ঢাকা, শনিবার, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ২৮ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

জাতীয়

স্মৃতিতে মানিকদা, হত্যার বিচার হোক

রাহুল রাহা, সাংবাদিক | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১০৪৩ ঘণ্টা, জানুয়ারি ১৫, ২০১৫
স্মৃতিতে মানিকদা, হত্যার বিচার হোক মানিক সাহা

এগারো বছর কেটে গেলো টের পাই না। মনে হয় মানিকদা আছেন, ফোন দিলেই ধরবেন।

জানতে চাইবে করবেন, ঢাকার খবর কি! অথবা খুলনা গেলেই তার সাথে দেখা হবে। তার হাসিমাখা উজ্জ্বল মুখ আমাকে অভয় দেবে। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, মানিকদা নেই। তাকে থাকতে দেওয়া হয়নি। তাকে হত্যা করা হয়েছে। এবং আরো মর্মান্তিক বাস্তবতা হচ্ছে, দশ বছরেও তার হত্যাকা-ের কোন কুলকিনারা হয়নি। কেউই শাস্তি পায়নি।

মানিকদা, মানে সাংবাদিক মানিক সাহার কথা বলছি। আমৃত্যু তিনি খুলনাতে কাজ করলেও সারাদেশেই পরিচিত ছিলেন। পরিচিত ছিলেন আপোষহীন সাংবাদিক হিসেবে, চিংড়ীঘের বিরোধী পরিবেশবাদী হিসেবে, সুন্দরবন রক্ষা আন্দোলনের সেনাপতি হিসেবে, দেশের দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চলের মানবাধিকার রক্ষার অগ্রদূত হিসেবে।

প্রগতিশীল দৈনিক সংবাদে কাজ করেছেন আমৃত্যু। সময়ের প্রয়োজনে কাজ করেছেন বিবিসি বেতারে, নিউ এজ পত্রিকায় এবং একুৃশে টেলিভিশনে। কমরেড রতন সেনের শিষ্য হিসাবে আদর্শবোধকে কখনোই ঝেড়ে ফেলেননি। এরশাদ শিকদারের মত কুখ্যাত সন্ত্রাসী বিএনপি থেকে আওয়ামী লীগে যোগ দিলে তিনি তীব্র সমালোচনা করে রিপোর্ট করেন। বলা যায় তার লেখনীতেই এরশাদ শিকদার বহিষ্কৃত হয় আওয়ামী লীগ থেকে। মূলতঃ তার উদ্যোগে ও নেতৃত্বে সমবেত সাংবাদিক সমাজ এরশাদ শিকদারের পতন ত্বরান্বিত করে। সুন্দরবন ধ্বংসকারী চিংড়ীচাষের বিরুদ্ধে তিনি সোচ্চার ছিলেন। চিংড়ী চাষের নামে পরের জমি দখল, বন্দুকবাজী, হত্যা-ধর্ষণের বিরুদ্ধে লিখতে তিনি কখনো এতটুকু ভীত হননি। হুমকি তার সাংবাদিকতা জীবনের নিত্য সঙ্গী ছিলো। কিন্তু কোন হুমকিতেই মাথা নোয়াননি। বাংলাভাই হয়ে ওঠার অনেক আগেই তিনি সিদ্দীকুল ইসলামের কর্মকা- নিয়ে সিরিজ রিপোর্ট করেছেন, কোটালীপাড়ার ছিয়াত্তর কেজি বোমার ঘটনার সূত্র ধরে মুফতি হান্নানদের নিয়ে অনুসন্ধানী রিপোর্ট করেছেন। উদীচীর বোমা হামলা, গোপালগঞ্জের গীর্জায় বোমা হামলা, শেখ হেলালের জনসভায় বোমা হামলা নিয়ে তার অনুসন্ধানী রিপোর্ট জঙ্গীবাদীদের উত্থান সম্পর্কে সকলের চোখ খুলে দেয়। দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের বাম চরমপন্থীদের নিয়েও তার অসংখ্য সাহসী প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়।

অন্যায়ের কাছে মাথা না নোয়ানো মানিক সাহা বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিবাদে পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট দুপুরে খুলনা শহরে মিছিল বের করে গ্রেপ্তার হন। এরশাদের সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেও গ্রেপ্তার হন তিনি। দুই দফায় প্রায় চার বছর জেল খাটেন। ২০০১ সালের নির্বাচন পরবর্তী সংখ্যালঘু নির্যাতন নিয়ে তিনি বিবিসি, একুশে টিভি ও সংবাদে রিপোর্ট করে সরকারের রোষাণলে পড়েন। খুলনার জেলা প্রশাসনের আইন-শৃঙ্খলা সভায় তখনকার একজন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মানিক সাহাকে ভারতের চর হিসাবে অভিহিত করে তাকে দেখে নেয়ার কথাও বলেন। এর কিছুদিন পরেই ২০০৪ সালের ১৫ জানুয়ারি খুলনা প্রেসক্লাবের সামনেই তাকে বোমা মেরে হত্যা করা হয়। হত্যাপরবর্তী বিভৎস সেই দৃশ্য গোটা জাতি দেখেছে। সারাদেশের সাংবাদিক সমাজ ফুঁসে উঠেছিলো জঘন্য এই হত্যাকা-ে।

খুব সঙ্গতকারণেই, চার দলীয় জোট সরকারের সময়ে তার হত্যা মামলা পরিণতি পায়নি। গতানুগতিক ধারায় কয়েকজন বাম-চরমপন্থীকে আসামি করে মামলাটি সাজানো হয়। কিন্তু সময়ের পরিক্রমায় মামলাটি আলোর বাইরে চলে গেছে। আজ পর্যন্ত জানা গেলোনা, ঠিক কারা কি উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য তাকে হত্যা করেছে। তার মৃত্যুর সাথে চিংড়ীঘের মালিকদের কেউ, নাকি জঙ্গি কোন গোষ্ঠী নাকি চরমপন্থী কেউ জড়িত, আজো জানা যায়নি। খুলনা প্রেসক্লাবের রাজনীতি না বরিশালের রামশীলে সংখ্যালঘু নির্যাতনের ঘটনা খুনের পিছনে জড়িত- কোন তদন্ত সংস্থা বলতে পারেনি। তার মৃত্যুর পর তখনকার বিরোধী দলীয় নেত্রী, বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিচারের আশ্বাস দিয়েছিলেন। দশ বছর পার হয়ে গেলো, কেউ কথা রাখেনি। কিন্তু ভুলে গেলে চলবে না, মানিক সাহার মৃত্যু শুধুমাত্র একজন মানিক সাহার মৃত্যু ছিলো না। গোটা দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের সাহসী সাংবাদিকতার মেরুদ- ভেঙ্গে দেয়াই ছিলো এই হত্যার আসল উদ্দেশ্য। সে ক্ষেত্রে ঘাতকেরা কিছুটা সফলও।

শুধু রিপোর্ট করা বা রাজনীতি করা নয়, খুলনায় প্রগতিশীল ধারার সাংস্কৃতিক আন্দোলন ও বস্তুনিষ্ঠ সাংবাদিকতার ধারা গড়ে তুলতেও মানিক সাহার অসাধারণ অবদান ছিলো। বৃহত্তর খুলনা অঞ্চলে শ্রমিকের অধিকার, নারীর অধিকার, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ছড়িয়ে দেয়ার ক্ষেত্রে তিনি অনন্য সাধারণ ভূমিকা পালন করেন। তিনি বেঁচে থাকতে সেটি মানুষ যতনা বুঝতো, তার চেয়ে অনেক বেশী এখন সবাই উপলব্ধি করে।

মানিকদার ব্যক্তিগত সম্পর্ক নিয়ে কিছুই লিখলাম না। আমার মত অসংখ্য সাংবাদিকের জন্ম মানিক সাহার হাতে। তিনি বলতেন, এদেশের গরীব-অসহায় মানুষ বিপদে পড়লে দৌড়ে যায় পুলিশের কাছে। কিন্তু সহায়তা খুব কমই পায়। আদালতে গেলে বছরের পর বছর মামলা ঝুলে থাকে। সে নিঃস্ব থেকে নিঃস্বতর হয়। রাজনীতিবিদের কাছে গেলে তাকে নিয়ে চলে রাজনীতি। তাহলে সে যাবে কোথায়? সে কেন এই দেশকে নিজের দেশ মনে করবে? মানিকদা বলতেন, সেখানেই সাংবাদিকের কাজ। সাংবাদিক কিছু করতে পারুক আর না পারুক, তার কষ্টের কথা সকলের সামনে তুলে ধরবে। অসহায় মানুষের পাশে দাড়ানোই সাংবাদিকতা। যেই মুহুর্তে তার অত্যাচারের, বঞ্চনার কাহিনী ছাপানো হয় সেই মুহুর্তেই সে বোধ করে, না আমি একা নই। আমার পাশেও কেউ আছে। আর এভাবেই সে রাষ্ট্রের সাথে একাত্মবোধ করে। অসহায়-গরীব-নির্যাতিতের পাশে দাড়িয়ে রাষ্ট্রের সংহতি রক্ষার এক মহান দায়িত্বপালনকারী মানিক সাহার ঘাতকদের বিচার হোক বা না হোক, আমরা যেনো তাকে ভুলে না যাই-১৫ জানুয়ারি শুধু এইটুকু মিনতি। মানিক সাহার স্ত্রী-সন্তানদেরও বোধহয় এর বেশী কিছু কামনা নেই আর। গত দেড় দশকে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে এক ডজনের বেশী সাংবাদিক হত্যার বিচারের দাবিটাও এ সুযোগে আরো একবার তুলে ধরতে চাই।

লেখক: বৈশাখী টেলিভিশনের প্রধান বার্তা সম্পাদক

বাংলাদেশ সময় ১০৩৭ ঘণ্টা, জানুয়ারি ১৫, ২০১৫

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।