ঢাকা, মঙ্গলবার, ১৯ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২, ০৩ জুন ২০২৫, ০৬ জিলহজ ১৪৪৬

বাংলানিউজ স্পেশাল

অধ্যাদেশ: কথায় কথায় চাকরি হারানোসহ যেসব আশঙ্কা কর্মচারীদের

ইসমাইল হোসেন, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৬:০০, জুন ১, ২০২৫
অধ্যাদেশ: কথায় কথায় চাকরি হারানোসহ যেসব আশঙ্কা কর্মচারীদের রোববারও সচিবালয়ে বিক্ষোভ পালন করেছেন কর্মচারীরা। ছবি: বাংলানিউজ

ঢাকা: সরকারি চাকুরি অধ্যাদেশ, ২০২৫ নিয়ে সরকারি চাকরিজীবীদের মধ্যে নানা আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। তারা বলছেন, এই অধ্যাদেশ বাস্তবায়ন হলে শুধু একটি চিঠি দিয়েই চাকরিচ্যুতি বা দণ্ড প্রদান করা সম্ভব হবে।

এতে ক্ষমতার অপব্যবহারের ঝুঁকি বেড়ে যাবে, অপছন্দের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা কর্মক্ষেত্রে নাজেহাল হবেন। বিশেষত নারী সহকর্মীদের জন্য এই অধ্যাদেশ আতঙ্কের কারণ হয়ে দাঁড়াবে, কারণ তারা কাজের পরিবেশে ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে পড়বেন।

এসব আশঙ্কার পরিপ্রেক্ষিতে, সরকারি চাকুরি অধ্যাদেশ, ২০২৫ অবিলম্বে বাতিলের দাবিতে সোচ্চার হয়েছেন সরকারি চাকরিজীবীরা। সচিবালয়ে কর্মরত সব সংগঠন একজোট হয়ে ‘বাংলাদেশ সচিবালয় কর্মকর্তা-কর্মচারী ঐক্য ফোরাম’ গঠন করেছে এবং এই অধ্যাদেশ প্রত্যাহারের দাবি জানিয়েছে।

উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে সরকারি চাকুরি (অধ্যাদেশ), ২০২৫-এর খসড়া চূড়ান্ত অনুমোদন করার পর গত ২৫ মে এই অধ্যাদেশ জারি করা হয়। এর পর থেকেই সচিবালয়ে সরকারি চাকরিজীবীরা বিক্ষোভ মিছিলসহ নানা কর্মসূচি পালন করছেন। অধ্যাদেশ বাতিলের দাবিতে লাগাতার কর্মসূচির অংশ হিসেবে, রোববার (১ জুন) সচিবালয়ে বিক্ষোভ করেছেন কর্মচারীরা। পরে তারা খাদ্য ও ভূমি উপদেষ্টা আলী ইমাম মজুমদার, বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ এবং সড়ক পরিবহন ও সেতু উপদেষ্টা ফাওজুল কবিরের কাছে স্মারকলিপি দেন।

উপদেষ্টারা স্মারকলিপি গ্রহণ করে আন্দোলনকারীদের আশ্বস্ত করেন, বিষয়টি নিয়ে প্রধান উপদেষ্টাসহ উপদেষ্টা পরিষদের আলোচনার মাধ্যমে সমস্যা সমাধানের উদ্যোগ নেওয়া হবে।

সরকারি চাকুরি (অধ্যাদেশ), ২০২৫-এর খসড়ায় উল্লেখ করা হয়েছে- ‘সরকারি কর্মচারী যদি এমন কোনো কাজে লিপ্ত হন, যা অননুগত্যের শামিল বা যা অন্য যেকোনো সরকারি কর্মচারীর মধ্যে অননুগত্য সৃষ্টি করে বা শৃঙ্খলা বিঘ্নিত করে বা কর্তব্য সম্পাদনে বাধার সৃষ্টি করে; অন্যান্য কর্মচারীর সঙ্গে সমবেতভাবে বা এককভাবে ছুটি ছাড়া বা কোনো যুক্তিসঙ্গত কারণ ছাড়া নিজ কর্ম থেকে অনুপস্থিত থাকেন বা বিরত থাকেন বা কর্তব্য সম্পাদনে ব্যর্থ হন; অন্য যেকোনো কর্মচারীকে তার কর্ম থেকে অনুপস্থিত থাকতে বা বিরত থাকতে বা তার কর্তব্য পালন না করার জন্য উসকানি দেন বা প্ররোচিত করেন এবং যেকোনো সরকারি কর্মচারীকে তার কর্মে উপস্থিত হতে বা কর্তব্য সম্পাদনে বাধাগ্রস্ত করেন, তাহলে তিনি অসদাচরণের দায়ে দণ্ডিত হবেন।

এসব অপরাধের শাস্তি হিসেবে বলা হয়েছে, দোষী কর্মচারীকে নিম্নপদ বা নিম্ন বেতন গ্রেডে অবনমিতকরণ বা চাকরি থেকে অপসারণ বা চাকরি থেকে বরখাস্ত দণ্ড প্রদান করা যাবে। এতে বলা হয়, সরকারি কর্মচারীর বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠনের সাত দিনের মধ্যে সংশ্লিষ্ট কর্মচারীকে কারণ দর্শানোর নোটিশ দেওয়া হবে। আর অভিযুক্তকে দোষী সাব্যস্ত করা হলে তাকে কেন দণ্ড আরোপ করা হবে না, সে বিষয়ে আরও সাত কর্মদিবসের মধ্যে কারণ দর্শানোর নোটিশ দেওয়া হবে। তার ভিত্তিতে দণ্ড আরোপ করা যাবে। এভাবে দণ্ড আরোপ করা হলে দোষী কর্মচারী ৩০ কর্মদিবসের মধ্যে সেই আদেশের বিরুদ্ধে আপিল করতে পারবেন। তবে, রাষ্ট্রপতির দেওয়া আদেশের বিরুদ্ধে আপিল করা যাবে না। যদিও আদেশ পুনর্বিবেচনার জন্য সংশ্লিষ্ট কর্মচারী রাষ্ট্রপতির কাছে আবেদন করতে পারবেন। ’

সরকারি চাকরিজীবীরা জানিয়েছেন, তারা বিশ্বস্ত একটি সূত্রের মাধ্যমে জানতে পেরেছেন, ১৯৭৯ সালের বিতর্কিত ধারাগুলো পুনরায় চালু করেছে। এ আইন জারি হলে- বিভাগীয় মামলার পরিবর্তে শুধুমাত্র একটি চিঠি দিয়ে চাকরিচ্যুতি বা দণ্ড দেওয়া হবে। কিছু স্বার্থবাদী কর্মকর্তাদের কাছে কর্মচারীরা ব্যক্তিগত দাসে পরিণত হবে। ক্ষমতার অপব্যবহার বেশি হবে। বিভিন্ন কারণে অপছন্দের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা কর্মক্ষেত্রে নাজেহাল হবে। চাকরি হারানোর সুযোগ তৈরি হবে।

তারা আরও বলছেন, যাকে অপছন্দ, দেখতে পারেন না বা কারও বিরুদ্ধে কোনো কথা বললে কর্মচারীরা কর্মকর্তাদের রোষানলে পড়বেন। অভিযোগকারী কর্মকর্তারা নিজেরাই তদন্তকারী ও বিচারকের ভূমিকা পাবেন। এসব কারণে ভয় সৃষ্টি হবে; ফলে সরকারি কাজের পরিবেশ বিঘ্নিত হবে। তা ছাড়া নারী সহকর্মীদের এক প্রকার ভীত পরিবেশে কাজ করতে হবে। কোনো কোনো কর্মচারী রাজনৈতিক মতাদর্শের কারণে চাকরি হারাতে পারেন। এমনকি কেউ কেউ ধর্মীয় রীতিনীতি পালনের কারণেও কর্মকর্তার রোষানলে পড়তে পারেন; দেশ ও জাতির সেবা প্রদানের ক্ষেত্রে কর্মচারীদের চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতা সংকুচিত হবে। কর্মচারীদের ন্যায্যতা-প্রাপ্যতার দাবিগুলোর বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে দারুণভাবে বাঁধার সৃষ্টি করবে। জারিকৃত অধ্যাদেশটি ব্যাপকভাবে ক্ষমতার অপব্যবহার নিঃসন্দেহে বেশি হবে। এ অধ্যাদেশের আওতায় কেউ শাস্তি পেলে তিনি আদালতের দ্বারস্থ হতে পারবে না বলেও জানিয়েছেন তারা।

সরকারি কর্মচারীরা রাষ্ট্রের চালিকাশক্তি উল্লেখ করে সচিবালয়ের কর্মচারীরা অধ্যাদেশ সংশ্লিষ্টদের বলছেন, আমাদের অহেতুক বিপথগামী করবেন না। শতকরা ৯০ ভাগ কর্মচারীর কোনো রাজনৈতিক মতাদর্শ নেই। মুষ্টিমেয় কতিপয় কর্মচারীর কৃতকর্মের দায়ভার সকলের ওপর চাপিয়ে দেবেন না।

বিশ্লেষকরা বলছেন, উপদেষ্টা পরিষদ অনুমোদিত খসড়া আইনটি সংবিধানের সঙ্গে সরাসরি সাংঘর্ষিক ও পরস্পর বিপরীতমুখী। কেননা, সংবিধানের অনুচ্ছেদ-১৯ এর সুযোগের সমতা বিনষ্ট হবে। অনুচ্ছেদের ২১-এর নাগরিক ও সরকারি কর্মচারীদের কর্তব্য পালনে বিঘ্ন সৃষ্টি হবে। অনুচ্ছেদের ২৭-এর আইনের দৃষ্টিতে সমতার ভারসাম্যতা বিনষ্ট হবে। অনুচ্ছেদের ৩১-এর আইনের আশ্রয় লাভের অধিকার ক্ষুণ্ন হবে। অনুচ্ছেদের ৩৭-এর সমাবেশের স্বাধীনতা থাকবে না। অনুচ্ছেদে ৩৯-এর প্রজাতন্ত্রে নিয়োজিত কর্মচারীদের চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতা মারাত্মকভাবে ক্ষুণ্ন হবে।

১৯৭৯ সালের বিতর্কিত কালো আইন ও কালা-কানুন অবিলম্বে বাতিল না হলে বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের ভাবমূর্তি দারুণভাবে ক্ষুণ্ন হবে বলেও মনে করেন তারা। তারা শঙ্কা প্রকাশ করছেন, দেশের সকল সরকারি অফিস ও দপ্তরে অহেতুক আন্দোলন ছড়িয়ে পড়বে। সব বিভাগীয় কমিশনার, জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে কর্মরত কর্মচারীদের মাঝে তীব্র অসন্তোষ তৈরি হবে। সচিবালয়ের শান্ত পরিবেশকে অহেতুক অস্থিরতা তৈরি করবে; বর্তমান সরকারের বিরুদ্ধে সরকারি কর্মচারীদেরকে মুখোমুখি দাঁড় করানো হবে।

এমন উত্তেজক পরিস্থিতিতে রোববার (১ জুন) সরকারি কর্মচারী ঐক্য ফোরামের কো-চেয়ারম্যান মো. নুরুল ইসলাম, কো-মহাসচিব মো. নজরুল ইসলামসহ নেতারা খাদ্য ও ভূমি উপদেষ্টা আলী ইমাম মজুমদার, বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ এবং সড়ক পরিবহন ও সেতু উপদেষ্টা ফাওজুল কবিরের কাছে স্মারকলিপি দেন।

স্মারকলিপি নেওয়ার পর আলী ইমাম মজুমদার তাদের উদ্দেশ্যে বলেন, ‘এখন এটা সমাধান করা একক কোনো উপদেষ্টার ব্যাপার না, এটা উপদেষ্টা পরিষদের ব্যাপার। আপনারা আইন-কানুন মেনে, সচিবালয়ের দীর্ঘদিনের যে সংস্কৃতি সেই সংস্কৃতি অনুযায়ী চলবেন। ‌ সচিবালয়ের কর্মপরিবেশ ব্যাহত করবেন না এই অনুরোধ জানাচ্ছি। ’

উপদেষ্টা ফাওজুল কবির বলেন, ‘এখানে (অধ্যাদেশে) কিছু প্রভিশন (ধারা) আছে যেগুলোর অপপ্রয়োগ হওয়ার আশঙ্কা আছে। আমি এটি নিয়ে আলোচনা করব। তবে এই অধ্যাদেশটি যে অপপ্রয়োগ হওয়ার সম্ভাবনা আছে, সেগুলোকে অ্যাড্রেস করা যায় কিনা। সেটাও আপনারা একটু মাথায় রাখবেন। ’

ফাওজুল কবির আরও বলেন, ‘এটার যে একটা ত্রুটি আছে। সেটা সম্পর্কে কিন্তু আমরা সম্পূর্ণ সচেতন। আমি আপনাদের বাতিল করার দাবি উপদেষ্টা পরিষদে জানাবো। আপনারা ভেবে দেখবেন, এই অধ্যাদেশটির রেখে কি কি সেইফ গার্ডস ইন্ট্রোডিউস করলে এটা গ্রহণযোগ্য হবে। সরকারি অফিসে কাজের পরিবেশের বিষয়ে কর্মচারীদের নজর দেওয়ার অনুরোধ জানান এই উপদেষ্টা।

এমআইএইচ/এমজে

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।