ঢাকা, মঙ্গলবার, ১০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৬ নভেম্বর ২০২৪, ২৪ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

জাতীয়

 ‘ছেলে-মেয়ে নিয়ে গেলাম, সবাই ভালো থাকো’

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৭২৮ ঘণ্টা, জানুয়ারি ১০, ২০১৭
 ‘ছেলে-মেয়ে নিয়ে গেলাম, সবাই ভালো থাকো’

ঢাকা: ‘ছেলে মেয়ে নিয়ে গেলাম, সবাই ভালো থাকো। মা আমি, এই দুই হাত দিয়ে ওদের খাওয়াইছি, তেল দিছি, আজ সেই হাত দিয়েই আমি আমার সন্তানদের মারলাম। তোমরা আমাকে মাপ করে দিও।’

‘কপালে এই ছিল, ওরা দুইজন (সন্তান) নিষ্পাপ। আমার মৃত্যুর জন্য কেউ দায়ী নয়।

’ 

দুই সন্তানকে হত্যার পর আত্মহত্যা করার আগে মা একটি সুইসাইড নোট লিখে গেছেন। ঘটনাস্থল থেকে মা আনিকার লেখা ওই সুইসাইড নোটটি উদ্ধার করেছে পুলিশ।

ওই সুইসাইড নোটে লেখা আছে, ‘শামীম তোমার একটা ভুলের জন্য এত বড় ঘটনা। তুমি ভেবেছো আমি, শুধুই শুনবো, না, তুমি সবার কথা ভাবো আমাদের কথা ভাবো না। সবাইকে ছেড়ে, এই পৃথিবীকে ছেড়ে চলে যাচ্ছি। ’

রাজধানীর দারুস সালাম থানার ছোট দিয়াবাড়ি এলাকার ২৯/১ এর টিনশেড বাড়ির একটি ঘরে মেয়ে শামীমা (৫) ও ছেলে আব্দুল্লাহকে (২) হত্যার পর আত্মহত্যা করেন মা আনিকা (২০)। মঙ্গলবার (১০ জানুয়ারি) বিকেলে এ মর্মান্তিক ঘটনা ঘটে।
 
দারুস সালাম থানার (ওসি–তদন্ত) ফারুক উল আলম বাংলানিউজকে বিষয়টি জানিয়েছেন।  

তিনি বলেন, দুই সন্তানকে হত্যার পর মায়ের আত্মহত্যার ঘটনায় ঘরের ভেতর থেকে একটি সুইসাইড নোট পাওয়া গেছে। সেখানে তার মৃত্যুর জন্য কাউকে দায়ী করেননি আনিকা।
 
দারুস সালামের ছোট ডিয়াবাড়ি এলাকায় সাইদ মাস্টার বাড়িতে থাকতেন আনিকা ও শামীমসহ তাদের দুই সন্তান। দেড় বছর ধরে ওই বাড়িতে ২ হাজার তিন’শ টাকায় একটি রুম ভাড়া নিয়ে বসবাস করছিলেন এই দম্পতি।
 
শামীম-আনিকা দম্পতির দুই সন্তান। ৫ বছর বয়সী মেয়ে শামীমা ও দুই বছর বয়সী ছেলে আব্দুল্লাহকে নিয়ে ভালোই চলছিলো তাদের জীবন।
 
শামীমের নিজের একটি সেলুন আছে। আর স্ত্রী আনিকা ছিলেন গৃহিনী। দুই সন্তানকে নিয়েই সারাদিন কাটতো তার। সকালে উঠে রান্না কর‍া, সন্তানদের খাওয়ানো, প্রতিবেশীদের সঙ্গে গল্প করা, দুপুরের রান্না, আর সন্ধ্যার পর বাসের ঘরে একটু টিভি দেখা আর এর সঙ্গে নিজের সন্তানদের প্রতি যত্ন।
 
প্রতিদিনের মতো মঙ্গলবার (১০ জানুয়ারি) সকাল ৮টায় ঘুম থেকে উঠে স্বামী ও সন্তানদের জন্য নাস্তা তৈরি করেন তিনি। তারপর আনিকাকে আর ঘরের বাইরে দেখা যায়নি।
 
বেলা গড়িয়ে এলেও যখন ঘরের দরজা খুলছে না, ঠিক তখন পাশের ঘরের সদস্যরা তার ঘরের দরজায় নক করে কোনো সাড়া না পেয়ে বাড়ির ম্যানেজার মো. লিটনকে বিষয়টি জানায়।
 
ম্যানেজার লিটন দ্রুত বাস‍ায় এসে ঘরের বাইরের পাশের জানালা খুলে দেখে ঘরের সিলিং ফ্যানের সঙ্গে ঝুলে আছে আনিকা। এদিকে, চকিতে (বিছানায়) পড়ে আছে তার দুই সন্তান মেয়ে শামীমা ও ছেলে আব্দুল্লাহ।
   
মাস্টার বাড়ির ম্যানেজার মো. লিটন বাংলানিউজকে জানান, নিহত আনিকার বাড়ি নওগাঁ আর তার স্বামী শামীমের বাড়ি রাজবাড়ী জেলায়। শামীম একটি সেলুন চালায়। ওরা খুব সাদাসিধে জীবন যাপন করছিলেন। এরই মধ্যে তাদের ৫ মাসের বাড়ি ভাড়া বকেয়ো পড়ে। কিন্তু এর জন্য আমাদের মালিক কোনো চাপ দেয়নি। বরং মালিক শামীমের সুবিধা অনুযায়ী প্রতি সপ্তাহে ৫শ টাকা করে পরিশোধ কর‍ার জন্য বলেন।
 
তিনি ঘটনার বিষয়ে বলেন, জানালা দিয়ে তাকিয়ে দেখি সিলিং ফ্যানের সঙ্গে ওড়নার কাপড় দিয়ে গলায় ফাঁস দেওয়া আর সন্তান দুটি বিছানায় শোয়ানো, গায়ের অর্ধেক অংশ কাপড় দিয়ে ঢাকা।
 
তবে শুনেছি, সকালে আনিকার স্বামী নাশতা না খেয়েই বাসা থেকে বের হয়েছে। শামীম সেলুনে গিয়ে ওর বন্ধুদের সঙ্গে তেমন কথাও বলেনি।
 
ওই বাড়িতে আনিকার পাশের ঘরে থাকেন আঞ্জুয়ারা। তিনি একটি মার্কেটে কাজ করেন। তিনি বাংলানিউজকে জানান, আনিকা ও শামীম দুইজনই খুব ভালো ছিল। এখানে অনেকদিন ধরে তারা বসবাস করছেন। কিন্তু কারও সঙ্গে কোনো খাবাপ ব্যবহার করতে দেখি নি বা শুনিও নি।
 
মাঝে মাঝে আমার ঘরে সন্ধ্যার পর এসে একটু টিভি দেখতো। সারাদিন সন্তানদের নিয়ে আর রান্না করেই তার সময় কাটতো।  আমাদের সঙ্গে সব সময় হাসি মুখেই কথা বলতো।
দাম্পত্য জীবনে তাদের কোনো কলহ ছিল কিনা জানতে চাইলে এই প্রতিবেশী আঞ্জুয়ারাসহ অন্যরা বাংলানিউজকে জানান, ‘না তাদের দুইজনের মধ্যে কোনো কলহ ছিল না। ত‍াদের ছেলে মেয়েগুলোও অনেক ভালো ছিল। দেখলে খালি আদর করতে মনে চাইতো। ’
 
‘কিন্তু এমন কাজ কেন করলো তা জানি না। ’
 
ঘটনাস্থলের বর্ণনা:
দারুসসালামের ছোট ডিয়াবাড়ি ২৯/১ এর সাইদ মাস্টারের বাড়িতে ২৯ টি ঘরের মধ্যে ৫টি ঘর খালি, ভাড়াটিয়া নাই। বাকি সবগুলোতে আছে। ওই মাস্টার বাড়ির প্রবেশ ফটকের সঙ্গে থাকা ঘরটিতে থাকেন আনিকা-শামীম দম্পতি ও তাদের দুই সন্তান। ঘরের সঙ্গেই একটি রান্নাঘর আছে। ভেতরে রয়েছে একটি চকি (খাট), আর ছোট একটি মিরসেলফ। দেয়ালে তাকের (কার্নিশ) উপর রয়েছে কিছু ডিওবা ও টিনের বাক্স। এদিকে দেয়ালে দড়িতে ঝুলানো রয়েছে তাদের কাপড়গুলো। একটি বালিশ মাটিতে পড়ে আছে। আর দেওয়ালে রয়েছে রক্তের দাগ।  
 
দারুসসালাম জোনের সহকারী কমিশনার (এসি) মামুনুর রশিদ বাংলানিউজকে বলেন, পারিপারিক কোনো কলহ আছে কিনা সে বিষয়টি সামনে রেখে আমরা এই ঘটনার তদন্ত শুরু করবো।
  
ঘটনাস্থল থেকে একটি বটি ও নিহত আনিকার গলায় পেঁচানো ওড়নাটি আলামত হিসেবে উদ্ধার করা হয়েছে। কেন এমন হয়েছে তা পরিষ্কার বলা যাচ্ছে না। তার স্বামী শামীমের সঙ্গে যোগাযোগ করা হচ্ছে। তার সঙ্গে কথা বলতে পারলে কারণ জানা যাবে।
 
 বাংলাদেশ সময়: ২৩১৯ ঘণ্টা, জানুয়ারি ১০, ২০১৭
এসজেএ/পিসি
 
 

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।