ঢাকা, শুক্রবার, ২৬ আশ্বিন ১৪৩১, ১১ অক্টোবর ২০২৪, ০৭ রবিউস সানি ১৪৪৬

জাতীয়

চিকিৎসার নামে হতো নির্যাতন, কর্মীদের নেই প্রশিক্ষণ

শেখ জাহাঙ্গীর আলম, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৫৫৬ ঘণ্টা, নভেম্বর ১১, ২০২০
চিকিৎসার নামে হতো নির্যাতন, কর্মীদের নেই প্রশিক্ষণ রাজধানীর আদাবরে মাইন্ড এইড হাসপাতাল। ছবি: বাংলানিউজ

ঢাকা: রাজধানীর আদাবরে মাইন্ড এইড হাসপাতালে চিকিৎসক ছাড়াই রোগীর চিকিৎসা সেবা দেওয়া হতো। হাসপাতাল স্টাফ ও ওয়ার্ড বয়দের দিয়ে দীর্ঘদিন ধরে ভুইফোঁড় এ হাসপাতালটি পরিচালিত হয়ে আসছে।

স্বাস্থ অধিদফতরের অনুমোতিপত্র বা লাইসেন্স ছাড়া অবৈধভাবে গড়ে ওঠা এই হাসপাতালে চিকিৎসার নামে রোগীদের ওপর চালানো হতো অমানসিক নির্যাতন।

চিকিৎসাসেবা নিতে আসা রোগীদের প্রথমেই হাসপাতালে অবজারভেশন কক্ষে জোরপূর্বক নিয়ে যাওয়া হতো। যদি কোনো রোগী ভেতরে যেতে না চাইতেন, তবে শুরু হতো ধস্তাধস্তি। রোগীর পিঠে, কোমরে কিল, ঘুষি, কনুই দিয়ে আঘাত করা হতো। হাত-পা বেধে কৌশলি মারধর করতেন হাসপাতালের স্টাফ এবং ওয়ার্ড বয়রা। তারা এমন ভাবে মারতেন যেন রোগী ব্যাথা ঠিকই পায় কিন্তু রক্তক্ষরণ না হয়। মাইন্ড এইড হাসপাতালে রোগীদের ওপর শারীরিক ও মানসিক এমন নির্যাতন দিয়ে তাদের প্রাথমিক চিকিৎসা শুরু হতো।

সোমবার (০৯ নভেম্বর) রাজধানীর আদাবরে মাইন্ড এইড হাসপাতালে মানসিক চিকিৎসা নিতে আসা সিনিয়র সহকারী পুলিশ সুপার (এএসপি) আনিসুল করিমকে হাসপাতালের স্টাফ ও ওয়ার্ড বয়রা ধস্তাধস্তি ও মারধর করে দ্বিতীয় তলার অবজাভেশন কক্ষে নিয়ে যায়। মারধরের কারণে কিছুক্ষণের মধ্যেই নিস্তেজ হয়ে পড়েন আনিসুল করিম। এরপর তাকে জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউটে নিয়ে গেলে ১২টা ৫৮ মিনিটে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন। চাঞ্চল্যকর এই ঘটনার পর বেরিয়ে আসে অনুমোদনহীন ভূঁইফোঁড় মাইন্ড এইড হাসপাতালে ভর্তি রোগীদের নির্যাতনের চিত্র।

হাসপাতালের রান্নাঘরে কাজ করতেন রুমা বেগম। তিনি মঙ্গলবার (১০ নভেম্বর) বাংলানিউজকে বলেন, ‘এই হাসপাতালে আসা সব রোগীকে প্রথমে অবজারবেশন কক্ষে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে আটকে রাখা হয়। হাসপাতালে এমন দুটি কক্ষ আছে। রোগীকে ভেতরে ঢুকানোর সময় যদি সে যেতে না চায়, তখনই স্টাফ ও ওয়ার্ড বয়রা মারধর শুরু করতেন। ’

‘আমরা রান্নার কাজে ব্যস্ত থাকি। রান্নাঘর থেকে অনেক কিছুই দেখি না। কিন্তু আমরা মারধরের এমন দৃশ্য মাঝে মধ্যে দেখতাম। এছাড়া রোগীদের খাবার দিতে গেল ওয়ার্ড বয়দের কাছে শুনতাম মারধরের এসব কথা। কিন্তু কিছু বলতে পারতাম না’ যোগ করেন তিনি।

বিশেষজ্ঞরা যা বলছেন:
কোনো মানসিক হাসপাতাল বা মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্রে রোগীদের ওপর শারিরীক বা মানসিক নির্যাতন চালানোর নিয়ম নেই। এটা সম্পূর্ণ আইন বর্হিভুত একটি কাজ। মানসিক ও মাদকাসক্ত রোগীকে কথা ও ভালো ব্যবহারের মাধ্যমে গাইড করতে হবে। এজন্য অবশ্যই হাসপাতালের পরিচালক থেকে শুরু করে নার্স, ওয়ার্ড বয়সহ সবার প্রশিক্ষণ থাকা প্রয়োজন। কোনোভাবেই নির্যাতন করা যাবে না।

'মাইন্ড এইড হাসপাতালের ক্লোজ সার্কিট (সিসি) ক্যামেরার ফুটেজে পুলিশের এএসপি আনিসুল কমিরকে যেভাবে ধস্তাধস্তির ও মারধর করার চিত্র দেখা গেছে, তা খুবই দুঃখজনক এবং আইন বর্হিভুত কাজ। নিঃসন্দেহে বলা যায়, অপ্রশিক্ষিত ও অদক্ষ জনবল দিয়ে হাসপাতালটি পরিচালিত হয়ে আসছিলো। '

এ বিষয়ে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের চীফ কনস্যালটেন্ট ডা. সৈয়দ ইমামুল হোসেন বাংলানিউজকে বলেন, ‘চিকিৎসা ব্যবস্থায় কোনো রোগীকে শারীরিক নির্যাতন করার কোনো সুযোগ নেই। '

কোনো ব্যবস্থা নেয়নি স্বাস্থ্য অধিদফতর:
২০১৯ সালে মাদকাসক্ত নিরাময় কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তোলা হয়েছিল মাইন্ড এইড হাসপাতালটি। এজন্য মালিক ও পরিচালকরা মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর থেকে অনুমতি/লাইসেন্স নিয়েছিল। কিন্তু হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ একই সঙ্গে মানসিক রোগীদের চিকিৎসা সেবা চালু করেন। তবে স্বাস্থ্য অধিদফতরের কোনো অনুমোতি বা লাইসেন্স হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের নেই। এদিকে ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারিতে মাইন্ড এইড হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ অনুমতি চেয়ে আবেদন করেছিলেন। পরিদর্শনে এই হাসপাতালে তেমন কোনো লজিস্টিক সুবিধা ও পর্যাপ্ত জনবল ছিল না। এছাড়া একটি আদর্শ হাসপাতালের কোনো ক্যাটাগড়িতে পড়ছিল না হাসপাতালটি। এ কারণে এই হাসপাতালের অনুমোতির আবেদন অধিদফতরের পক্ষ থেকে স্থগিত রাখা হয়। যদিও মাদক নিরাময় কেন্দ্র পরিচালনায় ক্লিনিক্যাল ফ্যাসিলিটি ও হাসপাতালের জরুরী ব্যবস্থা রাখতে হয়।

হাসপাতালের স্টাফ ও ওয়ার্ড বয়দের ধস্তাধস্তি ও মারধরের ঘটনায় একজন রোগীর মৃত্যু হওয়ার পরও তেমন কোনো ব্যবস্থা নেয়নি স্বাস্থ্য অধিদফতর। ঘটনার পরদিন অধিদফতরের পক্ষ থেকে একটি টিম এসে হাসপাতাল পরিদর্শন করে চলে যান।

এ বিষয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ঢাকা জেলার সিভিল সার্জন অফিসার ডা. মইনুল আহসান বাংলানিউজকে বলেন, ‘এই প্রতিষ্ঠানটি অধিদফতরের কাছ থেকে অনুমতি/লাইসেন্স নেয়নি। এই কারণে হাসপাতালটি বন্ধ করার মতো অবস্থায় নেই। সোমবার দুপুরে যে ঘটনাটি ঘটেছে, যদি হাসপাতালের ব্যবস্থা থাকত, হয়তো তাকে আমরা রক্ষা করতে পারতাম। ’

হত্যা মামলা:
নিহত সহকারী পুলিশ সুপার (এএসপি) আনিসুল করিমের বাবা বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. ফাইজুদ্দীন আহম্মেদ বাদি হয়ে মঙ্গলবার (১০ নভেম্বর) সকালে আদাবর থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন। ওই মামলার এজাহারে বলা হয়- গত ৩/৪ দিন যাবৎ আনিসুল করিম (৩৫) হঠাৎ চুপচাপ হয়ে যায়। এই কারণে ৯ নভেম্বর বেলা সাড়ে ১১টার দিকে রাজধানীর আদাবরের মাইন্ড এইড হাসপাতালে নিয়ে আসা হয়। ভর্তি প্রক্রিয়ার সময় আনিসুল সবার সঙ্গে স্বাভাবিক আচরণ করছিলেন।

এরপর আসামির তালিকায় থাকা হাসপাতালের মার্কেটিং ম্যানেজার আরিফ মাহমুদ জয় (৩৫), কো-অর্ডিনেটর রেদোয়ান সাব্বির (২৩) সহ হত্যাকাণ্ডে সরাসরি জড়িত ১০ জনকে গ্রেফতার করা হয়।

'মাইন্ড এইড কোন হাসপাতাল নয় যেন একটি জেলখানা' উল্লেখ করে ঢাকা মেট্রো পলিটন পুলিশের (ডিএমপি) তেজগাঁও বিভাগের উপ-কমিশনার হারুন অর রশিদ বাংলানিউজকে বলেন, স্বাস্থ্য অধিদফরের কোনো অনুমতি নেই। পরিচালনা পর্ষদে কোন ডাক্তার নেই। তারা কিভাবে রোগী নিয়ে আসতো বা এই চক্রের সঙ্গে করা জড়িত তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে।

নিহত আনিসুল করিম ৩১তম বিসিএসে পুলিশ কর্মকর্তা হিসেবে নিয়োগ পান। সর্বশেষ তিনি বরিশাল মহানগর পুলিশে ট্রাফিক বিভাগের সহকারী পুলিশ সুপার (এএসপি) হিসেবে কর্মরত ছিলেন। তার বাড়ি গাজীপুরের কাপাসিয়ায়। তিনি এক সন্তানের জনক। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণরসায়ন ও অনুপ্রাণবিজ্ঞান বিভাগের ৩৩ ব্যাচের ছাত্র ছিলেন আনিসুল করিম।

বাংলাদেশ সময়: ০৫৫৫ ঘণ্টা, নভেম্বর ১১, ২০২০
এসজেএ/এইচএমএস

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।