দেশি বিজ্ঞানীদের সমন্বয়ে গঠিত দলের সাহায্য উদঘাটন করেন ইলিশের জীবনরহস্য। সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে যোগ দিতে দেশে এসেছিলেন ইলিশের জীবনরহস্য উদঘাটনকারী দলের অন্যতম সদস্য ড. মং সানু মারমা।
ঘুরে গেলেন নিজ জন্মস্থান খাগড়াছড়ির মহালছড়ি উপজেলার সিঙ্গিনালা গ্রাম থেকে।
মহালছড়ির বাসিন্দা হলেও তিনি বর্তমানে আমেরিকায় বোস্টনে ডিএনএ বিন্যাস প্রযুক্তির গবেষণামূলক একটি প্রতিষ্ঠানে কাজ করছেন। সেখানে ইলিশের জীবনরহস্য (জিনোম সিকোয়েন্স) আবিষ্কার করে আলোচিত হন। তাকে কাছে পেয়ে উচ্ছ্বসিত আত্মীয়-স্বজনসহ জেলাবাসী।
আলাপকালে তিনি বাংলানিউজকে জানান, গবেষণার উপকরণ সংগ্রহ থেকে শুরু করে বাংলাদেশের জাতীয় মাছের জীবনরহস্য উদঘাটন গবেষণায় সারথি হিসেবে ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) বায়োকেমেস্ট্রি ও মলিকিউলার বায়োলজির অধ্যাপক ড. হাসিনা খান, যুক্তরাষ্ট্রে গবেষণারত পোলিশ বিজ্ঞানী ড. পিটার লানাকিয়েভ, বাংলাদেশি বায়ো ইনফরমিটিশিয়ান একেএম আবদুল বাতেন, বিজ্ঞানী নিয়ামুল নাসের, রিয়াজুল ইসলাম প্রমুখ।
ড. মং সানু মারমা বাংলানিউজকে বলেন, ইলিশ নিয়ে গবেষণার জন্য দেশের সমুদ্রের গভীরে, মেঘনার মোহনা, পদ্মা-মেঘনা নদীর মিলনস্থল, যমুনা, ব্রহ্মপুত্র, পদ্মার উপরিভাগ ও হাকালুকি হাওরে গিয়ে মাছটির ডিএনএ, আরএনএ নমুনা সংগ্রহ করি। পরে গবেষণায় ইলিশের বংশানুগতি সম্পর্কিত যে তথ্য পাই। তাতে দেখা যায়, ইলিশের পুরো ডিএনএ’র (জিনোম) ক্ষেত্রে প্রায় ১শ’ কোটি বেসপেয়ার (কেমিকেল ইউনিট) রয়েছে এবং জিন রয়েছে ৩১ হাজার ২৯৫টি।
এই গবেষণার ফলে ইলিশের জীবনচক্র, বংশগতি, বাড়ানো, খাদ্যাভ্যাস, আচরণ, রোগ সম্পর্কে জানা যায়। এই তথ্য কাজে লাগিয়ে ইলিশের উৎপাদন বাড়ানো, সমুদ্র ও নদীর বাইরেও অন্যান্য স্থানে কৃত্রিমভাবে চাষ করা সম্ভব হবে। এখন শুরু করতে হবে আরেক ধাপের কাজ। ’
মং সানু বলেন, এই গবেষণা চালিয়ে যেতে হলে সরকারের পৃষ্ঠপোষকতা প্রয়োজন। কারণ গবেষণার জন্য পাঁচবছরও লাগতে পারে আবার ২০ বছরও সময় লাগতে পারে। তাই সরকারকে দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে।
তার মতে, রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা ছাড়া এতো বড় কাজের ধারাবাহিকতা থাকবে না।
তিনি বলেন, গবেষণার মাধ্যমে সমুদ্রের স্যামন মাছ যেমন মিঠাপানিতে বংশবিস্তার করছে তেমনিভাবে মাছ ইলিশও কাপ্তাই লেকসহ মিঠাপানিতে খাপখাইয়ে নিতে সক্ষম। ইতোমধ্যে সমুদ্রের ইলিশ মিঠাপানির জলাশয়ে বেঁচে থাকতে কোনো ধরনের জীবন বিন্যাস প্রয়োজন তার নমুনা সংগৃহীত হয়েছে। তবে এই সব কিছুর জন্য আরও গবেষণা করতে হবে। ইলিশের প্রজনন বাড়াতে নদী ও সমুদ্রের মোহনা দূষণমুক্ত এবং মা ইলিশের চলাচলের প্রবাহ স্বাভাবিক রাখার পরামর্শ দেন তিনি।
বিজ্ঞানী ড. মং সানু মারমা মহালছড়ি উপজেলার সিঙ্গিনালা গ্রামে বড় হয়েছেন। চার ভাই ও দু’বোনের মধ্যে তিনি চতুর্থ। তার বাবা একজন শিক্ষক মং চাই উরি মারমা। তার মায়ের নাম আবাইমা মারমা। ১৯৯৫ সালে ঢাবির রসায়ন বিভাগ থেকে প্রথম শ্রেণিতে প্রথম হন। ১৯৯৭ সালে মাস্টার্সে প্রথম শ্রেণিতে দ্বিতীয় ও জৈব রসায়ন বিভাগে প্রথম শ্রেণিতে প্রথম হন। এরপর তিনি জাপানে বৃত্তি নিয়ে আরেকটি মাস্টার্স ডিগ্রি নেন এবং ২০০০ সালে যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অব সাউদার্ন ক্যালিফোর্নিয়ায় পিএইচডি শুরু করেন। ২০০৫ সালে তার পিএইচডি শেষ হয়। পরে কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে নতুন প্রজন্মের জিন উদ্ভাবন কাজে যুক্ত হন। ২০০৭ সালে নতুন প্রজন্মের ডিএনএ বিন্যাস প্রযুক্তির একটি প্রতিষ্ঠানে তিনি বিজ্ঞানী হিসেবে যোগ দেন। ওই প্রতিষ্ঠানে এখন তিনি জ্যেষ্ঠ বিজ্ঞানী ও নিউক্লিওটাইড রসায়ন বিভাগের প্রধান। স্ত্রী মাফুই চিং রোয়াজা এবং ১১ বছর বয়সী উমা মারমা ও সাত বছর বয়সী মাশুই নুই মারমা নামে দুই শিশুকন্যাকে নিয়ে বোস্টনে তিনি বসবাস করছেন।
স্থানীয় বাসিন্দা থুইহ্লাও মারমা, সুইথোয়াই মারমা জানান, মং সানু মারমার কৃতিত্বে আমাদের এলাকা তথা খাগড়াছড়ির মানুষ গর্বিত। আমরা চাই তার এই সফলতা অব্যাহত থাকুক।
বিজ্ঞানী ড. মং সানুর বাবা মং চাই উরি মারমা বাংলানিউজকে বলেন, আমার সন্তানদের বেড়ে ওঠার ক্ষেত্রে কোনো বাধা ছিলো না। মং সানু নিজ মেধার গুণে এতোটুকু এগিয়েছে। আমি বাবা হিসেবে গর্বিত। আমি চাই সে নতুন নতুন গবেষণার কাজ করে দেশের সুনাম বয়ে আনুক।
বর্তমানে মং সানু মারমার উদ্ভাবিত জিনোম থেকে ক্যানসারের সিকোয়েন্স প্রোফাইল সংগ্রহের কাজ করছেন। গত ৯ নভেম্বর ফিরে গেছেন আমেরিকায়। যাওয়ার আগে জানালেন দেশের প্রয়োজনে সব সময় পাশে থাকার কথা।
এদিকে মং সানু এলাকায় আসার পর থেকে বিভিন্ন সামাজিক, সাংস্কৃতিক সংগঠন থেকে তাকে সংবর্ধনা দেওয়া হয়।
বাংলাদেশ সময়: ০৯১০ নভেম্বর ১৩, ২০১৮
এডি/এএটি