এটা এখন স্পষ্ট যে অন্তর্বর্তী সরকার গায়ে পড়ে বিএনপির সঙ্গে ঝগড়া লাগাতে চাইছে। বিএনপিকে প্রতিপক্ষ বানাতে চাইছে।
বাংলাদেশে এখন চলছে সংস্কারের নাটক। সংস্কারের নাটক যে মূলত নির্বাচন অনিশ্চিত করার জন্য তা এখন পরিষ্কার। সংস্কার নাটকের মাধ্যমে চলছে নির্বাচন নিয়ে প্রহসন। নির্বাচন নিয়ে সরকারের অনাগ্রহ ‘বিরাজনীতিকরণ’ পরিকল্পনারই অংশ। বুধবার (২৮ মে) বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান বেশ স্পষ্ট করেই বলেছেন, ‘ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন হতেই হবে। ’ এর খানিক বাদেই জাপানে সফররত প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, ‘একটি দল ছাড়া কেউই ডিসেম্বরে নির্বাচন চায় না। ’ প্রধান উপদেষ্টার এ বক্তব্যটি সঠিক নয়। দেশের ৪৯টি নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলের বেশির ভাগই ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন চায়। দেশে সব রাজনৈতিক দলের মধ্যে শতাধিক ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচনের পক্ষে। জামায়াত ও হেফাজতও আগামী বছরের ফেব্রুয়ারির মধ্যে নির্বাচন চায়। নির্বাচন চায় না শুধু জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)। সরকার কি তাহলে শুধু এনসিপির ইচ্ছা-অনিচ্ছাকে গুরুত্ব দিচ্ছে? এনসিপি এখনো নিবন্ধিত কোনো দল নয়। এ দলকে সামনে রেখেই কি সরকার বিরাজনীতিকরণ ফর্মুলা বাস্তবায়ন করতে চায়?
গত বছর জুলাই বিপ্লব সংঘটিত হয়েছিল ছাত্র-জনতার স্বতঃস্ফূর্ত আন্দোলনের মাধ্যমে। ফ্যাসিবাদের পতন ঘটিয়ে ছাত্রসমাজ এ দেশে একটি বৈষম্যমুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিল। ছাত্রসমাজ চেয়েছিল এমন একটি ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করতে যেখানে ভেদাভেদ থাকবে না, হানাহানি হবে না, একে অন্যের শত্রু হবে না। সবাই মন খুলে কথা বলতে পারবে, ভিন্নমত দমন করা হবে না। জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠিত হবে। সে আকাক্সক্ষা নিয়েই ছাত্র-জনতা ৫ আগস্ট দীর্ঘ সাড়ে ১৫ বছর ক্ষমতায় থাকা একটি ফ্যাসিবাদী ব্যবস্থা উৎখাত করতে সক্ষম হয়েছিল। জনগণ তার সঙ্গে ছিল। গণ অভ্যুত্থানের পর ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে একটি অন্তর্বর্তী সরকারকে দায়িত্ব দেওয়া হয়। সবাই প্রত্যাশা করেছিল তিনি দায়িত্ব গ্রহণ করে দ্রুত দেশ স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনবেন এবং একটি নির্বাচনের পথে দেশ নিয়ে যাবেন। জনগণ দীর্ঘদিন পর নিজের পছন্দমতো ভোট দেবে। নিজের অভিপ্রায় প্রকাশ করবে এবং অবশেষে একটি গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ নবযাত্রা করবে। কিন্তু দায়িত্ব গ্রহণের পর ১০ মাস পার হতে চলল, নির্বাচনের নামগন্ধ নেই। নির্বাচনের কথা শুনলেই সরকারের মধ্যে এক ধরনের অস্বস্তি দেখা দেয়। তারা নির্বাচনের কথা শুনলেই নানান রকম অজুহাত দেখায়। নির্বাচনের দাবি উচ্চারণ করলেই যেন দেশে অশান্তি, অরাজকতা সৃষ্টি করা হয়। নির্বাচনের চেয়ে এ সরকারের মনোযোগ নানান রকম অপ্রয়োজনীয় কাজে। ১০ মাসে দেশের সবচেয়ে বড় যে ক্ষতিটি হয়েছে তা হলো অন্তর্বর্তী সরকার তার নিরপেক্ষতা হারিয়েছে। এ সরকার যেন একটি বিশেষ মহলের পক্ষে কাজ করছে। বিশেষ কিছু এজেন্ডা বাস্তবায়নে ব্যস্ত। নির্বাচন পিছিয়ে দেওয়া বা নির্বাচন অনিশ্চিত করার জন্য এ সরকারের প্রধান অস্ত্র হিসেবে দেখানো হচ্ছে সংস্কার, বিচার। কিন্তু এ দুটি চলমান এবং দীর্ঘ প্রক্রিয়া। সংস্কার আর গণহত্যার বিচারের কারণে দেশ অনন্তকাল একটি অনির্বাচিত সরকারের হাতে বন্দি থাকতে পারে না। এটা এখন স্পষ্ট, এ সরকারের নির্বাচনে আগ্রহ নেই। বিশেষ করে প্রধান উপদেষ্টা জাপানে যে বক্তব্য দিয়েছেন, তাতে তিনি অটল থাকলে অদূর ভবিষ্যতে এ দেশে নির্বাচনের কোনো সম্ভাবনা নেই।
সংস্কার নাটকের শেষ কোথায় তা নিয়েও একটি বড় প্রশ্ন। সরকারের ১০ মাস পার হচ্ছে। প্রধান উপদেষ্টা বিভিন্ন ক্ষেত্রে সংস্কারের জন্য সংস্কার কমিটি গঠন করেছিলেন। সে কমিটিগুলো রিপোর্ট দিয়েছে ফেব্রুয়ারিতে। এখন নির্বাচন এগিয়ে নেওয়ার জন্য মোটা দাগে দুটি সংস্কার খুব জরুরি। একটি হলো নির্বাচন কমিশনের সংস্কার। আরেকটি সংবিধান সংস্কার। আমরা যদি নির্বাচন কমিশন সংস্কার এবং সংবিধান সংস্কার এ দুটি গুরুত্বপূর্ণ সংস্কারের ব্যাপারে রাজনৈতিক দলগুলোর অবস্থান পর্যালোচনা করি, তাহলে দেখব যে মৌলিক বিষয়গুলোতে রাজনৈতিক দলগুলোর ইতোমধ্যে ঐকমত্য ঘটেছে। সব রাজনৈতিক দল সংবিধান সংস্কারের মৌলিক বিষয়ে একমত।
তার মধ্যে রয়েছে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা ফিরিয়ে আনা, দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদ, বিরোধী দল থেকে স্পিকার নিয়োগ, সংসদের গুরুত্বপূর্ণ স্থায়ী কমিটিগুলোর চেয়ারম্যান হিসেবে বিরোধী দলের সদস্যকে নেওয়া, বিচার বিভাগ পৃথক্করণ, সংবিধানের ১১৬ অর্থাৎ বিচার বিভাগের স্বাধীনতাসংক্রান্ত অনুচ্ছেদ সংশোধন। আপিল বিভাগের জ্যেষ্ঠতম বিচারপতিকে প্রধান বিচারপতি নিয়োগসহ আরও অনেক বিষয়। এটুকুই একটি গণতান্ত্রিক ও জবাবদিহিমূলক রাষ্ট্র বিনির্মাণের জন্য যথেষ্ট বলে রাজনীতি বিশ্লেষকরা মনে করেন। তার চেয়েও বড় কথা সংবিধান সংস্কার এ অন্তর্বর্তী সরকার করতে পারবে না। কারণ সংবিধান সংস্কারের একমাত্র এখতিয়ার সংসদের। রাজনৈতিক দলগুলো এখন এসব বিষয়ে শুধু অঙ্গীকার করতে পারবে। নির্বাচন ছাড়া সংবিধান সংশোধন হবে না। তাই রাষ্ট্র সংস্কারের পূর্ণতার জন্যও নির্বাচন জরুরি। রাজনৈতিক দলগুলো যেসব বিষয়ে একমত হয়েছে, তার বাইরে ঐকমত্য সম্ভব না। তাহলে আর গণতন্ত্র থাকে না। সব রাজনৈতিক দল যদি সব বিষয়ে অভিন্ন মত প্রকাশ করে তাহলে সেই গণতন্ত্র এক ধরনের সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থা হয়ে যায়। এটা আরেক বাকশালি ব্যবস্থারই নামান্তর। বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের বিভিন্ন মত থাকবে। যেমন দুবারের বেশি কেউ প্রধানমন্ত্রী হতে পারবেন নাÑএ রকম একটি প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। সেখানে কিছু পক্ষ বলেছে এটি সঠিক। আবার অনেকে বলছে, পরপর দুবারের বেশি প্রধানমন্ত্রী হতে পারবেন না ঠিক আছে। তারপর বিরতি দিয়ে আবার প্রধানমন্ত্রী হওয়া যাবে। এ বিরোধগুলো রাজনৈতিক দলের মধ্যে থাকতেই হবে, থাকা উচিত। এ বিরোধগুলো যদি না থাকে তাহলে গণতন্ত্রের সৌন্দর্য থাকে না। গণতন্ত্র মানেই বহু মত, বহু পথ। জনগণ যে কোনো একটি পথ বেছে নেবে ভোটের মাধ্যমে। কিন্তু সে পথে অন্তর্বর্তী সরকারের আগ্রহ নেই। জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সহসভাপতি ড. আলী রীয়াজ বলেছেন, জুলাইয়ে ‘জাতীয় সনদ’ ঘোষণা করা হবে। কেন জুলাই? জুন কী দোষ করল। দেশে স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনার জন্য প্রতিটি দিন যখন গুরুত্বপূর্ণ, তখন আলী রীয়াজের এ বক্তব্য উদ্দেশ্যপ্রণোদিত।
যে পর্যন্ত সংস্কার প্রস্তাব তৈরি হয়েছে তার জন্য এত সময় লাগার কথা নয়। এটি ১৫ থেকে ২০ দিনের একটি কাজ। অতীতে আমরা দেখেছি এ ধরনের সংস্কারগুলো হয়েছে দ্রুত এবং অল্প সময়ের মধ্যে। এখন মনে হচ্ছে যে সুশীল সমাজ যেন রাজনৈতিক দলগুলোকে গণতন্ত্র শেখাতে চাইছে। তারা তাদের ইচ্ছা রাজনৈতিক দলগুলোর ওপর চাপিয়ে দিতে চাইছে। এটা সুস্পষ্ট যে সংস্কার এ অন্তর্বর্তী সরকারের একটি অস্ত্র, যে অস্ত্র দিয়ে তারা দীর্ঘদিন ক্ষমতায় টিকে থাকতে চায়। তাদের নিজস্ব কিছু এজেন্ডা বাস্তবায়ন করতে চায়, যে এজেন্ডাগুলোর সঙ্গে জনগণের, রাষ্ট্রের এবং রাজনৈতিক দলগুলোর কোনো সম্পর্ক নেই।
একটি লক্ষণীয় বিষয় হলো, সরকার ছাড়া প্রায় সব রাজনৈতিক দল, সশস্ত্র বাহিনী এবং জনসাধারণ সবাই এখন নির্বাচনের পক্ষে। তারা মনে করে, দ্রুত একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন হওয়া উচিত। কারণ গত ১০ মাসে দেশের মানুষ অতিষ্ঠ। এ সরকার দেশ পরিচালনা করতে গিয়ে সবকিছু তালগোল পাকিয়ে ফেলেছে। কোনো কিছুই ঠিকঠাকমতো চলছে না। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি, অর্থনীতি, ব্যবসাবাণিজ্য, সমাজজীবন, রাজনীতি কোথাও স্বস্তি নেই। সবচেয়ে দুর্ভাগ্যজনক ব্যাপার হলো সরকার ইচ্ছা করেই কিছু পরিস্থিতি তৈরি করছে।
ইশরাক হোসেনের মেয়র হওয়ার কথাই ধরা যাক। হাই কোর্টের রায়ের পর শপথ অনুষ্ঠানের আয়োজন না করার কারণ কী? অন্তর্বর্তী সরকারের তো কারও পক্ষ অবলম্বন করা উচিত নয়। তারা তো নিরপেক্ষভাবে দায়িত্ব পালন করবে। কিন্তু এখন জনগণ বিশ্বাস করছে অন্তর্বর্তী সরকারের বিশেষ কোনো এজেন্ডা রয়েছে। যেমন আরাকান আর্মির সঙ্গে সম্পর্ক নিয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের একটি গোপন অভিপ্রায় ক্রমে স্পষ্ট হচ্ছে। আন্তর্জাতিক কূটনীতিতেও বাংলাদেশ এখন রহস্যময় ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে। এসব স্পর্শকাতর, গুরুত্বপূর্ণ এবং জনগণের স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়ে কারও মতামত না নিয়ে গোপনে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হচ্ছে। আর সরকারের এসব আত্মঘাতী এবং দেশের জন্য ক্ষতিকর সিদ্ধান্তের পথে একমাত্র বাধা বিএনপি। ছাত্ররা না বুঝে রাষ্ট্রপতিকে সরিয়ে একটি সাংবিধানিক শূন্যতা সৃষ্টি করতে চেয়েছিলেন। বিএনপির দায়িত্বশীল ভূমিকার কারণে তা সম্ভব হয়নি। ‘রাখাইন করিডর’-এর নামে দেশকে প্রক্সি ওয়ারের সিদ্ধান্ত বিএনপি রুখে দেয়। চট্টগ্রাম বন্দর বিদেশিদের হাতে তুলে দেওয়ার বিরুদ্ধেও জাতীয়তাবাদী চেতনায় বিশ্বাসী দলটি তীব্র আপত্তি জানিয়েছে। এসব কারণেই বিএনপি এখন অন্তর্বর্তী সরকারের পথের কাঁটা। বিএনপির জন্যই এ সরকার গণবিরোধী, দেশের স্বার্থবিরোধী গোপন এজেন্ডা বাস্তবায়ন করতে পারছে না। এজন্যই কি তাহলে বিএনপিকে মাইনাস করার আয়োজন চলছে?
বিএনপি দীর্ঘদিন ধরে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতি সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে। ড. মুহাম্মদ ইউনূসের প্রতি সম্মান জানিয়েছে। কিন্তু সেই ধৈর্যের বাঁধ যেন আস্তে আস্তে ভেঙে যাচ্ছে। এতে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না যদি কিছুদিন পর এ সরকারের বিরুদ্ধে জনগণ এবং রাজনৈতিক দলগুলো আন্দোলন শুরু করে। সেটা হলে তা হবে গণতন্ত্রের জন্য লড়াইয়ের দ্বিতীয় ধাপ। জুলাই বিপ্লবের অনর্জিত স্বপ্ন বাস্তবায়নের আরেকটি লড়াই। যে লড়াইয়ে নির্ধারণ হবে আগামীর বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হবে, নাকি বিদেশি এজেন্ডা বাস্তবায়নের জন্য তাঁবেদার রাষ্ট্র?
লেখক : নাট্যকার ও কলাম লেখক
Email : [email protected]
সৌজন্যে বাংলাদেশ প্রতিদিন