ঢাকা, বুধবার, ১২ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ নভেম্বর ২০২৪, ২৫ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

জাতীয়

দুই হাত হারানো রইসের জীবন সংগ্রাম

মহিউদ্দিন মাহমুদ, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১১৫৬ ঘণ্টা, জানুয়ারি ২৬, ২০১৮
দুই হাত হারানো রইসের জীবন সংগ্রাম সংগ্রামী রইস উদ্দিন/ছবি: বাংলানিউজ

ঢাকা: ব্যর্থতা, চাওয়া-পাওয়ার গরমিলে কিংবা শারিরিক পরিপূর্ণতার অভাবে যারা হতাশ হয়ে জীবনযুদ্ধে হার মেনে নিয়েছেন তাদের জন্য অনুপ্রেরণা ময়মনসিংহের নান্দাইল উপজেলার মোহাম্মদ রইস উদ্দিন। 

হাত নেই, কিন্তু ঠোঁটের কোনে হাসি লেগে আছে, মুখে নেই কোনো হতাশার চিহ্ন। দু’হাত হারিয়ে হেরে না গিয়ে প্রবল মনোবল নিয়ে ঘুরে দাঁড়িয়েছে রইস উদ্দিন।

হার না মানার শপথে ঘুরে দাঁড়ানোর সংগ্রামে নিজেকে যোদ্ধা হিসেবে তৈরি করছেন তিনি।

বৈদ্যুতিক শটসার্কিটে দু’টি হাত হারানো রইস উদ্দিনের ঘুরে দাঁড়ানোর সেই সাহসী গল্প বাংলানিউজের পাঠকদের জন্য তুলে ধরা হলো।

হাত ছাড়াই রইস উদ্দিন হকারি করে উপার্জন করছেন। তথ্য প্রযুক্তির এ যুগে বিশেষ কৌশলে তিনিও ব্যবহার করছেন মোবাইল ফোন।

ময়মনসিংহের নান্দাইল থানার মুসুলি ইউনিয়নে চরপাড়া গ্রামের বাসিন্দা রইস উদ্দিন।  তিনি বাংলানিউজকে জানান, ২০০৫ সালের ৮ জানুয়ারি মামার বাসায় টেলিভিশনের এন্টিনা লাগাতে গিয়ে বৈদ্যুতিক শর্টসার্কিটে গুরুতর আহত হন তিনি।
এরপর প্রথমে ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসা নেন। সেখান থেকে ঢাকা মেডিকেল কলেজের (ঢামেক) বার্ন ইউনিটে চিকিৎসার জন্য পাঠানো হয়। ঢামেকে চিকিৎসার সময় তার জীবন বাঁচাতে দু’টি হাত কেটে ফেলা হয়।

রইস উদ্দিন বলেন, ওই সময় সবাই মনে করেছিলেন আমি আর বাঁচবো না। কিন্তু সবার দোয়ায় এখনো বেঁচে আছি।

প্রাণে বেঁচে যাওয়া রইস উদ্দিন দীর্ঘ চিকিৎসার পর সুস্থ হয়ে যখন বাড়ি ফিরে যান তখন হতাশাই ছিলো তার একমাত্র সম্বল। মামার দোকানে বসে থাকতেন তিনিই মাঝে-মধ্যে হাত খরচের জন্য কিছু টাকা পয়সা দিতেন।  

বিষন্নতায় কাটতে থাকে রইস উদ্দিনের জীবন। বেশ কয়েক বছর এভাবে কাটান তিনি। সব সময় ভাবতেন জীবনে আর কোনো কাজই করতে পারবেন না। এভাবেই দুঃখ কষ্টে তার বাকি জীবন কাটাতে হবে। মামার দেয়া সামান্য হাত খরচ ছাড়া কোনো উপার্জন ছিলো না। পরিবারে কোনো অবদান রাখতে পারছিলেন না।

এই পরিস্থিতির মধ্যে ২০১৩ সালের ১৪ মার্চ বিয়েও করেন রইস উদ্দিন। ভেতরে লুকিয়ে থাকা লড়াকু মনোভাব তখনো জেগে ওঠেনি। আত্মীয় স্বজন, এলাকাবাসী সাহস দিতে থাকেন দুটি হাত হারিয়ে মানসিক ভাবে হতাশাগ্রস্ত রইস উদ্দিনকে।

হাত হারানো শোক ভুলে গিয়ে নিজেই উপার্জন করে সংসার চালানোর সিদ্ধান্ত নেন তিনি।  

২০১৪ সালের শুরুতে রাজধানীর বিজয় সরণি এলাকায় ব্যবসা শুরু করেন। নিজের পায়ে দাঁড়াতে রইস উদ্দিন সাহস যোগান বাংলাদেশ প্রতিবন্ধী কর্মজীবী হকার সমিতির সভাপতি পাবনার আলম মন্ডল, তার এলাকাবাসী ও পরিবার।

প্রথমে ৩০০/৪০০ টাকা মূলধন নিয়ে ব্রাশ, কলম, পেনসিল শার্টের পকেটে নিয়ে হকারি শুরু করেন। জনপ্রিয়তা, মানুষের চাহিদায় বাড়তে থাকে তার ব্যবসার পরিধি। পরে রাজধানীর হাজারীবাগ থেকে চামড়ার তৈরি বহুপকেট বিশিষ্ট বিশেষ থলে তৈরি করান রইস উদ্দিন।

বিশেষ থলের একেক পকেটে একেক পণ্য রাখেন তিনি। কাটা হাতের বাহুর দিকে থাকা অবশিষ্ট অংশও ব্যবহার করেন দুই-একটি পণ্য ঝুলিয়ে রাখতে এবং ক্রেতাদের দেখাতে।

মূলত রইস উদ্দিন ক্রেতাদের মুখে তার পণ্যের কথা বলেন। ক্রেতারাই নিজের হাতে পণ্য খুটিয়ে খুটিয়ে দেখেন। পছন্দ হলে নেন। পণ্য বিক্রির টাকাও নিজে নিতে পারেন না তিনি। ক্রেতারাই হিসেবে করে রইস উদ্দিনের ব্যাগে টাকা রেখে যান।

এখন রইস উদ্দিনের মূলধন দুই হাজার থেকে আড়াই হাজার টাকা।

বিজয় সরণি এলাকাতেই ঘুরে ঘুরে ব্রাশ, কলম, পেনসিল, স্ক্রু ডাইভার, টেস্টার, চাবির রিং, নেইল কাটার, চিরুনিসহ বিভিন্ন ধরনের ছোট খাট পণ্য বিক্রি করেন তিনি।

সুতা বেঁধে বিশেষ কৌশলে ব্যবহার করছেন তথ্য প্রযুক্তি এ যুগের নিত্য সঙ্গী মোবাইল ফোন।

রাজধানীর তিতুমীর কলেজের পাশে সাড়ে তিন হাজার টাকায় ভাড়া বাসায় স্ত্রী-সন্তান নিয়ে থাকেন ৩৫ বছরের মোহাম্মদ রইস উদ্দিন।

স্ত্রী সনিয়া আক্তার প্রাইম ইন্সুরেন্সে ৪ হাজার টাকা বেতনে আয়া হিসেবে চাকরি করেন। এক মাত্র ছেলে ৪ বছরের সাফিত।

দুই জনের মাসিক আয় ১০/১২ হাজার টাকার মতো জানান রইস উদ্দিন।

হতাশায় না ডুবে দু’টি হাত ছাড়াই ঘাম ঝরিয়ে স্বল্প আয়ের জীবনযাপনে খুশি তিনি।

আলাপকালে রইস উদ্দিনের চেহারায় হতাশার চিহ্ন দেখা যায়নি। ঠোঁটের কোনে সারক্ষণই হাসি লেগে থাকে তার। মাত্র প্রাথমিকের গন্ডি পেরোনো রইস উদ্দিন শুদ্ধ উচ্চারণে স্পষ্ট ভাষায় কথা বলেন। ভালো বাংলা-ইংরেজি পড়তে পারেন।

রইস উদ্দিন বলেন, হাত হারানোর পর দিশেহারা ছিলাম, হতাশ ছিলাম। এখন ঘুরে দাঁড়িয়েছি। সবার দোয়ায় ভালো আছি।

তিনি বলেন, বেশি কিছু চাই না। অল্পতে খুশি আছি।

রইস বলেন, অন্যের (মামার সামান্য সহায়তা) দয়ায় ভালো লাগছিলো না। জীবনটাকে যুদ্ধক্ষেত্র মনে করলাম, কাজ শুরু করে দিলাম।

বাংলাদেশ সময়: ১৫৫২ ঘণ্টা, জানুয়ারি ২৬, ২০১৮
এমইউএম/এসএইচ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।