ঢাকা, শুক্রবার, ১৫ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২, ৩০ মে ২০২৫, ০২ জিলহজ ১৪৪৬

জাতীয়

পলাতক আ.লীগের নেতাদের জমি বেচে টাকা পাচারের হিড়িক

নিউজ ডেস্ক | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৯:০৪, মে ২৮, ২০২৫
পলাতক আ.লীগের নেতাদের জমি বেচে টাকা পাচারের হিড়িক

আওয়ামী লীগ শাসনামলে ক্ষমতা আর পেশিশক্তির বলে মন্ত্রী, এমপি, আমলা, নেতা, পাতিনেতা, এলাকার বড় ভাই হিসেবে পরিচিত যে যেভাবে পেরেছেন জমি কিনেছেন, দখলে নিয়েছেন। তাঁরা কখনো নামমাত্র টাকায়, কখনো বা জোর করে লিখিয়ে নিয়েছেন অসহায় মানুষের জমি।

ক্ষমতা হারানোর পর এসব নেতার বেশির ভাগই এখন পলাতক। কেউ দেশে আত্মগোপনে, কেউ বা আরব আমিরাত, কানাডা, আমেরিকা, ইংল্যান্ড, ভারতসহ বিভিন্ন দেশে।

এই পলাতক নেতাদের অনেকেই এখন নিজেদের নামে-বেনামে কেনা জমিজমা যে যেভাবে পারছেন বিক্রি করে দিচ্ছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। দেশের একটি গণমাধ্যমের অনুসন্ধানে জানা যায়, রাজধানী ঢাকার রাজউক-পূর্বাচল নতুন শহর, রূপগঞ্জ, গাজীপুর, সাভারসহ বিভিন্ন স্থানেই জমি বিক্রির এমন অভিযোগ রয়েছে। এদিকে সাবেক ডিবিপ্রধান মনিরুলের গাজীপুরে ৯ বিঘা জমি বিক্রি করা হয়েছে বলে জানা গেছে।

হাবিবুর রহমান হারেজ ছিলেন রূপগঞ্জ উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান।

পাশাপাশি রূপগঞ্জ থানা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক ছিলেন তিনি। আওয়ামী লীগের প্রভাবে তিনি প্লটের ব্যবসা করতেন। তাঁর নামে-বেনামে ২০টির মতো প্লট রয়েছে। গত বছরের ৫ আগস্ট বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের পর অনেকের মতো হাবিবুর রহমান হারেজও এলাকা ছেড়ে পালিয়ে যান।

চলতি বছরের ২ মার্চ তাঁর পাঁচ কাঠার প্লটটি বিক্রি করে দেন। প্লট বিক্রির টাকা তিনি দেশের বাইরে পাচার করে দিয়েছেন বলে স্থানীয় লোকজন ধারণা করছে। স্থানীয় লোকজন জানায়, সাধারণ মানুষের এসব প্লট গত আওয়ামী লীগের শাসনামলে মন্ত্রী, এমপি, আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী ও সচিবরা হাতিয়ে নিয়েছেন। পানির দামে কেনা এসব প্লট এখন চড়া দামে বিক্রি করে দেশের বাইরে টাকা পাচার করে দিচ্ছেন। শুধু হাবিবুর রহমান হারেজ নন, তাঁর মতো গোলাম দস্তগীর গাজীর পছন্দের নারী নেত্রী, আওয়ামী লীগ নেতা মারফত আলী এবং রূপগঞ্জ ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান সালাউদ্দিন ভূঁইয়া, কালীগঞ্জের সাবেক চেয়ারম্যান অলিউর রহমান, যুবলীগ নেতা শাহীন মালুমসহ অনেকের প্লট বিক্রির সন্ধান পেয়েছে দেশের একটি গণমাধ্যম।

পাশাপাশি রূপগঞ্জ উপজেলার অনেক আওয়ামী লীগ নেতা গত আট মাসে জমিজমা বিক্রি করে দিয়েছেন।
কালের কণ্ঠের অনুসন্ধানে জানা গেছে, ব্রাহ্মণখালী এলাকার হাবিবুর রহমান হারেজের পূর্বাচলে নামে-বেনামে ২০টির মতো প্লট রয়েছে। হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকদের (নাম প্রকাশ করতে রাজি নয়) ভয়ভীতি ও হুমকি দিয়ে নামমাত্র দামে ২৫টি প্লট হাতিয়ে নেন হাবিবুর রহমান হারেজ। তিনি গত ২ মার্চ আদিবাসী কোটায় হারারবাড়ি মৌজার ১০ নম্বর সেক্টরের ৪০৪ নম্বর সড়কের ১৩ নম্বরের পাঁচ কাঠার প্লটটি বিক্রি করেন (যার দলিল নম্বর ২৮২২)। রূপগঞ্জের পিতলগঞ্জের মধুখালী এলাকার ইকবাল হোসেনের মেয়ে তানিয়া সুলতানা প্লটটি ক্রয় করেন। সাবরেজিস্ট্রি অফিস সূত্রে জানা গেছে, এ প্লটের রেজিস্ট্রি কমিশনে ঢাকায় হয়েছে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, হারেজ চেয়ারম্যান ৫ আগস্টের পর এলাকা ছেড়ে চলে গেছেন। এরপর তিনি কোথায় আছেন তা কেউ জানে না। তবে জানা গেছে, তাঁর অনেক প্লট ও জমিজমা তিনি বিক্রি করে দিচ্ছেন। নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন স্থানীয় বাসিন্দা বলেন, এসব টাকা তিনি দেশের বাইরে পাচার করে দিচ্ছেন। তাঁর ঘনিষ্ঠ একটি সূত্র জানিয়েছে, তিনি বাকি প্লটগুলোও বিক্রির চেষ্টা করছেন।

রূপগঞ্জ পশ্চিম সাবরেজিস্ট্রি অফিস সূত্রে জানা গেছে, গত বছরের ৫ আগস্টের গণ-অভ্যুত্থানের পর রূপগঞ্জ সাবরেজিস্ট্রি অফিসে পূর্বাচল উপশহরের ২৬৯টি প্লট রেজিস্ট্রি হয়েছে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে সাবরেজিস্ট্রি অফিসের এক কর্মকর্তা বলেন, গোপনীয়তার কারণে এসব রেজিস্ট্রির বেশির ভাগই কমিশনে রেজিস্ট্রি হয়েছে। এখানে অনেক প্রভাবশালী ব্যক্তির প্লট রয়েছে, যা তাঁদের নামে নেই, কিন্তু স্বজনদের নামে রয়েছে। গণ-অভ্যুত্থানের পর গত বছরের ১১ আগস্ট থেকে শুরু করে চলতি বছরের ১৫ মে পর্যন্ত এসব প্লট বিক্রি হয়। সাবরেজিস্ট্রি অফিসের ওই কর্মকর্তা বলেন, গত ৯ মাসে যে হারে পূর্বাচলের প্লট বিক্রি হয়েছে গত দুই বছরেও এত বিক্রি হয়নি। এসব প্লটের বেশির ভাগই কমিশনে রেজিস্ট্রি হয়েছে বলে তিনি জানান।  

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, দাউদপুর ইউনিয়নের শিমুলিয়া গ্রামের আবদুল হক মালুমের ছেলে শাহীন মালুম। তিনি যুবলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য ছিলেন। আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার কয়েক বছরের মধ্যে উপশহরের প্লট বাণিজ্য করে কপাল খুলেছে তাঁর। শিমুলিয়া ও কুলিয়াদি মৌজায় নিজের নামেই গড়ে তুলেছিলেন আবাসন প্রতিষ্ঠান ‘শাহীন মালুম সিটি’। শাহীন মালুম এবং তাঁর স্ত্রী বিপাশা হোসেন বৃষ্টির নামে পূর্বাচলে অন্তত ১০টি প্লট থাকার কথা জানিয়েছে স্থানীয় বাসিন্দারা। তারা আরো জানায়, চলতি বছরের জানুয়ারি মাসে শিমুলিয়া মৌজায় ৪০ শতাংশ জায়গা বিক্রি করে দিয়েছেন তিনি। আরো জায়গা বিক্রি করার চেষ্টায় আছেন।

দাউদপুর ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সমাজকল্যাণ সম্পাদক মারফত আলী। গোবিন্দপুর, কালনি, চাপরি ও গুচ্ছগ্রামের অনেকের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, মারফত আলী খাইসা, চাপরি কামতা, ধামচি, মাঝিপাড়া এলাকার হিন্দুদের ভয়ভীতি দেখিয়ে প্লট হাতিয়ে নিয়েছেন। কৃষ্ণচাঁদ নামের একজনকে ভয় দেখিয়ে তিনি ২০ হাজার টাকায় তিন কাঠার প্লট নিয়েছিলেন ১৭ নম্বর সেক্টরে। এটির বর্তমান বাজারদর দুই কোটি টাকা। পূর্বাচলের ১৭ নম্বর সেক্টর ছাড়াও ২০ ও ২৩ নম্বর সেক্টরে রয়েছে তাঁর কয়েকটি প্লট (সব বেনামে)। স্থানীয় ফজলুর রহমান ফজলু মাস্টার নামের একজন বলেন, মারফত আলী ৫ আগস্টের পরেই পালিয়ে গেছেন। কালনি মৌজায় ১৫ শতাংশ জমি বিক্রি করেছেন তিনি। এ ছাড়া পূর্বাচলের ১৭ নম্বর সেক্টরের একটি প্লট বিক্রি করেছেন তিনি। এটা তাঁর এক আত্মীয়ের নামে ছিল।

গত এক সপ্তাহ পূর্বাচল উপশহরের বিভিন্ন এলাকা ঘুরে কথা হয়েছে আদিবাসী, বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ এবং যাঁরা প্লট বেচাকেনা করেন তাঁদের সঙ্গে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্লট বিক্রির মধ্যস্থতাকারী এক ব্যক্তি বলেন, পূর্বাচল উপশহরের কুটনৈতিক জোনের ২৭ নম্বর সেক্টরের ২০৩ নম্বর রোডে তারেক সিদ্দিকী এবং তাঁর স্ত্রী শাহনাজ সিদ্দিকীর নামে ১০ কাঠার দুটি প্লট রয়েছে। একটি প্লট বিক্রি করার জন্য স্থানীয়ভাবে যাঁরা মধ্যস্থতা করেন তাঁদের বলা হয়েছে। দরদাম চলছে। তবে এখনো বিক্রি হয়নি। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকাকালে তৎকালীন স্থানীয় সরকার বিভাগের সচিব হেলাল উদ্দিনকে সাড়ে সাত কাঠার একটি প্লট দেওয়া হয়। এ প্লটটি বিক্রি করার জন্য স্থানীয় প্লট বিক্রির মধ্যস্থতাকারীদের হেলাল উদ্দিন দায়িত্ব দিয়েছেন। পূর্বাচলে প্লট মালিক এমন আরেক সরকারি কর্মকর্তার তথ্য পাওয়া গেছে (নাম-ঠিকানা দিতে রাজি নন মধ্যস্থতাকারী)। ওই কর্মকর্তা তিন কাঠার একটি প্লট পেয়েছেন ১১ নম্বর সেক্টরে। কাঠাপ্রতি জমির মূল্য পরিশোধ করেছিলেন দেড় লাখ টাকা করে। বর্তমানে তাঁর সেই প্লটের দাম দাঁড়িয়েছে তিন কোটি ৪০ লাখ টাকায়। পূর্বাচলের প্লটটি বিক্রির জন্য সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তিনি। এরই মধ্যে মধ্যস্থতাকারীও ঠিক করেছেন তিনি। নাম প্রকাশ না করার শর্তে ওই মধ্যস্থতাকারী এই তথ্য নিশ্চিত করেছেন।  

অনুসন্ধানে জানা গেছে, পূর্বাচলের প্লট ব্যবসাকে ঘিরে ছোট-বড় কয়েক শ মধ্যস্থতাকারী (দালাল) রয়েছে। গণমাধ্যমটির এ প্রতিবেদক অন্তত ৩০ থেকে ৩৫ জনের সঙ্গে কথা বলেছেন। এ রকম শরিফ মিয়াসহ কয়েকজন বলেছেন, পূর্বাচলের প্লটগুলো সাধারণত রেজিস্ট্রি হয় কমিশনে, যার কারণে সঠিক তথ্য পাওয়া মুশকিল। আর সরকারি কর্মকর্তা কিংবা প্রভাবশালী ব্যক্তিদের নিজের নামে কোনো প্লট নেই। তাঁরা স্বজন কিংবা বেনামে এসব প্লট নিয়েছেন। তবে বর্তমানে প্লট বিক্রির পরিমাণ আগের চেয়ে অনেক বেড়েছে। এর কারণ প্লটের দাম বেড়েছে। আর আওয়ামী লীগের যাঁরা প্লট পেয়েছেন তাঁরা গোপনে বিক্রি করে দিচ্ছেন।

স্থানীয় আদিবাসীরা অভিযোগ করে, পূর্বাচলের প্লট পাওয়ার কথা ছিল আদিবাসী ও সাধারণ মানুষের। অথচ যাঁদের প্লট পাওয়ার কথা নয়, তাঁরাই পেয়েছেন। রূপগঞ্জের সাবেক সংসদ সদস্য গোলাম দস্তগীর গাজীর পছন্দের অনেক নেত্রী এবং আওয়ামী লীগের স্থানীয় নেতাকর্মীরাও প্লট পেয়েছেন। রাজউকের উচিত ছিল প্লট বিক্রি না করে ফ্ল্যাট বানিয়ে বিক্রি করা। তাহলে এতটা হরিলুট হতো না।

গণমাধ্যমটির অনুসন্ধানে জানা গেছে, রাজউক পূর্বাচল প্রকল্পে ক্ষতিগ্রস্ত ভূমি মালিক না হয়েও ৬৩টি প্লট বাগিয়ে নিয়েছিলেন কালীগঞ্জের নাগরী ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান মোহাম্মদ অলিউল ইসলাম অলি। তিনি নাগরী ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক। তিনি স্ত্রী, ভাই-বোন, শ্বশুর-শাশুড়ি, ভাইয়ের স্ত্রী, শ্যালিকাসহ আত্মীয়-স্বজনের নামে ১২৬ কোটি টাকার প্লট বেশুমার জাল-জালিয়াতির মাধ্যমে বাগিয়ে নিয়েছিলেন। স্থানীয় ক্ষতিগ্রস্ত আদিবাসীদের এসব অভিযোগ আমলে নিয়ে ২০২১ সালের অক্টোবরে অনুসন্ধান কমিটি গঠন করে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। স্থানীয় লোকজন জানায়, মোহাম্মদ অলিউল ইসলাম অলি বাংলাদেশ ও আমেরিকার দ্বৈত নাগরিক। গত বছরের ৫ আগস্টের পর থেকে তিনি পলাতক। স্থানীয় লোকজন ধারণা করছে, তিনি এখন আমেরিকায় আছেন।

নাগরী ইউনিয়নে গিয়ে অনুসন্ধানে জানা গেছে, ওই সময় প্লট পেয়েছিলেন অলির স্ত্রী আরণি (আবেদন সিরিয়াল নম্বর ৭১৬, কোড ২০২৪৫১)। অলি চেয়ারম্যানের ভাই আলিউল ইসলাম (আবেদন সিরিয়াল নম্বর ৪৪৩, কোড ২০১৯২২), আরেক ভাই পুলিশ কর্মকর্তা রহমত উল্লা মিয়া (আবেদন সিরিয়াল নম্বর ৪৬৬, কোড ২০১৯৪৯), বোন মিনারা আক্তার (আবেদন সিরিয়াল নম্বর ৪৬৯, কোড ২০১৯৫৩), নার্গিস (আবেদন সিরিয়াল নম্বর ৪৪৪, কোড ২০১৯২৩), ছোট ভাইয়ের স্ত্রী সানজিদা আক্তার শাম্মীসহ (আবেদন সিরিয়াল নম্বর ৪৬৮, কোড ২০১৯৫১) চাচাতো ভাই, শ্বশুর-শাশুড়ি, শ্যালিকা, ফুফুশাশুড়ি, খালা, মামি, মামাতো বোনের নামে ৩১টি প্লট বাগিয়েছেন অলি। এঁরা কেউই পূর্বাচল প্রকল্প এলাকার স্থায়ী বাসিন্দা নন। এ ছাড়া অলির বন্ধু আওয়ামী লীগ নেতা হাবিবুর রহমানের পরিবারের ১১ সদস্যের নামে প্লট বাগিয়ে নিয়েছেন অলি।

কাগজপত্র দেখিয়ে প্রকল্প এলাকার আদি নিবাসী মজিবুর রহমান বলেন, ১৩২৯ দাগে ক্ষতিগ্রস্ত হিসেবে তাঁর সরকারি ক্ষতিপূরণের টাকা পাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু অলি তাঁর স্ত্রী আরণি, বোন নার্গিস ও বন্ধুর ছোট ভাই জিল্লুর রহমান, মতিউর রহমান ও বেলায়েত হোসেনের নামে ক্ষতিপূরণের টাকা তুলে আত্মসাৎ করেন। জাল-জালিয়াতি করে প্লট বাগিয়ে নেওয়ার ঘটনায় মজিবুর রহমান সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে আদালতে মামলাও করেছিলেন। অলির ঘনিষ্ঠ একটি সূত্রে জানা গেছে, বাংলাদেশ ও আমেরিকার দ্বৈত নাগরিক অলিউল ইসলাম অলি। গত ২০১৫ সালের ২২ জানুয়ারি ১০ বছর মেয়াদি আমেরিকান পাসপোর্ট ইস্যু হয়েছিল মোহাম্মদ অলিউর ইসলাম নামে। ওই পাসপোর্টের মেয়াদ উত্তীর্ণ হয়েছে ২০২৫ সালের ২১ জানুয়ারি। আরো জানা গেছে, মোহাম্মদ অলিউর ইসলাম নামে থাকা তাঁর বাংলাদেশি পাসপোর্ট ‘এএ৫৫৭৮১৬৮’ তিনি সর্বশেষ ২০১৪ সালে ব্যবহার করেছিলেন। এর পর থেকে তিনি আমেরিকান পাসপোর্ট ‘৫০৫৫০০১’ ব্যবহার করছেন। ২০১৯ সালে তিনি নাগরী ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকের পদ পান।  

শুধু পূর্বাচলের প্লটই নয়, রূপগঞ্জের অনেক আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীও জমিজমা বিক্রি করে দিচ্ছেন। তেমনি একজন তারাব পৌর যুবলীগের যুগ্ম সম্পাদক যাকারিয়া। তিনি তারাব পৌরসভার ৬ নম্বর ওয়ার্ডের কমিশনার ও সাবেক মন্ত্রী গোলাম দস্তগীর গাজীর আস্থাভাজন ছিলেন। তিন মাস আগে তারাব পৌরসভার সুতলরা মৌজায় ছয় বিঘা জমি বিক্রি করেছেন তিনি। প্রতি কাঠা প্রায় পাঁচ লাখ টাকা দরে ছয় বিঘা জমির বর্তমান বাজারদর ছয় কোটি টাকা। শুধু যাকারিরা নন, কায়েতপাড়া, ভুলতা, গোলাকান্দাইল, তারাব পৌরসভা, কাঞ্চন পৌরসভাসহ বেশ কিছু এলাকার আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীও জমিজমা বিক্রি করেছেন বলে স্থানীয় এলাকাবাসী সূত্রে জানা গেছে। তবে আত্মগোপনে থাকায় এঁদের অনেকের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করেও কারো বক্তব্য পাওয়া সম্ভব হয়নি।  

গাজীপুরে ডিবি মনিরুলের ৯ বিঘা খামার, জমি গোপনে বিক্রি

এদিকে গাজীপুরের কালীগঞ্জে চাকরিচ্যুত আলোচিত পুলিশ কর্মকর্তা মনিরুল ইসলামের রয়েছে মাছের খামার ও বিস্তর জমি। এসব সম্পদ তিনি কিনেছেন স্বজন ও বিশ্বস্তদের নামে। ওই জমি থেকে সম্প্রতি ৯ বিঘা গোপনে বিক্রি করে টাকা তাঁর কাছে পাঠানো হয়েছে। জমি বিক্রি ও টাকা লেনদেনের সবই হয়েছে তাঁর বিশ্বস্ত কেয়ারটেকার আ. মোমেনের মাধ্যমে। মোমেনের ঘনিষ্ঠ একাধিক ব্যক্তির সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য জানা গেছে। মো. মনিরুল ইসলাম পুলিশে পরিচিত ডিবি মনিরুল নামে।

আওয়ামী লীগের সাড়ে ১৫ বছরের শাসনামলে মো. মনিরুল ইসলাম ৯ বছর ছিলেন ঢাকা মহানগর ডিবি পুলিশে। তিনি ছিলেন কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইমের (সিটিটিসি) প্রধান। সর্বশেষ অতিরিক্ত আইজিপি মর্যাদায় ছিলেন এসবিপ্রধান হিসেবে। আলোচিত পুলিশ কর্মকর্তা সাবেক আইজিপি বেনজীর আহমেদের ঘনিষ্ঠও ছিলেন তিনি। ৫ আগস্টের পর আত্মগোপনে চলে যান মনিরুল। গণমাধ্যমে খবর ছড়িয়ে পড়ে যে তাঁকে ভারতের রাজধানী দিল্লিতে একটি দোকানে কেনাকাটা করতে দেখা গেছে। পরে তাঁকে চাকরি থেকে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠায় বর্তমান সরকার। তাঁর বিরুদ্ধে রয়েছে অনিয়ম-দুর্নীতির মাধ্যমে শত শত কোটি টাকার সম্পদ অর্জনের অভিযোগ।

রয়ান গ্রামে গেলে স্থানীয় লোকজন জানায়, পূর্বাচল নতুন শহরসংলগ্ন কালীগঞ্জের নাগরী ইউনিয়নের রয়ান মৌজার রয়ান গ্রামে প্রায় ১৫ বিঘা জমিতে ‘জুনায়েদ অ্যাগ্রো ফার্ম’ নামের একটি মৎস্য ও গরুর খামার রয়েছে। কাগজপত্রে রয়ান গ্রামের আবদুল মোমেন ওই খামারের মালিক হলেও নেপথ্যে মূল মালিক মনিরুল ইসলাম এবং তাঁর স্ত্রী শায়লা ফারজানা। ছয় বছর আগে জমিগুলো কেনেন তাঁরা। গাজীপুর জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে ৩০০ টাকা হাজিরা বেতনে উমেদার ছিলেন আ. মোমেন। এক পর্যায়ে মোমেনের মাধ্যমে রয়ান ও আশপাশের এলাকায় জমি কেনেন বেনজীর। পরে বেনজীরের মাধ্যমে পরিচয় ও সম্পর্ক হয় মনিরুল ইসলামের। দুই পুলিশ কর্মকর্তার সঙ্গে সম্পর্ক হওয়ায় এলাকায় রাতারাতি মোমেন হয়ে ওঠেন ক্ষমতাধর। ৫ আগস্টের পর মোমেনও আত্মগোপনে চলে যান। রোজার মাঝামাঝি তিনি এলাকায় ফিরে আসেন।

রয়ান ছাড়াও চানখোলা, পাঞ্জোরা ও বাগুরদা মৌজায়ও স্ত্রী শায়লা ফারজানা ও শ্যালক রেজাউল আলম শাহীনের নামে আরো ১৭ বিঘার মতো কৃষিজমি রয়েছে মনিরুল ইসলামের। এ ছাড়া নাগরীসংলগ্ন পূর্বাচলের গাজীপুর অংশে ভিআইপি জোন হিসেবে পরিচিত ২৭ নম্বর সেক্টরে মনিরুল এবং তাঁর স্ত্রী ও শ্যালকের নামে রয়েছে ১০ কাঠার চারটি প্লট। এসব প্লটের বর্তমান বাজারমূল্য ৮০ কোটি টাকার বেশি।

রয়ান গ্রামের একজন স্কুল শিক্ষক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের আগে দু-তিন বিঘা এবং সম্প্রতি সাত বিঘা জমি বিক্রি করে মনিরুলের কাছে ভারতে তাঁর কেয়ারটেকার মোমেন টাকা পৌঁছে দিয়েছেন বলে শুনেছেন। মোমেনই গোপনে ক্রেতা ঠিক করেছেন। মনিরুল ইসলাম আত্মগোপনে থাকায় জমি রেজিস্ট্রি হয়নি। পরে সুবিধাজনক সময়ে জমি রেজিস্ট্রি করে দেওয়া হবে। এ জন্য জমির দাম বর্তমান বাজারদরের চেয়ে কম দেওয়া হয়েছে।

পাশের চানখোলা এলাকার বাসিন্দা কৃষক ফয়েজ হোসেন বলেন, কয়েক বছর আগেও মোমেনের ছিল টানাটানির সংসার। পুলিশ কর্মকর্তা বেনজীর ও মনিরুলের সঙ্গে পরিচয় হওয়ার পর তাঁর ভাগ্য বদলে যায়। এখন ৩০ থেকে ৩৫ বিঘা জমির মালিক তিনি। চড়েন কোটি টাকার গাড়িতে। বেশির ভাগ জমিই পুলিশের ভয়ভীতি দেখিয়ে কম দামে কিনে নেওয়া হয়েছে।

সূত্র: কালের কণ্ঠ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।