ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ২৪ আশ্বিন ১৪৩১, ১০ অক্টোবর ২০২৪, ০৬ রবিউস সানি ১৪৪৬

জাতীয়

‘সোনা শফির’ হাত ধরেই ‘গোল্ডেন মনিরের’ উত্থান

স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২০২৪ ঘণ্টা, নভেম্বর ২৪, ২০২০
‘সোনা শফির’ হাত ধরেই ‘গোল্ডেন মনিরের’ উত্থান গোল্ডেন মনির

ঢাকা: মৌচাক মার্কেটে ক্রোকারিজের ব্যবসার পাশাপাশি মনির হোসেন ‘লাগেজ ব্যবসা’ শুরু করেন। এ সময় পরিচয় হয় স্বর্ণ চোরাকারবারী মো. শফিকুলের সঙ্গে।

এই শফিকুলকে সবাই তখন ‘সোনা শফি’ হিসেবেই চিনতেন।

সোনা শফির সঙ্গে মনির হোসেনের ভালো বোঝাপড়া সৃষ্টি হয়। এরপর দুজন মিলে চালাতে থাকেন স্বর্ণ চোরাকারবারী। ‘সোনা শফির’ সান্নিধ্যে মনির হোসেন হয়ে যান ‘গোল্ডেন মনির’। এরপর সিন্ডিকেট গড়ে আন্তর্জাতিক স্বর্ণ চোরাচালান চক্রের বড় মাফিয়া বনে যান শফিকুল ওরফে সোনা শফি।

এই সোনা শফি আর কেউ নন, বর্তমানে তিনি একজন জনপ্রতিনিধি। ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) ৪৪ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিল মো. শফিকুল। উত্তরা, দক্ষিণখান ও উত্তরখান এলাকার সবাই তাকে ‘সোনা শফি’ নামে ভালো চেনেন।

গত ২১ নভেম্বর (শনিবার) সকালে রাজধানীর মেরুল বাড্ডা এলাকায় ডিআইটি প্রজেক্টের ১৩ নম্বর রোডের নিজ বাসা থেকে র‌্যাবের হাতে আটক হন মো. মনির হোসেন ওরফে গোল্ডেন মনির। এর পর আত্মগোপনে চলে গেছেন আন্তর্জাতিক স্বর্ণ চোরাচালান চক্রের মাফিয়া শফিকুল ওরফে সোনা শফি। ঘটনার পর থেকে তাকে আর ৪৪ নম্বর ওয়ার্ড এলাকায় দেখা যায়নি বলে জানিয়েছেন স্থানীয়রা। এছাড়া তিনি রাজধানীর উত্তরা ১৩ নম্বর সেক্টরের গ্র্যান্ড জমজম টাওয়ারের ৪ মালিকের মধ্যে অন্যতম। রোববার (২২ নভেম্বর) থেকে সেখানে তার অফিসে তালা ঝুলছে বলেও জানিয়েছেন ওই্ মার্কেটের ব্যবসায়ীরা।

গোয়েন্দা সূত্র জানায়, সোনা শফির স্বর্ণ চোরাচালান চক্রের অন্যতম সদস্য ছিলেন গোল্ডেন মনির। তাকে গ্রেফতার করার পর থেকে সোনা শফির নানা অপরাধ ও অপকর্মের বিষয়ে অনুসন্ধান শুরু করেছে সরকারের একাধিক গোয়েন্দা সংস্থা। সেই সঙ্গে গোল্ডেন মনিরের সহযোগী হিসেবে যারা নানা সুবিধা ভোগ করেছেন, ইতিমধ্যে তাদের তালিকা তৈরি করছে একাধিক গোয়েন্দা সংস্থা। গোল্ডেন মনিরের সহযোগী ও সুবিধাভোগীদের মধ্যে আছেন জনপ্রতিনিধি, প্রভাবশালী রাজনৈতিক নেতা ও সরকারি কর্মকর্তা।

সূত্র আরও জানায়, বিমানবন্দর এলাকায় একটি হত্যা মামলায় কাস্টমস কর্মকর্তাদের পক্ষের সাক্ষী হয়ে বিশেষ সুবিধা হাসিল করেন সোনা শফি। এরপর গড়ে তোলেন সোনা চোরাচালানের শক্তিশালী নেটওয়ার্ক। ঢাকা, থাইল্যান্ড, সিঙ্গাপুর ও ভারতে সোনা চোরাচালান শুরু করেন তিনি। রাতারাতি অঢেল টাকার মালিক হয়ে ওঠেন। সেই সঙ্গে শুরু করেন অর্থপাচার।  

একসময় বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন ‘সোনা শফি’। ক্ষমতার পালা বদলের পর নিজেও দল পালটে হয়ে যান আওয়ামী লীগ নেতা। ‘শফি অ্যান্ড ব্রাদার্স’ নামে একটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান দিয়ে সিভিল এভিয়েশনে তালিকাভুক্ত হন তিনি। তিন বছর হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের কার পার্কিং ও কনকর্ড হলে ইজারা নেন এই প্রতিষ্ঠানটি মাধ্যমে।

সোনা শফি-গোল্ডেন মনির সিন্ডিকেট:
সূত্র জানায়, স্বর্ণ চোরাচালানী ও ভূমি দখলদারিত্বসহ বিভিন্ন অপকর্মে গোল্ডেন মনির ও সোনা শফির বেশ কয়েকজন সহযোগীর নাম ও তথ্য পেয়েছে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। এদের মধ্যে রাজনৈতিক নেতার নামও রয়েছে। মনির-শফির সোনা চোরাচালান চক্রে অন্যতম একজন হোতা রিয়াজ উদ্দিন। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে এর আগে তিনি গ্রেফতারও হয়েছিলেন। বর্তমানে তিনি সিরাজগঞ্জ সদর উপজেলার চেয়ারম্যান ও উপজেলা আওয়ামী লীগের আহ্বায়ক।

মনির-শফিক সিন্ডিকেটে রয়েছে গুলশান-১ নম্বরের ডিসিসি মার্কেটে প্রসাধনীর লাগেজ ব্যবসায়ী সালেহ আহমেদ। রয়েছে মোহাম্মদ আলী সোনা নামে আরও এক সদস্য। এর আগে মোহাম্মদ আলী বিদেশি মুদ্রাসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে গ্রেফতার হয়ে বর্তমানে কারাগারে আছেন। বাড্ডা এলাকার সাবেক কাউন্সিলর ও বিএনপি নেতা এম এ কাইয়ুম বর্তমানে বিদেশে পালিয়ে আছেন।

চোরাচালানীদের মালিকানায় গ্র্যান্ড জমজম টাওয়ার:
রাজধানীর উত্তরার সোনারগাঁও জনপথ মোড়ে ১৩ নম্বর সেক্টরে রয়েছে গ্র্যান্ড জমজম টাওয়ার। ১৪তলার এই বাণিজ্যিক ভবনটির মালিক ৪ জন। এদের মধ্যে একজন ডিএনসিসির ৪৪ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর মো. শফিকুল ওরয়ে সোনা শফি। দ্বিতীয় মালিক মনির হোসেন ওরফে গোল্ডেন মনির। তৃতীয়, মো. হায়দার এবং চতুর্থ মালিক মোহাম্মদ আলী সোনা।  

এই বাণিজ্যিক ভবনের ৪ মালিকই স্বর্ণ চোরাচালানের একটি বড় সিন্ডিকেট। তারা ৪ জনে ২০ কাঠা জমির ওপর ২০০ কোটি টাকা বিনোয়োগ করে গড়ে তুলেছেন গ্র্যান্ড জমজম টাওয়ার। এই টাওয়ার তাদের অফিস কার্যালয়টি সোনা শফির নিয়ন্ত্রণে থাকে। তবে জিজ্ঞাসাবাদে গোল্ডেন মনির দাবি করছেন, গত ১ মাস আগে জমজম টাওয়ারের মালিকানা বাকি অংশীদারদের কাছে ৫০/৬০ কোটি টাকায় বিক্রি করে দিয়েছেন। তবে এ বিষয়ে কোনো প্রমাণ এখনও পায়নি তদন্ত সংশ্লিষ্টরা।

১৮ দিনের রিমান্ডে গোল্ডেন মনির:

গ্রেফতার গোল্ডেন মনিরের বিরুদ্ধে র‌্যাবের করা ‌তিনটি মামলায় ১৮ দিনের রিমান্ড দিয়েছেন আদালত। প্রথমে তাকে বাড্ডা থানা হেফাজতে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। তবে মঙ্গলবার (২৪ নভেম্বর) বিকেলে গোল্ডেন মনিরের তিনটি মামলার তদন্তভার ডিএমপির গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশের গুলশান বিভাগের কাছে ন্যাস্ত করা হয়েছে। বর্তমানে গোল্ডেন মনির ডিবি হেফাজতে রয়েছেন।
 
পুলিশ জানায়, রিমান্ডে জিজ্ঞাসাবাদে গোল্ডেন মনির গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দিয়েছে। আমরা সেগুলোর বিষয়ে আরও তথ্য সংগ্রহে কাজ করছি। তার অপকর্মের সহযোগীদের শনাক্তের চেষ্টা চলছে।  

এ বিষয়ে বাড্ডা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) পারভেজ ইসলাম বাংলানিউজকে বলেন, গোল্ডেন মনিরের সঙ্গে স্বর্ণ চোরাচালানের যারা জড়িত রয়েছে তাদের বিষয়ে অনুসন্ধান চলছে।  

তিনি বলেন, বিকেলে গোল্ডেন শফির তিনটি মামলাই ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা ডিবি পুলিশের গুলশান বিভাগের হস্তান্তর করা হয়েছে।

ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশের গুলশান বিভাগের উপ-কমিশনার (ডিসি) মো. মশিউর রহমান বাংলানিউজকে বলেন, গোল্ডেন মনিরের তিনটি মামলার তদন্তভার ডিবি পুলিশের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। আমরা আসামিকে ডিবি হেফাজতে নিয়েছি। তাকে জিজ্ঞাসাবাদ চলছে।  

রাজউক-এনবিআর-দুদক-বিআরটিএ’র কার্যক্রম চলছে:
গোল্ডেন মনির গ্রেফতারের পর চারপাশ থেকে সরকারের সংস্থাগুলোর জোরালো ভূমিকা দেখা যাচ্ছে। অবৈধ সম্পদের খোঁজ শুরু করেছেন দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। কমিশনের (দুদক) সচিব মুহাম্মদ দিলওয়ার বখত বলেছেন, অপরাধ শিডিউলভুক্ত হলে গোল্ডেন মনিরের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। শুল্ক ফাঁকি দিয়ে কী পরিমাণ স্বর্ণের চালান দেশে এনেছেন ও পাচার করেছেন সেটি অনুসন্ধানে মাঠে নেমেছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)।  

ইতিমধ্যে গোল্ডেন মনির, তার স্ত্রী ও ছেলে এবং মায়ের সকল ব্যাংক  হিসারের তথ্য চেয়ে সব ব্যাংকের প্রধান নির্বাহীর কাছে চিঠি দিয়েছে।

মনিরের বাসা ও গাড়ির শোরুম থেকে ৫টি বিলাসবহুল গাড়ি আমদানী ও ও সংসদ সদস্যের শুল্কমুক্ত গাড়ি অবৈধভাবে বিক্রির বিষয়টি খতিয়ে দেখছে বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট অথরিটি (বিআরটিএ)। অপরদিকে, জাল-জালিয়াতির মাধ্যমে অসংখ্য ভূমি ও প্লট দখলের বিষয়ে অনুসন্ধান শুরু করেছে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক)।  

র‌্যাবের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক লেফট্যানেন্ট কর্নেল আশিক বিল্লাহ জানান, র‌্যাবের অভিযানে মনির হোসেনকে অন্ত্র ও মাদকসহ আমরা গ্রেফতার করেছি। তার বিরুদ্ধে র‌্যাব বাদী হয়ে তিনটি মামলা দায়ের করেছে। মনিরের বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ পাওয়া গেছে, সেগুলো র‌্যাবের কার্যক্রমের অন্তর্ভুক্ত নয় বিধায় আমরা সরকারের চার সংস্থাকে তদন্ত করতে অনুরোধ জানিয়েছি। তার বিষয়ে সংশ্লিস্ট সংস্থাগুলোকে সহায়তা করতে র‌্যাব প্রস্তুত রয়েছে।

২১ নভেম্বর (শনিবার) সকালে রাজধানীর মেরুল বাড্ডা এলাকায় ডিআইটি প্রজেক্টের ১৩ নম্বর রোডের নিজ বাসা থেকে মো. মনির হোসেন ওরফে গোল্ডেন মনিরকে গ্রেফতার করে র‌্যাব। অভিযানে ওই বাসা থেকে ৬০০ ভরি (আট কেজি) স্বর্ণ, ১টি বিদেশি পিস্তল-গুলি, মদ, ১০টি দেশর বিপুল পরিমান বৈদেশিক মুদ্রা ও নগদ ১ কোটি ৯ লাখ টাকা জব্দ করা হয়। এছাড়া তার বাড়ি থেকে অনুমোদনহীন দুইটি বিলাসবহুল গাড়ি এবং 'অটো কার সিলেকশান' নামের তার গাড়ির শোরুম থেকে তিনটি অনুমোদনহীন বিলাসবহুল গাড়ি জব্দ করা হয়।

বাংলাদেশ সময়: ২০২৫ ঘণ্টা, নভেম্বর ২৪, ২০২০
এসজেএ/এমআরএ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।