ঢাকা, সোমবার, ১০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ২৩ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

জাতীয়

বাড়ি বাড়ি থেকে ডেকে পুলিশে চাকরি!

জাহিদুর রহমান, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১১৩৯ ঘণ্টা, জানুয়ারি ১০, ২০১৬
বাড়ি বাড়ি থেকে ডেকে পুলিশে চাকরি! ছবি : বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

ধামরাই (ঢাকা) থেকে ফিরে: মাইকিং করে চাকরি গ্রহণের আহবান! তাও আবার পুলিশে! কোন লেনদেন ছাড়া! অবিশ্বাস্য! অভাবনীয়! কিন্তু পুলিশে লোক নিয়োগে এমন কাণ্ডই এবার ঘটেছে ঢাকার ধামরাইতে।

বাড়ি বাড়ি থেকে ডেকে চাকরি দেয়া হয়েছে সমাজের প্রকৃত অবহেলিত ও দু:স্থ পরিবারের ‘যোগ্য’ সন্তানদের।



না। কোন রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় নয়। বরং রাজনীতিকে আড়ালে রেখে। নিয়োগ বাণিজ্য ছাড়াই। আকাশের চাঁদ হাতে পাবার মতো চাকরি পেয়ে গেছে ধামরাইয়ের অর্ধশতাধিক পরিবার। গোটা কার্যক্রমটিই পরিচালিত হয়েছে জেলা পুলিশ সুপার হাবিবুর রহমানের তত্ত্বাবধানে। ধামরাই থানার ওসি মোহাম্মদ রিজাউল হকের প্রত্যক্ষ তদারকিকে।

অথচ মোটা অংকের অর্থের বিনিময়ে পুলিশে চাকরি নেয়ার অজস্র অভিযোগের সাক্ষী এই ধামরাই। অন্য জেলার লোক হয়েও স্থায়ী বাসিন্দা সেজে ধামরাইয়ের কোটায় নিয়োগ, পুলিশ কনস্টেবল পদে যোগ দিতে মোটা অংকের অর্থের বিনিময়ে নিয়োগ বাণিজ্যের সেই ক্ষত এখনো শুকোয়নি ধামরাইতে।

সেই ধামরাইতে কি করে বাড়ি থেকে ডেকে ডেকে অর্থ ছাড়া চাকরি হয় পুলিশে?

এই উত্তরের খোঁজে ধামরাই থানায় গিয়েই দেখা গেলো ভিন্ন চিত্র।

থানা আর থানা নেই। মানসিকতায় যেমন, তেমনি বহিরাঙ্গনেও বদলে গেছে ধামরাই থানা। বাইরে ফুলের বাগান। তার মাঝে নির্মিত হচ্ছে উন্নতমানের আর আধুনিকতার মিশেলে ‘গোল ঘর’। ভেতরের চিত্রটাও অচেনা। বদলে যাওয়া থানার ভেতর আর বাইরের চিত্রটাই জানান দেয়, কিছু একটা ঘটে গেছে এখানে। এবার বদলে যাওয়ার বিপ্লবের সূচনার স্বাক্ষী হতে চায় ধামরাই। টাকার বিনিময়ে পুলিশে নিয়োগ বাণিজ্যের কলঙ্ক মোচনের জন্যে যেন খোলনলচে বদলে নিচ্ছে ধামরাই থানা।

ভেতরে ঢুকতেই চোখে পড়ে বড় বড় অক্ষরে লেখা ‘সেবাই পুলিশের ধর্ম’। এই ধর্ম আগেও ছিলো। তবে সেই ধর্মের নামে অর্ধমই এতদিন দেখেছে ধামরাই। যার ব্যতিক্রমের শুরুটাও যেন এখানেই।

অফিসার ইন চার্জ (ওসি) মোহাম্মদ রিজাউল হকের কক্ষে ঢুকে ভিমড়ি খেতে হয়। একি থানা! নাকি কোন অভিজাত ব্যক্তির বৈঠকখানা। চারদিকে আপনা আপনিই চোখ ঘুরে যায়। অপূর্ব আর নান্দনিকতার ছোঁয়া সর্বত্র। রুচিশীল ইন্টেরিয়র আর আভিজাত্যের সমন্বয়ে বদলে গেছে থানার চেহারা। থানার সামনে পেছনে লেগেছে পরিবর্তনের ছোঁয়া। নোংরা ড্রেনের উপচে পড়া আর্বজনা আর বমি টেনে আনা উৎকট দুর্গন্ধের বদলে সেখানে ফুলের সৌরভ। সেখানেই চোখ আটকে যায় সুসজ্জিত করে সাজানো পুলিশ সদস্যদের পরিচ্ছন্ন ডাইনিং রুমে।

ওসির কক্ষে প্রবেশের আগে লেখা –‘ IF YOU R NOT SATISFIED TELL ME, IF YOU ARE SATISFIED TELL OTHERS’

বিনে পয়সায় ডেকে ডেকে বাড়ি থেকে পুলিশে চাকরি দিয়ে কি অতীত কেলেঙ্কারী থেকে মুক্ত হতে চাইছে পুলিশ?

ধামরাই থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোহাম্মদ রিজাউল হক বলেন, ‘যেভাবে খুশি। আপনি মূল্যায়ণ করতে পারেন। তবে পুলিশ সুপারের নির্দেশ একটিই। বদলে ফেলতে হবে নিজেদের নেতিবাচক ইমেজ। সূচনা করতে হবে গণমুখি পুলিশিং কার্যক্রম। সেটিই এখন দেখবে ধামরাই। দায়িত্ব নেবার পর আমি এই বার্তাই বয়ে চলছি থানার সর্বত্র’।

‘পুলিশ সুপার হাবিবুর রহমান স্যারের নির্দেশে আমরা গোটা এলাকায় মাইকিং করেছি। বাড়ি বাড়ি থেকে ডেকে এনেছি প্রকৃত যোগ্যদের। অনেকের ধারণা ছিলো- টাকা ছাড়া আবার পুলিশে চাকরি হয় নাকি? টাকা নেই বলে আবেদনও করতো না ওরা। প্রত্যন্ত গ্রামে গ্রামে গিয়ে আমরা তুলে এনেছি প্রকৃত দু:স্থ ও অবহেলিত পরিবারের ৫৪ জনকে। সেসব পরিবারের কাছে যা ছিলো এক কথায় অকল্পনীয়’ –পরিবর্তনের গল্পটা বলে যান ওসি।

মোহাম্মদ রিজাউল হক। গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়া গ্রামের বাসিন্দা। বাবা মরহুম শেখ ইকরামুল হক। বঙ্গবন্ধু, প্রধানমন্ত্রীর গ্রামের লোক। কিন্তু হাবভাবে নেই তার নূন্যতম প্রকাশ। আছে বিনয় আর পেশাদারিত্ব।

এর আগেও মানিকগঞ্জ সদর, সাটুরিয়া, গাজীপুরের টঙ্গী, মুন্সীগঞ্জ জেলার লৌহজং থানায় সফলভাবে দায়িত্ব পালন করেছেন ২০০০ ব্যাচের আউটসাইড এই ক্যাডেট।

নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁও থানায় পাখিদের জন্যে বাসা বানিয়েও প্রকৃতি প্রেমীদের প্রশংসা কুড়িয়েছেন এই পুলিশ কর্মকর্তা।

আমি যেখানেই যাই পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতার বিষয়ে গুরুত্ব দেই সবার আগে। কারণ পরিচ্ছন্ন আর পরিপাটি থাকার বিষয়টি কিন্তু টাকার ওপর নয়- নির্ভর করে মানসিকতার ওপর। আর পরিচ্ছন্নতা ঈমানেরও অঙ্গ। সেবা গ্রহিতাদের কেউ প্রথমে এ বিষয়টি দেখলে তার কাছে এখানকার পরিবেশ সম্পর্কে ইতবাচক ধারণা হয়।

থানার চারদিকে ফুলের বাগান। এখানে কিন্তু কেউ সিগারেট খায় না। পানের পিক ফেলে না। চকলেট খেলেও খোসাটা পকেটে করে নিয়ে যায়। সুবিধেমতো ফেলে দেয় আর্বজনার নির্ধারিত স্থানে। আসলে এই শিক্ষাটার শুরুটাই করা দরকার ঘর থেকে।

বদলে দেয়া পরিবেশের জন্যে মানসিকতার পাশাপাশি তো টাকাও প্রয়োজন। সেটারইবা যোগান আসে কোত্থেকে?

পুলিশ সুপার হাবিবুর রহমান স্যার খরচের একটি অংশ দিয়েছেন। অবশিষ্ট টাকা  আমি ও আমার থানার কর্মকর্তারা মামলার তদন্ত ব্যয় থেকে সাশ্রয় করে এখানে দিয়েছি। বলতে গেলে সবাই হেল্প করেছে। আর এভাবে গোছাতে খুব বেশি টাকার প্রয়োজন হয় না। মানসিকতার পরিবর্তনটাই জরুরি বলে মন্তব্য করেন তিনি।

‘সবাই তো এক পরিবার থেকে আসে না। আমাকে দেখে অনেকে শিখছে। আবার আমিও শিখছি অনেককে দেখে। আপনি কেমন সেবা দিতে চান তা মানুষ অনুসরণ করে। মূল্যায়ন করবে। যোগ করেন এই কর্মকর্তা।

সেবার মানে আগের সঙ্গে পার্থক্যগুলো কি?

আগে থানায় আসতো মানুষ দালাল ধরে। এখন দালাল মুক্ত। আমি বিভিন্ন স্থানে গিয়ে বলেছি, থানায় জিডি বা মামলা করতে কোন পয়সা লাগে না। মসজিদ, মন্দির সকল স্থানেই উদ্বুদ্ধ করেছি মানুষকে। এখন টাউট বাটপাড় বা নেতাকর্মী ধরে থানায় আসার চল বলতে গেলে বন্ধ হয়ে গেছে। কমে গেছে এসব মাধ্যমে থানায় এসে অর্থ খরচ আর প্রতারণাও। এখানে কাউন্টার মামলা নেয়া হয় না। কমে গেছে মামলার সংখ্যা। যার কারণে দিন দিন উন্নত হচ্ছে এলাকার আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতি।

আমরা প্রতিটি ইউনিয়নের চৌকিদার, দফাদারদের নিয়ে নিয়মিত বৈঠক করি। অবহেলিত এই মানুষদের জন্যে সাধ্যমতো কিছু করার চেষ্টা করি। পুলিশ সুপার মহোদয় ইতোমধ্যে তাদের মাঝে শীতবস্ত্র বিতরণ করেছেন। বিভিন্ন ফান্ডের অর্থ দিয়ে উৎসব, পার্বণে তাদের হাতে আমরা উপহার তুলে দিই। তাদের মুখে হাসি ফোটাই। তারাও তো মানুষ। আমরা তাদের বিশেষ মর্যাদা দিই। মাসের অন্তত দুটি দিন আমরা তাদের নিয়ে ভালোমন্দ খাই। এই রেওয়াজটাও কিন্তু পুলিশ সুপার স্যারের নির্দেশে চালু হয়েছে এখানে।

আরেকটি নতুন বিষয় আমরা চালু করেছি এই থানায়। যেটার নাম ‘ফোন পুলিশিং’।

প্রতিদিন রাতে এলাকার গণমান্য  ১০ থেকে ১৫ জনকে ফোন দিই। প্রথমে জানতে চাই তাদের কথা। কেমন আছেন তারা। খোঁজ খবর কি? পুলিশের সেবার মানে কোন অসঙ্গতি আছে কি’না, কিংবা পরামর্শ সবাই জানতে চাওয়া হয় ফোন করে।

মানুষ আগে ফোন পেয়ে অবাক হতো। এখন স্বত:স্ফূর্তভাবে পুলিশের সঙ্গে খোলাখুলি মনে সবকিছু বিনিময় করতে পারছে।

এই আইডিয়াটাও কিন্তু পুলিশ সুপার মহোদয়ের। তাঁর লক্ষ্যই হচ্ছে গণমুখি পুলিশিং সেবা নিশ্চিত করা।

রাতে আমরা ব্যাংকসহ বিভিন্ন শিল্প কারখানা এমনকি বিপণীবিতানের নিরাপত্তা রক্ষী বা সিকিউরিটি গার্ডকে ফোন দিই। তিনবার ফোন দেবার পরও যদি ফোন রিসিভ না করে বা সাড়া পাওয়া না যায় তাহলে সেখানে পৌঁছে যায় আমাদের পুলিশ ফোর্স। দেখা যায় দায়িত্ব পালনের বদলে সে ঘুমুচ্ছে।

পরদিন সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানকে আমরা লিখিতভাবে রিপোর্ট করি যে তার নিয়োজিত লোক ঠিকমতো দায়িত্ব পালন করছে না।

এভাবে আমরা যদি সবাই যার যার কাজ সঠিক ভাবে ও সময়মতো করি তাহলে এদেশ বদলে যেতে বাধ্য। যার সূচনা আমরা নিজের ঘর অর্থাৎ থানা থেকেই চালু করেছি। যোগ করেন দুই কন্যা সন্তানের জনক এই পুলিশ কর্মকর্তা।

বাংলাদেশ সময়: ১১২৮ ঘণ্টা, জানুয়ারি ১০, ২০১

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।