ঢাকা, বুধবার, ১২ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ নভেম্বর ২০২৪, ২৫ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

জাতীয়

ঠেগামুখ স্থলবন্দর: পর্যটন ও ভাগ্য পরিবর্তনের অবারিত সুযোগ

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৩০১ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ৯, ২০১৯
ঠেগামুখ স্থলবন্দর: পর্যটন ও ভাগ্য পরিবর্তনের অবারিত সুযোগ

রাঙামাটি: ভারত সীমান্ত ঘেষা দুর্গম জনপদ রাঙামাটির বরকল উপজেলার  ‘ঠেগামুখ’ এলাকা। এ এলাকাকে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের অপরূপ লীলাভূমি বলা যায় এক বাক্যে। এলাকাটি যেনো বিধাতার নিজে হাতে গড়া স্বপ্নশৈলী। যতদূর চোখ যায় মন ভেসে যায় স্বপ্নলোকে।

ঠেগামুখের পশ্চিমে বাংলাদেশ আর পূর্ব পাশে ভারতের মিজোরাম প্রদেশ। দুই দেশের সঙ্গে চমৎকার বন্ধুত্ব থাকায় এ সু-সম্পর্ককে কাজে লাগিয়ে বাংলাদেশ-ভারত ব্যবসায়িক যোগাযোগ বাড়াতে ওই এলাকায় একটি স্থলবন্দর নির্মাণের সিদ্ধান্ত নেয় আওয়ামী লীগ সরকার।

এ লক্ষে ২০১৩ সালের ৩০ জুন ‘ঠেগামুখ স্থলবন্দর’ নির্মাণের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।

>>>ঘোষণার পরও অগ্রগতি নেই ‘ঠেগামুখ স্থলবন্দর’র

২০১২ সালে ঠেগামুখ স্থলবন্দরের সম্ভাব্যতা সরেজমিনে দেখার জন্য এডিবি’র পাঁচ সদস্যের উচ্চপর্যায়ের একটি দল ঠেগামুখ পরিদর্শন করেন। এছাড়া নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয়ের সাবেক মন্ত্রী শাজাহান খান এবং অত্র মন্ত্রণালয়ের সচিবসহ সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা ঠেগামুখ পরিদর্শন করেন বলে জানা গেছে। এরপর সরকার স্থলবন্দর নির্মাণের জন্য ২৪৭ একর জায়গা নির্ধারণ করে। তবে সময়ের ব্যবধানে স্থলবন্দর নির্মাণে কোনো কার্যক্রম না থাকায় এখনও পর্যন্ত বক্তৃতা, বিবৃতি আর সেমিনারে আলোচনাতে রয়ে গেছে এ প্রস্তাবনাটি।

ঠেগামুখ স্থলবন্দর হলে পর্যটন ও ভাগ্য পরিবর্তনের অবারিত সুযোগ

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, ‘ঠেগামুখ স্থলবন্দর’ নির্মিত হলে রাঙামাটিবাসীর জীবনমানের আমূল পরিবর্তন ঘটবে। ওই এলাকাকে ঘিরে অথনৈতিক নতুন ক্ষেত্র গড়ে উঠবে। ভারত-বাংলাদেশসহ উভয় দেশের মানুষের ভাগ্যের উন্নয়ন ঘটবে। উন্নত হবে যোগাযোগ ব্যবস্থা, বাড়বে ব্যবসার পরিধি। অরক্ষিত এলাকায় সন্ত্রাসী কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যাবে। শুধু তাই নয় স্থলবন্দরটি নির্মিত হলে পর্যটন শিল্পের অপার সম্ভবনা হতে পারে ‘ঠেগামুখ’।

ওই এলাকার একাধিক ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ঠেগামুখ স্থলবন্দরটি নির্মিত হলে ভারত-বাংলাদেশের মধ্যে আমদানি-রপ্তানির সুবিধা বাড়বে। উভয় দেশের মানুষ সহজেই তাদের পণ্য সুবিধা ভোগ করবে এবং অর্থনৈতিক চাকাও ঘুরে যাবে।

ঠেগামুখ বাজারের ব্যবসায়ী নীলা প্রভা চাকমা (কসমেটিকস ব্যবসায়ী) বাংলানিউজকে বলেন, আমি কসমেটিকস ব্যবসার সঙ্গে জড়িত দীর্ঘদিন ধরে। বন্দর নগরী গড়ে উঠলে আমাদের ব্যবসা আরও চাঙ্গা হবে। দুই দেশের মধ্যে পণ্য আমদানি-রপ্তানি বাড়বে। এখনের চেয়ে ভবিষ্যতে আরও বেশি আয়ের সম্ভবনা বাড়বে।

ঠেগামুখ স্থলবন্দর হলে পর্যটন ও ভাগ্য পরিবর্তনের অবারিত সুযোগ।  ছবি: বাংলানিউজ

জানা যায়, ঠেগামুখ স্থলবন্দরটি নির্মিত হলে ভারত-বাংলাদেশের মধ্যে আমদানি-রপ্তানির সুযোগ-সুবিধা বাড়বে। স্থলবন্দরটি চালু করা গেলে আলু-বেগুনসহ যাবতীয় সবজি, সিরামিক ও মেলামাইন পণ্য, ইট, বালু, সিমেন্ট, প্রক্রিয়াজাত খাদ্য, শুঁটকি মাছ, তামাকজাত পণ্য, মাথার চুল, প্লাস্টিক পানির ট্যাংক, আলু, অ্যালুমিনিয়াম সামগ্রী, তৈরি পোশাক, ডিম, টিউবওয়েল ইত্যাদি রপ্তানি করা যাবে।

অন্যদিকে, ভারত থেকে মরিচ, আদা, পেঁয়াজ, হলুদ, কমলা ইত্যাদি আমদানি করতে পারবে বাংলাদেশ। এতে উভয় এলাকার ব্যবসায়ীদের মধ্যে গড়ে উঠবে সুসম্পর্ক। বর্তমানে এসব পণ্যগুলো অবৈধ পথে আমদানি-রপ্তানি হচ্ছে।

রাঙামাটি চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ড্রাস্ট্রিজের সভাপতি বেলায়াতে হোসেন ভুঁইয়া বাংলানিউজকে বলেন, ঠেগামুখ স্থলবন্দর নির্মিত হলে ভারত-বাংলাদেশের ব্যবসায়ীদের মধ্যে ট্রেড ব্যালেন্স আসবে। বাংলাদেশ আমদানির চেয়ে রপ্তানি করতে পারবে বেশি। এছাড়া এ এলাকায় বন্দরটি নির্মিত হলে সন্ত্রাসী কার্যক্রম বন্ধ হবে এবং বন্দরটিকে ঘিরে একটি পর্যটন নগরী গড়ে তোলা সম্ভব হবে।

সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, সকালে সূর্যের কিরণ, স্বচ্ছ নদীর জল, ঢেউ তোলা বোটের শব্দ মনকে শীতল ছোঁয়ার আবেশ ছড়াবে। প্রকৃতির তখন অন্য রূপ ধারণ করে। বিকেলে সন্ধ্যাবাতি জ্বলার আগে দু’পারের কাশফুল, পড়ন্ত বিকেলের সৌন্দর্য মনকে প্রকৃতির খুব কাছে টেনে নিয়ে যাবে।  

ঠেগামুখ স্থলবন্দর হলে পর্যটন ও ভাগ্য পরিবর্তনের অবারিত সুযোগ।  ছবি: বাংলানিউজ

ঠোগামুখ বিজিবি ক্যাম্পের গোল করে বসলে দেখা যাবে, মিজোরামের নীল পাহাড়, গ্রাম আর সবুজ অরণ্য। দেখা যাবে তাদের দেমাগ্রী শহরটিও। স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় আমাদের মুক্তিবাহিনীর সদস্যরা এ মিজোরামের অঞ্চলের দেমাগ্রী শহরে প্রশিক্ষণ নিয়ে সীমান্ত অতিক্রম করে পাকিস্তানি বাহিনীর ওপর আক্রমণ করেছিল। তাই অঞ্চলটি মুক্তিযুদ্ধাদের কাছে ঐতিহাসিক এলাকা হিসেবে আলাদা পরিচতি রয়েছে।

রাঙামাটি নৌ-পরিবহন ও বাস মালিক সমিতির সভাপতি মঈন উদ্দীন সেলিম বাংলানিউজকে বলেন, ঠেগামুখ স্থলবন্দর আমাদের জন্য আর্শিবাদ। যদি বন্দরটি নির্মাণ করা যায় তাহলে আমাদের নৌ ও বাস পরিবহন খাতে নতুন অর্থনৈতিক ক্ষেত্রের সঙ্গে সংযোগ ঘটবে। সড়ক ও নৌপথে বন্দরটির সঙ্গে যোগাযোগ বাড়লে আমাদের আয় রোজগার যেমন বাড়বে তেমনি অনেক বেকার লোকের কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে।

রাঙামাটি হোটেল মালিক সমিতির আহ্বায়ক সাইফুল ইসলাম বাংলানিউজকে বলেন, রাঙামাটি অথনৈতিকভাবে অনেক পিছিয়ে রয়েছে। আমরা দীর্ঘ বছর চেষ্টা চালাচ্ছি এ অঞ্চলের অর্থনৈতিক চাকা সচল রাখতে। তবে যখন শুনলাম সরকার আমাদের অঞ্চলে একটি স্থলবন্দর স্থাপন করবে তখন খুশিতে আত্মহারা হয়েছিলাম। এখন একটা দাবি দ্রুত সময়ের মধ্যে যেন স্থলবন্দরটি নির্মাণ করে সরকার। তাহলে আমাদের হোটেল-মোটেল ব্যবসার পরিধি আরও বাড়বে।

কিভাবে যাবেন:
নদীপথে ঠেগামুখ বা ঠেগাবন্দরের (বরকল উপজেলা) সঙ্গে রাঙামাটি জেলা সদরের দূরত্ব নদীপথে প্রায় ১৩০-১৫০ কিলোমিটার। জাহাজ (ইঞ্জিন চালিত বোট) দিয়ে রাঙামাটি থেকে বরকল উপজেলা সদরে যেতে সময় লাগবে পাঁচ ঘণ্টার মতো। এরপর বরকল শহরে রাত্রিযাপন করতে হবে আপনাকে।

এরপর ভোরে স্থানীয় ভাষায় বার্মিজ বোট দিয়ে আপনাকে ঠেগামুখে যাত্রা করতে হবে। বার্মিজ বোটে ঠেগামুখে যেতে সময় লাগবে সাড়ে তিন ঘণ্টার কাছাকাছি। তবে বলে রাখা ভাল, যতো তাড়াতাড়ি যেতে পারবেন আবার ততো তাড়াতাড়ি আপনাকে বরকল সদরে ফিরে আসতে হবে। নিরাপত্তার কথা মাথায় রেখে সময়ের ব্যাপারে আপনাকে সচেতন থাকতে হবে। তবে চাইলেও আপনি ওই এলাকায় যেতে পারবেন না। বিজিবি থেকে আপনাকে আগেই অনুমতি নিতে হবে। তারপর তারাই আপনাকে নিরাপত্তা দিয়ে নিয়ে যাবে এবং নিয়ে আসবে।

কোথায় থাকবেন:
আগেই যদি ছোট হরিণায় বিজিবি ক্যাম্পে থাকার অনুমতি নিতে পারেন তাহলে ক্যাম্পে রাত্রিযাপন করতে পারবেন। তবে চাইলে আপনি থাকতে পারবেন না। ভাল হয় যেদিন রাঙামাটি শহর থেকে ভোরে বরকল সদরের উদ্দেশে যাত্রা করবেন এবং সেখানে আবাসিক বোডিংয়ে রাত্রিযাপন করবেন। সেখানে স্থানীয় হোটেরগুলোতে ভুড়ি ভোজনের কাজটিও সেরে নেবেন এবং পরদিন  বিজিবির অনুমতি পেলে ভোরে বার্মিজ বোট নিয়ে ঠেগামুখ যাত্রা শুরু করা যাবে এবং সন্ধ্যা নামার আগে আপনাকে বরকল সদরে ফিরে আসতে হবে। তবে বলে রাখা ভাল, ছোট হরিণা থেকে ঠেগামুখ পর্যন্ত পানি সংকট এবং খাবার সংকটে পড়তে পারেন। কেননা সেখানে কোনো খাবার রেস্তোরা নেই। তাই খাবার আগে সংগ্রহ করে নিতে হবে। তবে নিরাপত্তার স্বার্থে বিজিবি-বিএসএফ’র ক্যাম্পের ছবি তোলা থেকে বিরত থাকতে হবে সবাইকেই।

বাংলাদেশ সময়: ০৭৫৪ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ০৯, ২০১৯
এনটি

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।