ঢাকা: মাঝেমধ্যে বাজছে ফায়ার সার্ভিসের সাইরেন। হুইসেল বাজিয়ে আসছে অ্যাম্বুলেন্স।
রাজধানীর উত্তরার মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজে ক্যাম্পাসে সোমবার (২১ জুলাই) দুপুরে বিমান বাহিনীর প্রশিক্ষণ বিমান বিধ্বস্ত হওয়ার ঘটনাস্থলে দেখা মিলছে এমন দৃশ্যের। সন্ধ্যায় ঘনিয়ে আসা অন্ধকারে অভিভাবকরা যেন নিখোঁজ স্বজনকে খুঁজে পাওয়ার আশার আলোর খোঁজে ছুটে চলেছেন।
অথচ দুপুর সোয়া ১টার দিকে প্রশিক্ষণ বিমানটি যখন আছড়ে পড়লো, তারপর অনেকসময় কেউ দুর্ঘটনার ভয়াবহতা আঁচ করতে পারেননি। অনেকেই বুঝতে পারেননি, কেন এতগুলো অ্যাম্বুলেন্স যাচ্ছে-আসছে। ফায়ার সার্ভিস যখন মৃতের সংখ্যা ১৮ ঘোষণা করলো, তখন বোঝা গেল কী ট্র্যাজেডি নামল উত্তরার আকাশে, যাতে ঝরে গেল অনেক তাজা প্রাণ।
প্রশিক্ষণ বিমানটি বিধ্বস্ত হওয়ার পরপরই খবর ছড়িয়ে যায়। সোশ্যাল মিডিয়ায় বিধ্বস্ত বিমান এবং আগুনে পোড়া শিক্ষার্থীদের ছবি ভাইরাল হয়ে যায়। ঘটনার ভয়াবহতা শুনে চারদিকে হাজারো উৎসুক জনতা ভিড় করেন রাজধানীর শেষপ্রান্তের দিয়াবাড়িতে। এদের মধ্যে কেউ কেউ সন্তানের খোঁজে আসেন, কেউ আসেন ছোটভাই, ভাতিজা-ভাতিজি, ভাগ্নে-ভাগ্নির খোঁজে।
অষ্টম শ্রেণির শিক্ষার্থী লামিমের বাবা স্কুলশিক্ষক বলেন, ‘আমার ছেলে প্রথমে ফোন করে বলেছে, স্কুলে বোমার মতো কিছু মেরেছে। আমার সঙ্গে থাকা তিনজন মারা গেছে। পরে জানতে পেরেছে যে বিমান বিধ্বস্ত হয়েছে। তাকে তার গাইড শিক্ষক নিয়ে যেতে বলেছেন। এখন হোস্টেলে আছে। সুস্থ আছে। ’
তিনি বলেন, ‘আমার সঙ্গে কথা হয়েছে লামিমের। তবে সে ভয় পাচ্ছে। কান্নাকাটি করছে। ’ বলতে বলতে কেঁদে ফেলেন লামিমের বাবা।
তৃতীয় শ্রেণির এক ছাত্রের খোঁজে এসেছেন তার বাবা। তিনি বলেন, ‘কোনো খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না। কয়েকটি হাসপাতালেও খোঁজ নিয়েছি। ’ ছেলের শোকে তার কান্না ছুঁয়ে যাচ্ছে অন্যদেরও।
দুর্ঘটনার পরপরই সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যরা এলাকা তাদের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে নেন। পুরো এলাকায় সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী, বিমানবাহিনী সদস্যরা ছাড়াও পুলিশ, বিজিবি ও র্যাব মোতায়েন করা হয়।
বিমান বিধ্বস্ত হওয়ার স্থান সরাসরি প্রত্যক্ষ করেছেন বাংলানিউজের সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট জিএম মুজিবুর। তিনি দেখেছেন, বিমানের অর্ধেক অংশ স্কুলের নিচতলায় ঢুকে পড়েছে।
নিহত ১৯, আহত ১৬৪
আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তর-আইএসপিআর থেকে জানানো হয়, বিমান বিধ্বস্ত হওয়ার ঘটনায় ১৯ জন নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন ১৬৪ জন।
নিহতদের মধ্যে সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে (সিএমএইচ) ১২ জন, জাতীয় বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে দুজন, কুর্মিটোলা জেনারেল হসপিটালে দুজন, লুবনা জেনারেল হাসপাতাল অ্যান্ড কার্ডিয়াক সেন্টারে দুজন এবং উত্তরা আধুনিক হসপিটালে একজনের লাশ রয়েছে। সিএমএইচে নিহতদের মধ্যে পাইলট ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট তৌকিরও রয়েছেন।
আর আহতদের মধ্যে জাতীয় বার্ন ইনস্টিটিউটে ৭০ জন, উত্তরা আধুনিক হসপিটালে ৬০ জন, সিএমএইচে ১৪ জন, লুবনা জেনারেল হাসপাতালে ১১ জন, কুয়েত মৈত্রী হাসপাতাল আটজন এবং উত্তরা ক্রিসেন্ট হাসপাতালে একজন চিকিৎসা নিচ্ছেন।
রক্তের জন্য মাইকিং
দুর্ঘটনায় আহত বিভিন্নজনকে নিকটবর্তী ও দূরবর্তী বিভিন্ন হাসপাতালে নেওয়া হচ্ছে। তাদের জন্য লাগছে রক্ত। এর মধ্যে দুষ্প্রাপ্য ‘ও নেগেটিভ’ এবং ‘এ নেগেটিভ’ রক্তের জন্য হ্যান্ড মাইকে বারবার ঘোষণা দেওয়া হচ্ছে ঘটনাস্থলে। বলা হচ্ছে, যারা পারেন রক্ত দিয়ে সহায়তা করেন।
যান্ত্রিক ত্রুটির জন্য দুর্ঘটনা
আইএসপিআর জানায়, এফটি-৭ বিজিআই যুদ্ধবিমান নিয়মিত প্রশিক্ষণের অংশ হিসেবে দুপুর ১টা ৬ মিনিটে কুর্মিটোলার বাংলাদেশ বিমান বাহিনী ঘাঁটি এ কে খন্দকার থেকে উড্ডয়নের পর যান্ত্রিক ত্রুটির সম্মুখীন হয়। বড় ধরনের ক্ষয়ক্ষতি এড়াতে ও দুর্ঘটনা মোকাবিলায় বৈমানিক ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট মো. তৌকির ইসলাম বিমানটিকে ঘনবসতি এলাকা থেকে জনবিরল এলাকায় নিয়ে যাবার সর্বাত্মক চেষ্টা করেন। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত বিমানটি ঢাকার দিয়াবাড়িতে মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের দোতলা একটি ভবনে অনাকাঙ্ক্ষিতভাবে বিধ্বস্ত হয়।
দুর্ঘটনার সুনির্দিষ্ট কারণ তদন্তের মাধ্যমে জানানো হবে বলে আইএসপিআরের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে।
আহতদের চিকিৎসার বিষয়ে সার্বক্ষণিক খোঁজ রাখছেন প্রধান উপদেষ্টা
প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং থেকে জানানো হয়েছে, আহতদের চিকিৎসার বিষয়ে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস সার্বক্ষণিক খোঁজখবর রাখছেন।
প্রেস উইং থেকে বলা হয়, চিকিৎসা কাজ নির্বিঘ্নে করার স্বার্থে হাসপাতাল এলাকায় অহেতুক ভিড় না করার জন্য সর্বসাধারণকে বিশেষভাবে অনুরোধ করা যাচ্ছে।
এমআইএইচ/এইচএ/