রাজশাহী: বাঙলা পঞ্জিকায় বছর ঘুরে আসে শরৎ। প্রকৃতিতে ঋতুর রানি শরতের আগমনেই সনাতন ধর্মালম্বীদের মনে দোলা দেয় দশভুজা মহামায়া ত্রিনয়নী দেবীর আবাহনী।
সেখানকার পাল বাড়িতে গেলেই অনুভবিত হচ্ছে সেই উৎসবের হাওয়া। এখন চলছে শেষ মুহূর্তের প্রস্তুতি। প্রতিমা গড়া শেষ হয়ে গেছে গেলো সপ্তাহেই। এরই মধ্যে প্রতিমার গায়ে উঠেছে নতুন শাড়ি। আর শিল্পীর নিপুণ হাতে প্রতিমার গায়ে দেওয়া হচ্ছে রংয়ের শেষ আঁচড়।
তাই শৈল্পিক ছোঁয়ায় কাদা-মাটি দিয়ে তিল তিল করে গড়া দেবী দুর্গার প্রতিমায় এখন ভরে উঠেছে কার্তিক চন্দ্র পালের বাড়ি। কয়দিন পরই দেবীর বোধন। তাই চারিদিকে ব্যস্ততার ছাপ। প্রতিমা তৈরির পর এখন শেষের পথে রূপায়নের কাজ। রং আর তুলির আঁচড়ে ফুটিয়ে তোলা হচ্ছে দেবীর প্রতিচ্ছবি। যেনো ঘুম নেই পাল বাড়িতে। মনের আনন্দে কাজের ছন্দে চলছে পার্বণের জোর প্রস্তুতি। কার্তিক চন্দ্র পালের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, দুর্গার প্রতিমা তৈরির কাজ শেষ। চলছে প্রতিমার শরীরে সাজসজ্জার কাজ। মূলত প্রতিবছর রাজশাহী শহর এলাকায় বেশিরভাগ পূজামণ্ডপেই সেজে ওঠে পাল বাড়ির এই প্রতিমায়। সেলক্ষ্য নিয়েই কাজ করেন এখানকার প্রতিমাশিল্পীরা। হাতের নিপুণ কারুকাজে ১৫ থেকে ৩০টি প্রতিমা গড়ে তোলা হয়। প্রতিমার সাজসজ্জা শেষে তুলে দেওয়া হয় মহানগীর বিভিন্ন পূজামণ্ডপে।
প্রতিমাশিল্পী কার্তিক চন্দ্র পাল বাংলানিউজকে বলেন, বংশ পরম্পরায় এ পেশা পেয়েছেন তিনি। বাবা বাবু চন্দ্র পালের কাছেই তার হাতেখড়ি। বাবা তার শৈল্পিক হাতে প্রতিমা তৈরি করতেন। বুদ্ধি হওয়ার পর থেকে এগুলো দেখেই তার বেড়ে ওঠা। প্রতিমা তৈরির নেশা তাকে বই-পত্রে মন বসাতে দেয়নি। তাই মাত্র ১০ বছর বয়েসেই দীক্ষা নেন বাবার কাছে। শেখেন কাদা-মাটি আর কাঠ-খড় দিয়ে কিভাবে প্রতিমা গড়া যায়।
এই প্রতিমাশিল্পী জানান, ২৯ বছর থেকে তিনি প্রতিমা তৈরির কাজ করেন। তার কাছে বিভিন্ন ধরনের প্রতিমার ক্যাটালগ আছে। তা দেখেই প্রতিমা তৈরির অর্ডার দেন পূজামণ্ডপের দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিরা। ক্যাটালগ অনুযায়ী সর্বনিম্ন ১৫ হাজার থেকে সর্বোচ্চ ৫০ হাজার টাকায় প্রতিমা তৈরি করেন তিনি।
তিনি জানান, প্রতিবছর দুর্গাপূজা শুরুর দুই মাস আগ থেকেই প্রতিমা গড়ার কাজ শুরু হয়। পূজা শুরুর ২/৩ দিন আগে তা ডেলিভারি দেন। তবে কেউ চাইলে এক সপ্তাহ আগেও নিয়ে যেতে পারেন। তার অধীনে চারজন কারিগর কাজ করছেন। সবার লক্ষ্য নির্দিষ্ট সময়ের আগেই কাজ শেষ করা।
প্রতিমা তৈরির জন্য রাজশাহীর চারঘাটের সরদহ থেকে মাটি কিনতে হয়। তবে মাটির চেয়ে পরিবহনের খরচই বেশি। এক ট্রাক মাটির দাম পাঁচ থেকে ছয় হাজার টাকা। কিন্তু তা আনতে ভাড়া লাগে আট থেকে সাড়ে আট হাজার টাকা। প্রতিমা সাজানো চুল বর্তমানে পাঁচশ’ টাকা কেজি। এর সঙ্গে রং, শাড়িসহ অন্যান্য সাজসজ্জার উপকরণ রয়েছে। সবমিলিয়ে যা খরচ হয় লাভও থাকে তার চেয়ে বেশি।
প্রতিমাশিল্পী কার্তিক চন্দ্র পাল বলেন, বর্তমানে তিনি একটু অসুস্থ। তাই অন্য কারিগররা শেষ মুহূর্তের কাজগুলো সারছেন। আষাঢ়ের নয় তারিখ থেকে তারা প্রতিমা তৈরি শুরু করেছেন, কাজ প্রায় শেষ। এখন শুধু প্রতিমাগুলোয় চূড়ান্ত রং লাগিয়ে পোশাক পরিচ্ছদে সুসজ্জিত করা হচ্ছে। তার পরই চলে যাবে মণ্ডপে। করোনা পরিস্থিতি ও নিরাপত্তার মধ্যে সন্ধ্যা ৬টার মধ্যে প্রতিমা বিসর্জন ও স্বাস্থ্যবিধি মেনে শারদীয় দুর্গাপূজা উদযাপন করার আহ্বান জানিয়েছেন রাজশাহী মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার (আরএমপি) মো. আবু কালাম সিদ্দিক। বুধবার (১৪ অক্টোবর) রাজশাহী পুলিশ লাইন্স কনফারেন্স রুমে মহানগর পূজা কমিটির নেতাদের সঙ্গে মতবিনিময়কালে তিনি এ কথা বলেন।
এ সময় রাজশাহী মহানগর পুলিশ কমিশনার সব থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে পূজা কমিটির সঙ্গে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রাখা, ট্রাফিক বিভাগকে ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা জোরদার করার নির্দেশ দেন। যাতে দুর্গাপূজার সময় দর্শনার্থীরা নির্বিঘ্নে বিভিন্ন পূজামণ্ডপ দর্শন করতে পারেন। এছাড়া প্রতিটি পূজামণ্ডপ কমিটিকে সব ধর্মের সমন্বয়ে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি কমিটি গঠনের আহ্বান জানান রাজশাহী পুলিশ কমিশনার।
বাংলাদেশ পূজা উদযাপন কমিটির সিনিয়র সহ-সভাপতি অনিল কুমার সরকার জানান, এবার রাজশাহীতে মোট ৪৬৬টি মণ্ডপে দুর্গাপূজার আয়োজন করা হবে। এরমধ্যে মহানগর এলাকায় পূজামণ্ডপের সংখ্যা ৮৭টি।
তিনি বলেন, এবার স্বাস্থ্যবিধি মেনে পূজার আয়োজন করাটাই আমরা চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিয়েছি। এজন্য ২৬টি নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। সবাইকে নির্দেশনাগুলো কঠোরভাবে মেনে চলতে হবে। সুষ্ঠু ও সৌহার্দপূর্ণ পরিবেশে এবছর দুর্গাপূজা আয়োজনের জন্য আজকের সভায় প্রশাসনের পক্ষ থেকে সব ধরনের সহযোগিতা দেওয়ার আশ্বাস দেওয়া হয়েছে বলেও জানান হিন্দু ধর্মীয় ওই নেতা।
বাংলাদেশ সময়: ১৫২৯ ঘণ্টা, অক্টোবর ১৭, ২০২০
এসএস/এএটি