ঢাকা, মঙ্গলবার, ১০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৬ নভেম্বর ২০২৪, ২৪ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

জাতীয়

সেই বহিষ্কৃত কূটনীতিক হ্যান সন ইক ফায়ারিং স্কোয়াডে!

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০১২১ ঘণ্টা, জানুয়ারি ১১, ২০১৭
সেই বহিষ্কৃত কূটনীতিক হ্যান সন ইক ফায়ারিং স্কোয়াডে! উত্তর কোরিয়া

ঢাকা: কূটনৈতিক পাড়ায় ফের আলোচনায় উত্তর কোরিয়ার বহিষ্কৃত কূটনীতিক হ্যান সন ইক। সিগারেট ও বৈদ্যুতিক সামগ্রীর পর ‘ভূতের গাড়ি’ বলে পরিচিত বিলাসবহুল ২০১৫ সালের রোল রয়েলসের ঘোস্ট মডেলের গাড়ি এনে ধরা পড়া সেই কূটনীতিক নিজ দেশে কেমন আছেন? 

সে প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে বের হয়ে এসেছে চাঞ্চল্যকর তথ্য।

ভিয়েনা কনভেনশন অনুসারে কূটনৈতিক সুবিধায় বাংলাদেশে বিচার এড়ালেও  উত্তর কোরিয়ার সুনাম নষ্ট করার অভিযোগ কিম জং উনের দেশে ফায়ারিং স্কোয়াডে প্রাণ দিতে হয়েছে বহিষ্কৃত এ কূটনীতিককে-  এমনটাই জানাচ্ছেন সংশ্লিষ্টরা।

 

কূটনৈতিক মহল ছাপিয়ে এ খবর পৌঁছেছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) সংশ্লিষ্ট সরকারের নীতি নির্ধারণী মহলে।

আর এ খবরটিই এখন টক অব দ্য টাউন।

সরকারের ঊর্ধ্বতন মহল এবং এনবিআরের নীতি নির্ধারণী পর্যায়ের দুজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বাংলানিউজকে বলেন, ‘আমাদের কাছে দীর্ঘদিন ধরেই খাতা-কলমে নাম ভেসে বেড়াচ্ছিলো উত্তর কোরিয়ার বহিষ্কৃত কূটনীতিক হ্যান সন ইকের। বিশেষ করে বহিষ্কৃত হওয়া সত্ত্বেও তার অপরাধের খতিয়ান ক্রমশ দীর্ঘ হওয়ায় কূটনৈতিক সূত্রে আমরা তার সর্বশেষ অবস্থান সম্পর্কে জানার চেষ্টা করি। তবে বিভিন্ন সূত্র থেকে আমরা এটা জানতে পেরেছি যে, নিজের দেশের ভাবমূর্তি বহির্বিশ্বে ভূলুণ্ঠিত করাসহ নানা অপরাধে প্রেসিডেন্ট কিম জং উনের নির্দেশেই তাকে ফায়ারিং স্কোয়াডে নিয়ে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছে’।  

‘তবে এটির এখন পর্যন্ত  প্রামাণিক কোনো দলিল আমাদের হাতে আসেনি’– যোগ করেন রাজস্ব বোর্ডের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা।

 সোমবার (০৯ জানুয়ারি) রাজধানীর কমলাপুর আইসিডি বন্দর থেকে উত্তর কোরিয়ার কূটনীতিক হ্যান সন ইকের নামে মিথ্যা ঘোষণায় আনা দামি রোলস রয়েস ঘোস্ট মডেলের গাড়িটি আটক করেন শুল্ক গোয়েন্দারা।  

শুল্ক গোয়েন্দা অধিদফতরের মহাপরিচালক ড. মইনুল ইসলাম খান বাংলানিউজকে জানান, গত বছরের ০২ আগস্ট শুল্ক কর্মকর্তারা গোপন সংবাদের ভিত্তিতে কমলাপুরের অভ্যন্তরীণ কন্টেইনার ডিপোতে (আইসিডি) তল্লাশি চালিয়ে উত্তর কোরিয়া দূতাবাসের সে সময়ের প্রথম সচিব হ্যান সন ইকের নামে আনা সাড়ে তিন কোটি টাকা মূল্যের সিগারেট ও বৈদ্যুতিক সরঞ্জাম আটক করেন।

যথাযথ প্রক্রিয়া লঙ্ঘন করে ওই পণ্য আনার অভিযোগে উত্তর কোরিয়ার ওই কূটনীতিকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সচিব শহীদুল হককে প্রস্তাব দেয় জাতীয় রাজস্ব বোর্ড। এর প্রেক্ষিত গত বছরের ০৮ আগস্ট বহিষ্কার করা হলে বাংলাদেশ ছেড়ে যান হ্যান সন ইক।

শুল্ক গোয়েন্দা অধিদফতরের মহাপরিচালক ড. মইনুল ইসলাম খান আরো জানান, তিনি যে সময় মিথ্যা ঘোষণায় সিগারেট ও বৈদ্যুতিক সরঞ্জাম আনেন, ঠিক একই সময়ে ২০১৫ সালের সিলভার কালারের ঘোস্ট মডেলের গাড়িটি বাংলাদেশে আনার প্রক্রিয়াও সম্পন্ন করেন।
নির্মাতা প্রতিষ্ঠান রোলস রয়েলস বিমানে করে সিলভার কালারের ঘোস্ট মডেলের গাড়িটি সিঙ্গাপুরে পাঠিয়ে দেয়। সেখান থেকে জাহাজে করে বাংলাদেশে নিয়ে আসেন কূটনীতিক হ্যান সন ইক।

শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদফতরের জব্দ করা বিলাসবহুল গাড়িবিষয়টি  শুল্ক গোয়েন্দা অধিদফতরের নজরে এলে সতর্ক হয়ে যান হ্যান সন ইক। যেকোনো মুহূর্তে ধরা পড়ে যেতে পারেন- এ আশঙ্কায় তিনি গাড়িটি সিঙ্গাপুরে ফেরত পাঠানোর মিশনে নামেন। এ মর্মে শুল্ক ও গোয়েন্দা অধিদফতরের কর্মকর্তাদের বোঝাতে চেষ্টা করেন যে, তিনি যে গাড়িটি আনতে চেয়েছিলেন, সেটি না পাঠিয়ে ভুল করে অন্য গাড়ি পাঠানো হয়েছে।  

তবে কূটনৈতিক বিবেচনায় অধিকতর সর্তকতার সঙ্গে শুল্ক ও গোয়েন্দা অধিদফতর বিভিন্ন সূত্রে কান্ট্রি অব অরিজিন, চেসিস নম্বরসহ বিভিন্ন ডকুমেন্টের পর্যালোচনা ও অনুসন্ধান করে জানতে পারে, মিথ্যা ঘোষণা দিয়ে প্রভাবশালী কারো কাছে বিক্রির উদ্দেশ্যেই গাড়িটি এনেছেন তিনি।

কূটনৈতিক ক্ষমতার অপব্যবহার করে মিথ্যা ঘোষণায় সিগারেট ও বৈদ্যুতিক সরঞ্জাম আনার অভিযোগে বহিষ্কৃত হওয়ায় স্বাভাবিকভাবেই তার আনা কূটনৈতিক কনটেইনার বেশ সর্তকতার সঙ্গে কায়িক শ্রমের ভিত্তিতে যাচাইয়েরও উদ্যোগ নেয় শুল্ক ও গোয়েন্দা অধিদফতর।

শুল্ক গোয়েন্দা অধিদফতরের মহাপরিচালক ড. মইনুল ইসলাম খান জানান, দীর্ঘ নজরদারি ও সকলের উপস্থিতিতে ওই কূটনীতিকের আনা কন্টেইনারটি খুলে দেখা যায়, সেখানে ৬৬০০ সিসির রোল রয়েলস মডেলের বিলাসবহুল গাড়ি। যার অভ্যন্তরীণ সুযোগ-সুবিধা অনেকটা বোয়িং বিমানের মতো। যে মডেলের গাড়ি ব্রিটেনের রানিরও অনেক পছন্দের।

অথচ তিনি গাড়িটি এনেছিলেন বিএমডব্লিউ এক্স-৫ ঘোষণায়। কৌশলটি এমন ছিলো যে, সচরাচর গাড়ি আনলে কূটনীতিকরা বিএমডব্লিউ মডেলের গাড়িই আনেন। শুল্কমুক্ত আর কূটনৈতিক সুবিধায় আনা এ মডেলের গাড়িটির নাম কাগজ-কলমে থাকলেও কেউ সন্দেহ করতেন না। এমন ভাবনা থেকেই দামি বিলাসবহুল রোল রয়েলস মডেলের গাড়িটি নিয়ে আসেন ওই কূটনীতিক।

প্রথমত মিথ্যে ঘোষণার কারণে এমনিতেই বাজেয়াপ্ত হয়ে গেছে গাড়িটি। দ্বিতীয়ত গাড়িটির কোনো মালিকানা না থাকায় এখন সেটি সরাসরি সরকারের বাজেয়াপ্ত তালিকায় নাম লেখাবে।  

শুল্ককর প্রায় ২২ কোটি টাকা মিলিয়ে গাড়িটির আনুমানিক বাজার মূল্য ৩০ কোটি টাকারও বেশি বলেও জানান শুল্ক গোয়েন্দা ড. মইনুল।

গাড়িটির ভবিষ্যত কি? প্রশ্নের জবাবে ড. মইনুল বাংলানিউজকে জানান, এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেবে সরকার। তবে দামি এ গাড়িটি রাষ্ট্রের অনুকূলে বাজেয়াপ্ত করা হলে তা বিদেশি ভিভিআইপি অতিথিদের ব্যবহারে কাজে লাগানো যেতে পারে বলে ধারণা দেন তিনি।

‘আমাদের জালে এটি নিয়ে দ্বিতীয় রোল রয়েলস মডেলের গাড়ি ধরা পড়লো। আমরা নিশ্চিত, এ বিলাসবহুল গাড়ি আনার নেপথ্যে বাংলাদেশেরই কোনো না কোনো প্রভাবশালী রয়েছেন, যিনি এ গাড়ি চালাবেন। কিন্তু জেনেও আমরা তাকে ধরতে পারবো না, এমন ধরনের প্রভাবশালী। আমাদের টার্গেট এখন তিনি। যতো ক্ষমতাশালীই হোন না কেন, তাকে আমাদের জালে পড়তেই হবে’।  

‘মজার কথা হলো, তিনি যে টাকা বিনিয়োগ করেছেন, তা জলে গেছে। এখন আইনের আওতায় আসাটাই কেবল বাকি’।

এনবিআরের চেয়ারম্যান নজিবুর রহমান বাংলানিউজকে বলেন, ‘সরকারকে রাজস্ব বঞ্চিত করে শুল্ক ফাঁকি দেওয়ার দিন শেষ। তিনি কূটনীতিক হোন আর প্রভাবশালীই হোন, তাদের রক্ষা নেই’।

২০১৫ সালের মার্চে ২৭ কেজি স্বর্ণসহ উত্তর কোরিয়ার অপর কূটনীতিক সন ইয়ংকে হাতেনাতে ধরা হলেও হুশ ফেরেনি হ্যান সন ইকের। আর সর্বশেষ বহিষ্কৃত হওয়ার পর নিজ দেশে ফায়ারিং স্কোয়াডে তার মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের যে খবর আসছে বিভিন্ন মাধ্যমে, তাকেও এক ধরনের কড়া বার্তা বলেই মনে করছেন বাংলাদেশের শুল্ক গোয়েন্দারা।

বাংলাদেশ সময়: ০৭১৪ ঘণ্টা, জানুয়ারি ১১, ২০১৭
জেডআর/এএসআর

**উত্তর কোরিয়ার বহিষ্কৃত কূটনীতিকের ‘রোলস-রয়েস’ জব্দ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।