের অপেক্ষায়। ছবি: জান্নাতুল ফেরদাউস

সাত বছর আগে ভোলায় ভিটেমাটি হারিয়ে সন্তানদের নিয়ে ঢাকায় পা রেখেছিলেন হনুফা বিবি। বুকভরা স্বপ্ন— সন্তানদের মুখে দুবেলা ভাত তুলে দেবেন, লেখাপড়া শেখাবেন, মানুষ করবেন।

কিন্তু তিন মাস না যেতেই স্বামীর মৃত্যু যেন সেই স্বপ্ন কেড়ে নেয়। চার মেয়ে, এক ছেলে আর একলা এক মা— ফেরার পথও ছিল না। কারণ নদী যে গিলে নিয়েছে শেকড়, বাড়িঘর।

জীবনের কঠিন বাস্তবতায় টিকে থাকার জন্য হনুফা বিবি গৃহকর্মীর কাজ শুরু করেন। সেই আয়-রোজগার জমিয়ে ধীরে ধীরে বিয়ে দেন দুই মেয়ের। এক ছেলে ও দুই মেয়েকে নিয়ে থাকতে শুরু করেন যাত্রাবাড়ীর মাতুয়াইলে এক রুমের ভাড়া বাসায়। স্বপ্ন দেখছিলেন— ছেলে তানজিল (২২) বড় হয়ে মায়ের দুঃখ লাঘব করবে। তানজিলও ছিলেন সেই পথেই। কখনো রেস্টুরেন্টে, কখনো লিফট মেকানিকের কাজ করে মায়ের হাতে মাসে হাজার দশেক টাকা তুলে দিতেন। সেই টাকায় চলত বাড়িভাড়া, চারজনের খাওয়া-দাওয়া, জামাকাপড়, আর দুই মেয়ের (চতুর্থ ও পঞ্চম শ্রেণি) পড়ালেখার খরচ।

তানজিলের দুই পায়ে গুলি লাগে, এর মধ্যে একটি গুলি ডান পায়ের মাংস ছিদ্র করে বেরিয়ে গেছে।  ছবি: বাংলানিউজ১৯ জুলাই ২০২৪— দেশ উত্তাল, স্বৈরাচারীর লেলিয়া দেওয়া বাহিনী ও সশস্ত্র ক্যাডারদের গুলিতে চারদিকে লাশের মিছিল। দেশের এই ক্রান্তিকালে ঘরে বসে থাকতে পারেননি তানজিল। হাজারো আন্দোলনকারীর সঙ্গে তিনি নেমে আসেন রাস্তায়। পুলিশ আন্দোলনকারীদের দমন করতে গুলি চালায় পাখি মত। রায়েরবাগে কদমতলী থানার সামনে তানজিলের দুই পায়ে গুলি লাগে। ডান পায়ের গুলি বেরিয়ে গেলেও বাম পায়ের গুলি আটকে যায় পকেটে থাকা 
স্মার্টফোনে।

তখনো কেউ জানে না কী হতে চলেছে। হাসপাতালগুলোতে আন্দোলনকারীদের জন্য নেই চিকিৎসা— আছে ফের হামলা-মারধরের ভয়, গ্রেপ্তার বা তুলে নিয়ে যাওয়ার আশঙ্কা। হনুফা বিবি ছেলেকে নিয়ে দৌঁড়ান ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল থেকে পঙ্গু হাসপাতাল পর্যন্ত। মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়ে। একমাত্র ছেলেকে ছটফট করতে দেখে তিনি দিশেহারা হয়ে পড়েন।

তানজিলের দুই পায়ে গুলি লাগে, এর মধ্যে একটি গুলি ডান পায়ের মাংস ছিদ্র করে বেরিয়ে গেছে, আরেকটি আটকে যায় প্যান্টের পকেটে থাকা স্মার্টফোনে।  ছবি: বাংলানিউজআত্মীয়-স্বজন থেকে এক লাখ ১০ হাজার টাকা ধার করে ২২ জুলাই শ্যামলীর হাইকেয়ার অর্থোপেডিক্স অ্যান্ড জেনারেল হাসপাতালে ছেলের অস্ত্রোপচার করেন। ঋণের বোঝা মাথায় নিয়ে শেষমেশ ছেলের দুই পা রক্ষা করতে সক্ষম হন।

২৪ জুলাই ছেলেকে নিয়ে বাড়ি ফেরেন। প্রতিদিন ইনজেকশন, ওষুধ, খাবার, ঘরভাড়া— এই বিশাল খরচ সামাল দেওয়া অসম্ভব হয়ে পড়ে। বাধ্য হয়ে আগস্ট মাসে সুদের ওপর আরও ৭০ হাজার টাকা ধার নেন।

ছেলের চিকিৎসা আর সংসার চালাতে হনুফা বিবি তিনটি বাসার কাজ করছেন, খুঁজছেন আরও।  ছবি: বাংলানিউজসুদের বোঝা বাড়তে থাকে। তানজিল কখনো সুস্থ থাকেন, তো কখনো অসুস্থ হয়ে পড়েন। হনুফা বিবি কাজেও ফিরতে পারেন না। ছেলেকে আগলে দিনরাত বসে থাকেন। দুশ্চিন্তার পাহাড়ের চাপে যেন নুইয়ে পড়েন।

পরিস্থিতি আরও খারাপ হয় তানজিলের পায়ে সংক্রমণ ঘটলে। হনুফা বিবি আবার ছেলেকে নিয়ে এক হাসপাতাল থেকে আরেক হাসপাতালে ছুটতে থাকেন। ডিসেম্বরে ডা. তাসনিম জারার সহায়তায় তানজিল ভর্তি হন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। হয় আরেকবার অস্ত্রোপচার। এসময় টানা চার মাস থাকতে হয় হাসপাতালে।

জুলাইযোদ্ধা তানজিল একা হাঁটতে পারেন না, রাতে পায়ের ব্যথায় কাতরান।  ছবি: বাংলানিউজদীর্ঘদিন অনুপস্থিতির কারণে হনুফা বিবি বাসাবাড়ির সব কাজ হারান। এ সময় সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় থেকে ৫০ হাজার টাকা সহায়তা এবং কিছুদিন পর জুলাই শহীদ স্মৃতি ফাউন্ডেশন থেকে এক লাখ টাকা পান। এই টাকায় কিছু ঋণ শোধ করেন, কিছু টাকা খরচ হয় বাড়িভাড়া ও সংসারে।

চার মাস পর বাড়ি ফিরে এলেও তানজিল পুরোপুরি সুস্থ হননি। মে মাসে আবার হাসপাতালে ভর্তি হতে হয় ব্যথা নিয়ে। একা হাঁটতে পারেন না, রাতে পায়ের ব্যথায় কাতরান। ডাক্তাররা বলছেন, আরও একটি অস্ত্রোপচার করতে হতে পারে।

এবার মায়ের পক্ষে আর হাসপাতালে বসে থাকা সম্ভব হয় না। কারণ ঘরে নেই চাল, ঘরভাড়া বাকি, ঋণ ও সুদের বোঝা কাঁধে। হনুফা বিবি আবার খুঁজে নিয়েছেন তিনটি বাসার কাজ, খুঁজছেন আরও। ভোর থেকে শুরু করে, দুপুরে এক-দুঘণ্টা বিরতির পর রাত ৮টা পর্যন্ত কাজ করতে হয়। সপ্তাহে একদিন, বৃহস্পতিবার, কাজ থেকে দুই ঘণ্টা ছুটি নিয়ে হাসপাতালে ছুটে যান ছেলেকে দেখতে। তানজিলও বসে থাকেন মায়ের অপেক্ষায়।

হাসপাতালের বিছানায় ভবিষ্যতের দুশ্চিন্তায় সময় কাটে তানজিলের।  ছবি: বাংলানিউজহাসপাতালে ঢুকেই হনুফা বিবি বলেন, “এক বৃহস্পতিবার থেকে আরেক বৃহস্পতিবার, আমার কাছে এক বছর লাগে গো। আমি আমার সন্তানকে দেখিনি কতদিন। শান্তি পাই না। ”

মাসে আয় সাত হাজার টাকা, যার চার হাজারই চলে যায় ঘর ভাড়ায়। বাকি তিন হাজার টাকা এবং আত্মীয়-স্বজনদের সহযোগিতায় কোনোরকমে দিন চালাচ্ছেন তিনি। তবু পরের বেলা সন্তানদের কী খেতে দেবেন এই অনিশ্চয়তায় তাদের মুখের দিকে তাকাতে পারেন না তিনি।

ঢাকা শহরে আজকের দিনে চারজন মানুষের খাবার-দাবারের সর্বনিম্ন খরচও হাজার দশেক টাকা। সংসারের অন্যান্য খরচ তো আছেই। এসব বুঝেই কাজ খুঁজছেন আরও কয়েক বাড়ি।

হনুফা বিবি কাজ থেকে দুই ঘণ্টা ছুটি নিয়ে ছেলে তানজিলকে দেখতে হাসপাতালে ছুটে যান।  ছবি: বাংলানিউজহাসপাতালের বিছানায় বসে তানজিল বলছিলেন, ‘মা বলেই হয়তো এতকিছু ম্যানেজ করতে পেরেছে। কী যে খারাপ দিন গেছে অপারেশনের সময়। মাঝে মাঝে মনে হয় ওইদিন মরে গেলেই ভালো হতো। মায়ের এত কষ্ট হতো না। ছোটবেলায় বাবা-মাকে হারিয়েছি, তারপর স্বামীকে, এখন আমার এই অবস্থা। ওনার কি সারাজীবন অন্যের বাড়ি বাড়ি কাজ করেই যাবে?’

মাতুয়াইলে এক কামরার ঘরে সারাদিনের খাটুনির পরও ঘুম আসে না হনুফা বিবির। ছেলের ভবিষ্যতের অনিশ্চয়তায় তিনি ছটফট করেন। তবুও মুখে এক চিলতে হাসি, আর বলেন—‘তবুও তো আমার ছেলে বেঁচে আছে, ওইদিন যদি আমার ছেলেটা মরেই যেত, আমি কী নিয়ে বাঁচতাম?’

এইচএ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।