দেখতে কুমিরের মতো, কিন্তু স্বভাব-চরিত্রে ঠিক কুমির না। ইয়া লম্বা চ্যাপ্টা মুখ, আপাতদৃষ্টিতে হিংস্র কিন্তু আসলে নিরীহ এক সরীসৃপ।
ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন ফর কনজারভেশন অব ন্যাচারের (আইইউসিএন) মহাবিপদাপন্ন প্রাণীর তালিকায় যার নাম লেখা আছে লাল হরফে। এক সময় ধারণা করা হতো ঘড়িয়াল বুঝি একেবারেই হারিয়ে গেছে বাংলাদেশ থেকে। কিন্তু সত্য হচ্ছে প্রাকৃতিক পরিবেশে খুব সীমিত সংখ্যক ঘড়িয়াল এখনও বাংলার নদীগুলোতে টিকে আছে। এখন তাদের প্রয়োজন টিকে থাকার জন্য অনুকূল পরিবেশ।
এটি এক দিক দিয়ে যেমন সত্য, তেমনি আরেকটি সত্য হচ্ছে প্রাকৃতিক পরিবেশে ঘড়িয়ালকে ফিরিয়ে আনতে শুরু হয়েছে প্রচেষ্টাও। প্রাকৃতিকভাবে ঘড়িয়ালের বিপদাপন্ন হওয়ার পেছনে অনেকগুলো কারণ রয়েছে। বেপরোয়া মৎস্য আহরণের কারণে পরোক্ষভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে ঘড়িয়ালও। কারেন্ট জালের ব্যবহার এর অন্যতম কারণ।
আইইউসিএনের উদ্যোগে বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে ঘড়িয়াল রক্ষা ও এর প্রজননে ইতোমধ্যেই কাজ শুরু হয়েছে। এই পুরো কাজের সমন্বয় করছেন বণ্যপ্রাণী গবেষক সীমান্ত দীপু। ‘প্রাকৃতিক পরিবেশে ঘড়িয়ালকে এখনও ফিরিয়ে আনা সম্ভব। আমাদের কাজের আওতায় আমরা ইতোমধ্যেই একটি কর্মপরিকল্পনা প্রণয়ন করেছি। প্রথম পর্যায়ে এখন দেশের নদ-নদীগুলোতে কত সংখ্যক ঘড়িয়াল আছে সরেজমিন অনুসন্ধান করে তার একটি পরিসংখ্যান আমরা বের করেছি। ইতোমধ্যে দেশের পাঁচটি এলাকায় ঘড়িয়াল থাকার প্রত্যক্ষ প্রমাণ পেয়েছি। এগুলো হলো- চাপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জ, রাজশাহীর পবা, গোদাগাড়ী, যমুনা নদীর চর উত্তর কোন্নাবাড়ি ও চর খিজিরপুর।
শেষ ছয় বছরে প্রতি বছর দশটি করে বাচ্চা ঘরিয়াল পাওয়া গেছে। এছাড়া প্রাপ্তবয়স্ক বেশ কয়েকটি ঘড়িয়াল আছে। আমাদের জরিপের কাজ ইতোমধ্যেই শেষ হয়েছে। বলছিলেন সীমান্ত দীপু।
এ কাজের সঙ্গে পরামর্শক হিসেবে প্রত্যক্ষভাবে যুক্ত ছিলেন বন্যপ্রাণী গবেষক ও আলোকচিত্রী তারেক অনু।
‘মাঠ পর্যায়ে কাজ করতে গিয়ে আমরা মৎস্যজীবীসহ নদীর উপর নির্ভরশীল অনেক মানুষকে পেয়েছি, যারা সাম্প্রতিককালে ঘড়িয়াল দেখেছেন। তার মানে ঘড়িয়াল এখনও হারায়নি। মানুষের যাতায়াত কম, সূর্যের আলো পাওয়া যায় এমন চরগুলোর আশপাশে ঘড়িয়াল আছে। রাজশাহীর চারঘাটে এক নৌকার মাঝিকে আমরা পেয়েছিলাম যিনি বেশ কিছু ঘড়িয়াল দেখেছেন। ’
ঘড়িয়াল রোদের মাঝে নদীর চরের বালিতে ঘণ্টার পর ঘণ্টা শুয়ে থাকে। পদ্মা যমুনায় এ ধরনের জায়গার অভাব নেই। কিন্তু মানুষের আনাগোনা বেড়ে যাওয়ায় বাড়ছে আশঙ্কাও। সীমান্ত দীপু বলেন, ইতোমধ্যে পরিসংখ্যানের পাশাপাশি কোন পরিবেশে ঘড়িয়াল বেঁচে আছে তার একটি সম্যক ধারণা আমরা পেয়েছি। দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনার আওতায় আমরা এখন ঘড়িয়ালের কৃত্রিম প্রজননের কার্যক্রম হাতে নিতে যাচ্ছি। এদেশের বেশ কয়েকটি চিরিয়াখানা ও সাফারি পার্কে ঘড়িয়াল আছে। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে এসব জায়গায় যেসব ঘড়িয়াল আছে তার প্রত্যকটিতে সমলিঙ্গের ঘড়িয়াল। অর্থাৎ, পুরুষের সাথে পুরুষ ও মেয়ের সঙ্গে মেয়ে ঘড়িয়াল। যা প্রজনেনের পথে বড় বাধা।
আমরা এখন এসব জায়গায় বিপরীত লিঙ্গের ঘড়িয়াল একসঙ্গে রাখার পরিকল্পনা করছি। এ পথে আবার বড় বাধা সরকারি লাল ফিতের দৌরাত্ম্য। তবে রাজশাহী চিড়িয়াখানায় এ ব্যাপারে কাজ শুরু হয়েছে। কৃত্রিম প্রজননে সফল হলে এদের বংশবৃদ্ধি করে প্রাকৃতিক পরিবেশে ছেড়ে দেওয়ার পরিকল্পনা আছে।
তবে এখানেও আছে সমস্যা। প্রাকৃতিক সেই বাসস্থানগুলোও এখন বিপদাপন্ন। এখানে জরুরি সরকারি সাহায্যের। উপরে উল্লেখিত পাঁচটি জায়গাকে ঘড়িয়ালের জন্য হটস্পট বা অভয়ারণ্য ঘোষণা করতে হবে। এছাড়া এসব এলাকার নদী ও মৎস্যজীবী মানুষকে বিকল্প কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করাটাও জরুরি।
নদী তীরবর্তী এলাকায় সচেতনতা কার্যক্রম নেওয়া হয়েছে। সেসব এলাকার স্কুলগুলোতে ঘড়িয়াল রক্ষার ব্যাপারে কার্যক্রম চালানো হয়েছে। প্রাকৃতিক পরিবেশে বিশ্বে এখন মাত্র দুইশো ঘড়িয়াল টিকে আছে। যদিও ভারতে সফলভাবে কৃত্রিম প্রজননের মাধ্যমে ঘড়িয়ালের বংশবৃদ্ধি ঘটানো হয়েছে। প্রকৃতির খাদ্যশৃঙ্খল রক্ষায় ঘড়িয়ালের প্রয়োজন আছে।
আশ বিহীন মাছ, বিশেষ করে বোয়াল, আইড়ের মতো রাক্ষুসে মাছ ঘড়িয়ালের প্রধান খাদ্য। বাংলাদেশের নদীতে বিশেষ করে পদ্মা-যমুনা অববাহিকার প্রাকৃতিক পরিবেশে ঘড়িয়ালকে এখনও ফিরিয়ে আনা সম্ভব। এ ব্যাপারে বেসরকারিভাবে কাজ তো চলছেই। এখন সরকারের সাহায্য বিশেষভাবে প্রয়োজন। কৃত্রিম প্রজনন থেকে শুরু করে অভয়ারণ্য ঘোষণা- সবখানে সরকারি সাহায্যের প্রয়োজন। সংশ্লিষ্ট বিভাগ ও মন্ত্রণালয়ের সদিচ্ছার উপরই নিভর করছে বাংলার নদী-নালায় ঘড়িয়াল ফিরে আসার বিষয়টি।
ঘড়িয়াল ৫০ থেকে ৬০ বছর বাঁচে। প্রায় ২০০০ মিলিয়ন বছর ধরে ঘড়িয়াল পৃথিবীতে বেঁচে আছে। পুরুষ ঘড়িয়ালের ওপরের চোয়ালে, নাকের ঠিক ওপরে, কলস বা ঘড়া আকৃতির একটি পিণ্ড থাকে। এ কারণেই সম্ভবত ঘড়িয়াল নাম। বর্তমানে পৃথিবীতে মাত্র ২০০ বুনো ঘরিয়াল রয়েছে। যার সবগুলোই বাংলাদেশ, ভারত, নেপালের নদীগুলোতে। এদের সবচেয়ে পছন্দ বালুচরে ঘণ্টার পর ঘণ্টা রোদ পোহানো। এরা মানুষের কোনো ক্ষতি করে না। বরং রাক্ষুসে মাছ খেয়ে ঘড়িয়াল প্রাকৃতিক খাদ্য শৃঙ্খল ঠিক রাখে।
বাংলাদেশ সময়: ০৮১৭ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ২৯, ২০১৬
এএ